“রহিম”—

বাড়ী ঢুকেই সাব ইন্সপেক্টর শেখ আবদুল হামিদ চাকরকে হাঁক দিলেন, “বশিরকে একবার আমার ঘরে পাঠিয়ে দেতো” বলে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে গিয়ে কোট ও বেল্ট খুলে আলনায় টাঙিয়ে, টেবিলের সামনে গিয়ে বসলেন। অজস্র জিনিস ছড়িয়ে আছে টেবিলের উপর। একধারে সরু মোটা আইনের কেতাব আর নানান বেআইনি বই। কাগজ-পত্তরে ঠাসা ফাইল। মাঝখানে কলমদান, ঠিক তার পাশেই আজকের ডাক, পাঁচ ছ’টা খাম, কয়েকটা পোষ্ট কার্ড আর দু’তিনখানা খবরের কাগজ।

শেখ সাহেব চেয়ারে বসে দূরের চশমা খুলে টেবিলে খালি জায়গাটুকুতে রেখে দিলেন। কাছের চশমা চোখে দিয়ে ডাকের চিঠিপত্র দেখতে লাগলেন।

সবে হয়তো গোটা দু’য়েক খাম খুলেছিলেন, দেখলেন, তাঁর পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলেটা ভেতরে ঢুকছে।

ছেলেটাকে দেখলে বেশ চটপটে ও দুরন্ত মনে হয় কিন্তু বাপের ঘরে ঢুকলেই তার স্বভাব পালটে যায়, চোখ দুটো ঝুঁকে থাকে মেঝের দিকে—এমন দেখায় যেন তার ধড়ে প্রাণ নেই আর।

“সামনের চেয়ারে বস,” একটা লম্বা চিঠি পড়তে পড়তে শেখ সাহেব বাঘের মত গর্জন ক’রে হুকুম দিলেন।

ছেলেটা ভয়ে জড়োসড়ো হ’য়ে সামনে বসে পড়ে।

“আমার দিকে তাকাও”—চিঠি থেকে মুখ তুলে শেখ সাহেব হুংকার ছাড়লেন, “শুনেছি, আজ তুমি তাশ খেলেছ?”

“না বাবা”—ছেলেটা ভয়ে ভয়ে বলে।

শেখ সাহেব এবার নিজের স্বভাববিরুদ্ধ গলায় বলে, ওঠেন, “ভয় পেয়োনা। সত্যি সত্যি কি হয়েছে: বলো, আমি তোমাকে কিছু বলব না। আমি নিজে দেখেছি তোমাকে, আবদুল্লার ছেলের সঙ্গে তাদের উঠোনে বসে তাশ খেলছিলে, নয় কি?”

ছেলেটা মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে সায় দেয়।

“শাবাস,” শেখ সাহেব নরম গলায় বলেন, “আমি খুব খুশী যে শেষ পর্যন্ত তুমি সত্যি কথা বলেছ। বশির, আমি সত্যি সত্যি তোমাকে খেলতে দেখিনি, একজনের কাছে শুনেছি। তোমাকে দিয়ে কবুল করাবার এ একটা কায়দা। আমরা অপরাধীকে দিয়ে এমনি কথা বলিয়ে নিই। যাক্ আজ তোমাকে কয়েকটি দরকারী কথা বলতে চাই, শোনো।”

“মন দিয়ে শোনো” বলে তিনি বশিরের দিকে তাকালেন। সে বাবার চশমা নিয়ে তার ডাঁটি দু’টো বেঁকাচ্ছিল।

তার হাত থেকে চশমা কেড়ে নিয়ে, পাশের ফাইল থেকে ওয়ারেন্টের বক্তব্য মনে মনে পড়তে পড়তে শেখ সাহেব বলতে লাগলেন: “তোমার জানা উচিত, এই অপকর্ম অনেকগুলো পাপের সূচনা মাত্র। তার জলজ্যান্ত প্রমাণ—তাশ খেলার পাপ লুকোবার জন্য তোমাকে মিথ্যে কথাও বলতে হল। তার মানে একটার জায়গায় তুমি দু'টো পাপ করলে।”

ওয়ারেন্টটা ফাইলে নথিভুক্ত ক’রে শেখ সাহেব ছেলের দিকে তাকালেন। বশির তখন পিনকুশন থেকে পিন বের ক’রে টেবিল ক্লথে ফোটাচ্ছিল।

“আমি যা বলছি সেদিকে কান দাও!” শেখ সাহেব তার হাত থেকে পিন কেড়ে নিয়ে খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে ওলটাতে বলেন, “তাশও এক ধরণের জুয়ো—বুঝলে? জুয়ো। এর থেকেই বাড়তে বাড়তে মানুষকে জুয়োর নেশায় পেয়ে বসে! আর এই বদ অভ্যেস শুধু নিজের মধ্যেই আটকে থাকেনা, একজনের থেকে অন্যে, তার থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, যেমন খরমুজের পাশে থাকলে খরমুজ রঙ বদলায়।”

কলমদান থেকে আঙুলে কালি লাগিয়ে বশির একটা শাদা কাগজে হিজিবিজি আঁকছিল। খরমুজের নাম শুনেই আঙুলটা টেবিলের তলার কাঠে মুছে এমনভাবে বাপের দিকে তাকায় যেন সত্যি কেউ খরমুজ হাতে নিয়ে বসে আছে।

“বশির!” ছেলের সামনে থেকে কলমদান সরিয়ে রেখে শেখ সাহেব বলেন, “মন দিয়ে আমার কথাটা শোনো”...এইটুকুই বলতে পেরেছেন ইতিমধ্যেই টেলিফোনের ঘন্টি বেজে উঠল। শেখ সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে রিসিভার তুললেন। “হ্যালো! কোত্থেকে বলছেন?... বাবু পুরুষোত্তম দাস?... আদাব! বলুন, কী হুকুম, লটারির টিকিট?...আজ সন্ধ্যেবেলাই ভরে পাঠিয়ে দেবো। পাঁচটা টিকিটের কত দাম, পঞ্চাশ…? কিন্তু আজ পর্যন্ত কারো নামে পুরস্কার উঠেছে কি?বলা তো যায়না কবে বরাত ফিরবে, এই ঘোড়ারোগের কোনো দাওয়াই বাতলাবেন আপনি!... আচ্ছা, আদাব অর্জ...।”

রিসিভার রেখে তিনি ফিরে নিজের জায়গায় এসে বসে বলেন, “শোনো, দুষ্টুমি কোরোনা। পেপার ওয়েট মাটিতে পড়ে ভেঙে যাবে। ওটা রেখে দাও। মন দিয়ে আমার কথা শোনো।”

“হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম আমি।” অন্য একটা ফাইলের ফিতে খুলতে খুলতে শেখ সাহেব বললেন, “তাশ খেলার দোষের বিষয়ে বলছিলাম। তাশ থেকে জুয়ো জুয়ো থেকে চুরি; চুরি করলে কি হয় জানো?” বশিরের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, “জেল, মানে কয়েদের সাজা।”

বশির ফাইল থেকে বাইরে উঁকি মারা একটা হলদে কাগজে কলমের ডগা দিয়ে ছেঁদা করছিল।

“পাজী, অকর্মের ধাড়ী”, শেখ সাহেব তার হাত থেকে কলম কেড়ে নিয়ে বললেন, “এসব বাজে কাজ ছেড়ে আমার কথা শোনো। জানোই তো, রোজ কত চোর-ছ্যাঁচোড়কে চালান দিতে হয়? এরা সবাই তাশ খেলতে খেলতে চুরি করা শেখে। যদি তাদের মাথায় আইনের এমনি ডাণ্ডা না পড়ে তাহলে না জানি তারা আরো কত অনাছিষ্টি কাণ্ড বাধাবে।” বলে শেখ সাহেব টেবিলের এক কোণায় রাখা ইণ্ডিয়ান পেনাল কোডের দিকে ইঙ্গিত করলেন। কিন্তু বশিরের নজর অন্য একটি বইয়ের দিকে। বইটার মলাটের উপরের কাপড় একটু আলগা হয়ে গিয়েছিল, সেটা টেনে টেনে বশির প্রায় আধখানা উপড়ে এনেছে।

“বেকুফ, গাধা কোথাকার!” বইটা উঠিয়ে বশিরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখে শেখ সাহেব বলেন, “তোমাকে কি বইয়ের মলাট ওপড়াতে ডেকেছি এখানে? আমার কথা মন দিয়ে শোনো।” কয়েকটা সমনের উপর সই করতে করতে তিনি পুরোনো কথার খেই ধরলেন, “আমাদের, পুলিশ অফিসারদের গভর্ণমেন্ট এত বেশী মাইনে ও পেনশন কেন দেয়, জানো? শুধু এইজন্যে যাতে এই দেশ থেকে অপরাধ একেবারে নির্মূল ক’রে দিই। কিন্তু যদি আমাদের ছেলেরাই তাশ আর জুয়ো খেলতে শুরু ক’রে দেয়, তাহলে তামাম দুনিয়া কি বলবে, আর আমরাই বা কেমন ক’রে নিজের নিমকের ঋণ শোধ…”

কথার মাঝখানে পিছনের দরজা দিয়ে শেখ সাহেবের খুব লম্বা মতন একটা চাকর এসে দাঁড়ায়। ও একটি সেপাই। শেখ সাহেব সর্বদাই এ ধরণের দু’তিন জন বিশ্বস্ত সেপাই বাড়ীতে রাখতেন। এদের মধ্যে একজন গরু মোষ চরায় ও দুধ দোয়ায়, আরেকজন রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করে। তৃতীয় যে লোকটা ভেতরের দিক থেকে ঘরে ঢুকল, তাকে রাখা হয়েছিল আসামীর কাছ থেকে পয়সা উশুল করার জন্য। লোকটা মাথা নুইয়ে সেলাম ক'রে বললে, “আজ্ঞে, ওরা এসে বসে আছে।”

“কারা?”

“আজ্ঞে, সেই বুগংঘী বদমাশের লোকেরা, যারা দশহরার মেলায় জুয়াখানা খোলার আর্জী পেশ করেছিল।”

“তুমি নিজেই ওদের সঙ্গে কথা বলে নিতে পারবে।”

“আমি তো ওদের বলেই দিয়েছি যে শেখ সাহেব আড়াইশোর কমে রাজি নন, কিন্তু....।”

“তা, ওরা কি বলছে?”

“ওরা বলছে, আমরা নিজেরাই একবার শেখ সাহেবের চরণ স্পর্শ করতে চাই। যদি আপনার অসুবিধে না হয় তো দু’মিনিটের জন্য আসুন। ওরা অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে।”

“আচ্ছা চল।” বলে শেখ সাহেব উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বশিরের দিকে তাকালেন। ছেলেটা ঝিমুচ্ছিল। যদি শেখ সাহেব তক্ষুণি বকুনি দিয়ে তাকে জাগিয়ে না দিতেন তাহলে টেবিলে তার মাথা ঠুকে যেত।

“যাও জিরিয়ে নাও।” নিজের টুপি ও বেল্ট সামলাতে সামলাতে শেখ সাহেব বললেন, “সন্ধ্যাবেলা তোমাকে আরো উপদেশ দেব। আর কখনো তাশ খেলো না।”

শেখ সাহেব বেরিয়ে গেলেন। ছেলেটা আড়ামোড়া ভাঙল, হাই তুলল, চোখ রগড়াল, তারপর লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে পড়ল বাইরে।

কথা পাঞ্জাব, ড. হরভজন সিং (সম্পা), প্রবোধ কুমার মজুমদার, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, নয়া দিল্লি, মার্চ ১৯৩১

ছবি: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রসূত

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion