শ্রমজীবীরা বিশ্বের দেশে দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছে অথবা আজ হোক কাল হোক করবে। সমস্ত মৌল অর্থনৈতিক সম্পদে ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানাজারী প্রথম কাজ। শিল্পকলা সাহিত্যেরও দখল নেয়া এই কাজের অন্তর্ভুক্ত। এই একান্ত বাস্তব ও অনিবার্যভাবে সম্ভাব্য বাস্তব থেকে উদ্ভব হয়েছে সাহিত্য শিল্পকলার নতুন সংজ্ঞা সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদের। এই সংজ্ঞার মূলসূত্র, শ্রমজীবী মানুষের কর্মকাণ্ড এবং ইচ্ছা ও অনুভবই সাহিত্য- শিল্পকলার চালকশক্তি।

এই সংজ্ঞার সূচনা ঐতিহাসিকভাবে সোভিয়েত অক্টোবর বিপ্লবে, কারণ এই বিপ্লবের মধ্য দিয়েই প্রথম শ্রমজীবীদের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা এবং সাহিত্য শিল্পকলার প্রবর্তন হয়েছে।

মায়াকভস্কির বিশেষত্ব এই যে, যাঁরা সাহিত্য শিল্পকলায় শ্রমজীবীদের দখল নেয়ার কাজে সৃজনশীলতায় এবং তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় পথিকৃত তাঁদের মধ্যেও তিনি সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন। মায়াকভস্কি তাঁর কাজ ও চিন্তা দ্বারা যেমন সোভিয়েত দেশে তেমনি সারা বিশ্বের দেশ দেশান্তরের জন্য সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার ধ্রুপদী কবি হিসেবে ব্রতী ছিলেন, রয়েছেন এবং আগামীতেও থাকছেন।

মায়াকভস্কির কবিতার ভূমিকা ও দায়িত্বের মূলে শুধু কি এই মূলবীজটিই 'বিবেচ্য। অর্থাৎ তিনি কাব্যে শ্রমজীবীদের প্রাধান্য ঘটাবার সঙ্গে আরও কি করেছেন, যেগুলোর আবশ্যকতা ছিল এবং পরেও থাকবে?

এ প্রশ্নের জবাব খোঁজা দরকার এজন্য যে, ভিত্তির সঙ্গে সঙ্গে অধিকাঠামোর নতুন বিন্যাসের প্রবহমান প্রক্রিয়া কাব্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ব্যক্তিকতা, প্রেম ও সৌন্দর্যের সূক্ষ্মাভিলূক্ষ্ম এবং তরল অনুভবের সংস্থান প্রধানত কাব্যেই চাইবে মানুষ আগামীতেও।

অগাস্টিনো নেট্রো, পাবলো নেরুদা, নিকোলাস গিলেন, লুই আরাগঁ এলুয়ার, কাজী নজরুল ইসলাম ও সুকান্তের কবিতার কাজের ধারায় আমরা গণ-বিপ্লবের কাজের কথা ও সৌন্দর্য উভয়কেই খুঁজি।

সুতরাং প্রশ্ন, মূল ভিত্তি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে মায়াকভস্কি ব্যক্তিকতা প্রেম ও সৌন্দর্যের সূক্ষ্ম ও তরল অনুভবগুলোর মধ্যে কী ধারার পরিসর তৈরি করেছেন নিজের কবিতার জন্যে এবং সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার সকল কবিতার জন্যে?

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে মায়াকভস্কির কবিতার গনগনে আঙার ঘাঁটলেই দেখা যাবে, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদের ধ্রুপদী কবি তিনি নতুন ভিত্তি স্থাপন ও অধিকাঠামো বিন্যাসের কাজ একই সঙ্গে করেছেন।

মায়াকভস্কির কবিতা ও তার সহযোগী কাজগুলোতে প্রথমে ভিতিস্থাপনের। এবং পরে অধিকাঠামোর উপাদানগুলোকে পরীক্ষা করলে আমাদের এ বক্তব্যের যুক্তিযুক্ততা বেরিয়ে আসবে।

কাব্যে শ্রমজীবীদের পূর্ণ ও নিরবচ্ছিন্ন এবং অবিসম্বাদী প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মায়াকভস্কির কাজের একটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে এবিষয়ে তাঁর একাগ্রতার মধ্যে।

মায়াকভস্কি তাঁর একটি কবিতায় লিখেছেন, 'তাকে আমি কমিউনিস্ট বলবো না যে অতীতের সেতুটাকে না ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে ভবিষ্যতে যেতে চাইবে।'

কবিতায় শ্রমজীবীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার তাগিদের তীব্রতা বুঝতে পারা যায় এই উক্তিতে।

মায়াকভস্কি ৩৭ বছর বেঁচেছিলেন। ১৮৯৩ থেকে ১৯৩০। যখন তিনি ১৯১৭ সালে সোভিয়েত অক্টোবর বিপ্লবে শরিক হন, তখন তাঁর বয়স ২৪। অর্থাৎ তিনি তাঁর আয়ুষ্কালে ১৪ বছর মাত্র পেয়েছিলেন সোভিয়েত পর্বের কাজের জন্য। নতুন কাজের পরিমাণের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন সোভিয়েত কয়লাখনির শ্রমিক বীর স্তাখানভের মতোই দৃষ্টান্ত স্থাপক।

বিপ্লবের আগেই রাগী আধুনিক নতুন ধরনের পরিশীলিত কবি হিসেবে নাম করেছিলেন তিনি। ১৭ বছর বয়সেই রীতিদ্রোহী ভবিষ্যৎবাদী কবিদের অন্যতম মুখপাত্র হিসেবে কাজ শুরু করে ম্যাক্সিম গোর্কির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তাঁর প্রথম যৌবনের কাজও শক্তি ও পরিমাণের দিক দিয়ে নিরন্তর সাধনারই পরিচায়ক। কিন্তু সোভিয়েত বিপ্লবের শ্রমজীবীদের কবি হয়ে যে কাজ তিনি করলেন, তা গুণে, ও পরিমাণে ১৪ বছরের সময়ের মধ্যে অভাবিত পূর্ব। কবির ১৩ খণ্ডের রচনাবলীর মধ্যে ১২ খণ্ডই বিপ্লবোত্তর।

ঝড়ের সঙ্গে ঝড়ের বেগে তাঁকে কাজ করতে হয়েছিল। বিপ্লবী জনগণের সঙ্গে সঙ্গে থেকে একাদিক্রমে বছরের পর বছরের ৩৬৫ দিনের নিরন্তর মুক্তিযুদ্ধ ও নির্মাণের হাজার কাজের অভিজ্ঞতাকে বিদ্যুৎ জ্বালার মতো সংগ্রহ করে তাঁকে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার ধ্রুপদী ধারা তৈরি করতে হয়েছিল। কাব্যের দুটি মূল ধারা যুগযুগান্ত ধরে চলে আসছে। একটি লোককাব্য, আরেকটি মহাকাব্য ও গীতি কবিতার পরিশীলিত ধারা। লোককাব্যে শ্রমজীবী জনগণের অস্তিত্ব প্রাধান্য পেলেও এতকাল পরিশীথিত কাব্যে এবং সাধারণভাবে পরি- শীলিত সাহিত্যে শিল্পকলায় শ্রমজীবীদের স্থান ছিল অকিঞ্চিৎকর। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এসে এই প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। মায়াকভস্কি কাব্যে এই নির্দেশ অনুযায়ী প্রাচীর ভাঙ্গার অগ্রদূত।

পরিশীলিত এবং বিশেষ করে আধুনিক ধারার কবিতায় শ্রমজীবী জনগণের সোভিয়েত বিপ্লব ও জগৎব্যাপী অভ্যুত্থানকে প্রাধান্য দেবার জন্যে কবি হিসেবেই উদয়াস্ত খাটতে হয়েছে মায়াকভস্কিকে। কারণ, কবিতা লিখে যে ধ্রুপদী কাজ করেছেন, তার যাচাই হয়েছে তৎক্ষণাৎ। বিপ্লবী সৈনিক সমাবেশে, কারখানা ও যৌথখামারে গণসমাবেশে নিত্য নতুন লেখা আবৃত্তি করতে হয়েছে। অসংখ্য বৃত্তি ও বিভাগের অগণিত ধরণের শ্রমজীবী নরনারীর অভিজ্ঞতাকে কষ্টিপাথর করে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন তিনি। চারণের মতো তাঁকে যেতে হয়েছে দূরে দূরান্তে। এই সময়সাপেক্ষ ভ্রাম্যমানতার মধ্যে প্রত্যেকটা মুহূর্তে কি ঘটেছে তা লক্ষ্য করতে হয়েছে। তাঁর ১৪ বছরের সোভিয়েত পর্বেই তিনি ফ্রান্সে, জার্মেনীতে, মেক্সিকোতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রগতিবাদীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছেন। কবিতার কাগজ বের করেছেন সোভিয়েত পর্বেও একাধিক। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯২০ সালে জনগণকে সর্বশেষ খবর জানানোর জন্যে সংবাদসংস্থায় যোগ দিয়েছিলেন। ওই সময়ে ৩ হাজার পোস্টার ও ৬ হাজার শিরোনামা লিখেছিলেন। এগুলো ছিল ব্যঙ্গচিত্র ও ব্যঙ্গ-বাণী। ১৯২৮ সালে সারা সোভিয়েত দেশে পরিভ্রমণ করার সময় কবিতার শ্রোতাদের কাছ থেকে ২০ হাজার প্রশ্ন সংগ্রহ করেছিলেন এবং প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যে একটা বই লেখার কথা ভেবেছিলেন।

অর্থাৎ, শ্রমজীবীদের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়ে শ্রমজীবীর সমস্ত গুণ আয়ত্ত করেছিলেন।

যখন চিন্তা করা যায়, 'বেডবাগ' ও 'বাথ হাউস' নামের দুটি পূর্ণাঙ্গ গদ্য নাটক লিখেছিলেন তিনি এই ১৪ বছরের মধ্যেই তখন তাঁর শ্রম-ময়তাকে উপলব্ধি করা যায় তীব্রভাবে।

মায়াকভস্কি সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদী চলচ্চিত্রেরও একজন নীতিনির্ধারক ও নির্মাতা। তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, চিত্রনাট্য লিখেছেন। বছরের পর বছর আইজেনস্টাইন ও অন্যান্য সাথীর পাশাপাশি কাজ করেছেন তিনি।

সুতরাং বুঝতেই পারা যায়, কী বিস্ময়কর তাঁর পরিশ্রম ও জেদ এবং চেতনা এবং গতি ও নির্দিষ্টতা।

এর মধ্যে সময় করে একটি আত্মজীবনী লিখে রেখে গিয়েছেন তিনি গদ্য কড়চার রীতিতে।

একটি কড়চায় তিনি বলেছেন, একটি উপন্যাসকে তিনি মাথায় নিয়ে ঘুরেছেন, কিন্তু লিখে উঠতে পারেন নি।

তাঁর অবস্থাটা ছিল এই রকম।

তাঁর সাথী কবি আসেয়েভ স্মৃতিকথায় লিখেছেন, মায়কভস্কি কোনো খসড়া না করেই কবিতা লিখতেন। কাটাকুটি কম থাকতো। প্রকৃতপক্ষে ভাবনাগুলোকে তিনি মাথায় করে নিয়ে ঘুরতেন এবং সেখানেই ঠিকঠাক করে নিতেন। এ ব্যাপারে ভাবনাচিন্তার তীব্রতা তাঁর একটি উক্তি দ্বারা অনুধাবনীয়। ম্যয়াকভস্কি একটি কবিতায় লিখেছেন, 'এক টন শব্দের ধাতু ছেঁকে আমি বার করে আনি একেকটা কথা।'

মায়াকভস্কি ১৯২০ সনে "পুশকিনের প্রতি” কবিতায় লেখেন, "আমার লঘু মস্তিষ্কে হাজার টনের ভার চাপানো রয়েছে।"

এই সমস্ত কিছুকে নিয়েই অবশ্য মায়াকভস্কি সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার ধ্রুপদী কবি। তিনি শ্রমজীবী জনগণের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করেছিলেন সারা সোভিয়েত দেশে এবং সীমান্ত ছাড়িয়ে।

'ইহা' কাব্যে মায়াকভস্কি কবিতা লেখার প্রক্রিয়াকে যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

কবির মস্তিষ্ক থেকে কবিতার উৎপাদন যেন যন্ত্র, থেকে একটা সুন্দর কিছু বেরিয়ে আসার শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়া। কমিউনিজমের আদর্শে নিয়োজিত শ্রমজীবী- 'দের সঙ্গে মায়াকভস্কির একাত্মতার দৃষ্টান্ত নিম্নোক্ত দুটি অনুচ্ছেদ:

(ক)

শ্রমজীবীরা

কমিউনিজমে আসে

পাতাল থেকে খনি থেকে

কাস্তে থেকে কারখানা থেকে।

আমি কমিউনিজমে

নিজেকে নিক্ষেপ করেছি

কবিতার উঁচু চুড়া থেকে।

কারণ এছাড়া আমার জন্যে

কোনো প্রেম নেই।

(ঘরে ফেরার পথে, ১৯২৫)

(খ)

আমি যে কবি

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion