সম্প্রতি আমাদের দেশে সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য যথেষ্ট আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে, এই আগ্রহ রাজনৈতিক ইতিহাস রচনার গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে এক প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতার পরিচায়ক। সামাজিক ইতিহাসের সমস্যা সম্বন্ধে এবং এই জাতীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে গবেষকের যে-সকল মৌলিক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়, তাদের সম্বন্ধে, আমাদের চেতনা কতটা প্রখর, সে কথা বুঝতে পারা যায় না; কেননা আমাদের দেশের পণ্ডিতগণ আজ পর্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন নি। প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ ও বর্তমান যুগ-কাল-বিভাজনের এই কাঠামো ইয়োরোপের ইতিহাস থেকে ধার করা। এই কালবিভাগ ইয়োরোপের ইতিহাসে বিশেষ অর্থ বহন করে এবং এই ধরনের কালবিভাগ ইয়োরোপীয় অর্থে এদেশের ইতিহাসের প্রতি আদৌ প্রযোজ্য কিনা, সে সম্বন্ধে এদেশের কোন পণ্ডিতের লেখা সচরাচর চোখে পড়ে না। এ-সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য আলোচনা পাওয়া যায় ম্যাক্‌স ওয়েবার ও ভ্যান লিউর কর্তৃক লিখিত গ্রন্থাবলীতে; কিন্তু এই লেখাগুলোয় অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্বের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপিত বলে কাল-বিভাজনের ধারণাও উক্ত গুরুত্বের প্রভাবে বিশেষভাবে ভারাক্রান্ত। এইজন্য ঐ কাল-বিভাজনের রূপ-রেখা সীমিতশক্তি ঐতিহাসিকদের কাছে অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য। কালবিভাগের সমস্যা ছাড়া আরো কতকগুলো বাস্তব সমস্যা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে মাল-মশলার দুষ্প্রাপ্যতা এবং অপরটি একটি বিশেষ ধারণার প্রতি আমাদের আত্যন্তিক মোহ। আমরা অতি সহজেই বিশ্বাস করি যে, এই উপ-মহাদেশে শত শত বৎসরেও বিশেষ কোন পরিবর্তন ঘটেনি।

রোমের পতন, সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ও তার ফলে ইয়োরোপীয় সমাজ-জীবনের মৌলিক পরিবর্তন, কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন, রিনেসাঁস, শিল্প-বিপ্লব এই ধরনের কোন ঘটনা পাক-ভারত উপমহাদেশে সংঘটিত হয়নি বলে পূর্বোক্ত কালবিভাগে এদেশের ইতিহাসকে চিহ্নিত করতে যাওয়া বিপজ্জনক। তবু ঐতিহাসিককে অনন্তকালের বুকে কোথাও না কোথাও নির্দিষ্ট ছেদ টানতে হয় এবং স্পষ্টভাবে একটি সীমারেখা অঙ্কিত করতে হয়। এই সীমারেখা অনেক ক্ষেত্রে সুবিধার খাতিরে অঙ্কিত এবং এটি কোন দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরের মতো শক্তিশালী নয়। এর এপারে ওপারে যে সমাজ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি বর্তমান, তাদের মধ্যে একটু-আধটু সাদৃশ্য দেখে বিস্তৃত হবার কোন কারণ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে—এই ছেদবিন্দু বা সীমারেখার অবলম্বন কি? অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির প্রতি আরোপিত গুরুতর তারতম্য অনুযায়ী এই প্রশ্নের বিভিন্ন রকমের উত্তর হতে পারে।

তথাকথিত প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগের ইতিহাস সম্বন্ধে আমাদের দেশে অল্পবিস্তর আলোচনা হয়েছে। বর্তমান লেখক নিজেও তথাকথিত মধ্যযুগের সীমাবদ্ধ ও অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ কোন একটি এলাকায় বিচরণ করে থাকেন। কাজেই এই মধ্যযুগ সম্বন্ধে পূর্বোক্ত বিষয়টি নিয়ে কিছু আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলেই মনে করি। প্রাক-মুসলিম আরব সমাজ-জীবনে ধর্মের প্রভাব ছিল অত্যন্ত প্রবল এবং মুসলিম শাসনকালেও ধর্ম তার নিজস্ব পথে অগ্রসর হয়েছে। তবু একটি বৈশিষ্ট্য এখানে অত্যন্ত স্পষ্ট এবং ধর্মের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য এক্ষেত্রে সীমা নির্দেশের কাজ করছে বলে মনে হয়। সুদীর্ঘ কাল ধরে সাহিত্য ও শিল্পের বিভিন্ন শাখা ধর্মের ছোপ গায়ে লাগিয়ে বিকশিত হয়ে ওঠে এবং এই ধর্মও আবার মানুষের বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার ছোঁয়া পেয়ে যুগে যুগে জটিল রূপ ধারণ করেছে। হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্মকে বাদ দিয়ে কি কখনো ইলোরার ভাস্কর্য ও অজন্তার চিত্রকলার কথা কল্পনা করা যায়? হিন্দু পুরাণের আবহ থেকে যদি কালিদাসের কাব্যিক পরিমণ্ডলকে দূরে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করা যায়, তবে সেই চেষ্টা কি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হবে না? একথা ঠিক ধর্মীয় প্রবণতার সঙ্গে ঐযুগের ঐহিক বা যথার্থ মানবীয় মানসিকতা মিশ্রিত হয়ে গেছে। উর্বশী পুরুরবার প্রেমকাহিনীর মনস্তত্ত্ব হয়ত বা মানবীয়। কিন্তু এখানে প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে একজনের প্রতি স্বর্গীয় সত্তা আরোপিত না করে কাহিনীটি লিখতে পারা যায়নি। মেঘদূতের বিরহী যক্ষ ও যক্ষপত্নীর স্থানে কালিদাস যদি মানব-মানবীকে প্রতিষ্ঠিত করতেন তা

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion