তোতাকাহিনী খাঁচাকাহিনী
“রুকমনিআই নি রুকমনিআই।” লাহোরে কাচা চাবুক স্বরণ গলিটায় ঢুকে রুকমনিআইয়ের বন্ধুরা তাকে যেভাবে ডাক দিত, খাঁচার মধ্য থেকে তোতাটাও ঠিক সেভাবেই ডাক দিল। পাখিটার মেজাজ খুশি রাখতে চাইলে রুকমনি অবশ্য তার সে-ডাকে সাড়া দিত, কিন্তু এখন, সে সাড়া দেবার আগেই, পাখিটা আবার তার নাম ধ’রে ডাকাডাকি শুরু করল। অমৃতসরের কাছারিবাড়ির প্রায় পোয়াটাক মাইল দূরে রাস্তাটার পাশে গুড়ি মেরে ব’সে ছিল রুকমনি, পাখিব ডাকে সে কোনো সাড়া দিল না।
“রুকমনিআই নি রুকমনিআই।” তোতাটা আবারও ডাক দিল।
ছোলাভাজা বিক্রি করে যে-লোকটা তার কাছে রুকমনি শুনেছেডিপটি কলাটরএ-রাস্তা ধ’রেই আসেন। রাস্তায় গাড়ির চলাচলের বিরাম নেই, কত টাঙ্গা, কত এক্কা, তার ওপর হাওয়াই গাড়ি; ধূলোর মেঘ উড়ছে চারপাশে, আর সেই ধুলোর মধ্যে চোখ পিটপিট করে ডিপটিরই জন্যে হা ক’রে তাকিয়ে আছে রুকমনি—তোতার হাঁকাহাঁকি তার কানেই যাচ্ছিল না।
“রুকমনিআই নি রুকমনিআই।” তোতা এবার রিনরিনে গলায় চেঁচিয়ে উঠল। সেই থেকে সে একটানা ডেকেই চলেছে। কথা-বলা পাখিটার ধারণা যে সে যদি এভাবে ডেকেই চলে, তবে একসময় না একসময় বুড়ি সাড়া দেবেই।
“হাঁ, বেটা, হাঁ…” শেষ অব্দি নির্জীব ক্লান্ত স্বরে বলল বুড়ি। তার মাথার পেছনটায়, খোঁপার তলায়, কেমন একটা ভোঁতা চিনচিনে ব্যথা; আর এখন জুনমাসের সকালে রোদ্দুর যতই চড়ছে, ব্যথাটাকে তার মনে হচ্ছে সেই ভয়ংকর রাতটায় তাদের গলিতে খুন-জখম-আগুন যখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল তখনকার সেই গুম গুম গুম আওয়াজের মতো।
বয়স অজস্র ভাঁজ ফেলে গেছে তার মুখটায়। এখন সেই গভীর ভাঁজগুলোয় ঘামের ছোটো ছোটো ধারা চুঁইয়ে পড়ছে। হাতের পিঠ দিয়ে সে রোদের তেজ থেকে চোখদুটিকে আড়াল করার চেষ্টা করল, যাতে রোদে চোখ ধাঁধিয়ে না-গিয়ে সে ডেপুটি কমিশনারের ‘দর্শন’ পায়। তার তোবড়ানো ফোগলা মুখটা হাঁ হ’য়ে আছে; সে যেদিকে তাকিয়েছিল সেদিক থেকে দুটি মাছি ভনভন ক’রে উড়ে এসে তার ঠোঁটের কোনায় বসল।
মাছিগুলোকে তাড়াবার জন্যে বুড়ি অলসভাবে তার বাঁ হাতটা তুলে নাড়ে।
মাছিগুলো কিন্তু নাছোড় লেগেই থাকে, আর তার প্রাণে এমন একটা বিরক্তি লেলিয়ে দেয় যার মধ্যে তার মনে হয় যেন ঘোর-এক আতঙ্ক তার পেটটাকে ঠেসে চেপে ধরেছে।
“নি তুন কিথে হাঁয়—” তোতা এবার অন্য একটা চীৎকার ছাড়ে—বুড়ির বন্ধুরা গলিতে ঢুকেই অবশ্যম্ভাবীভাবে যা জিগেস করত: “কোথায় আছিস তুই?” কারণ রোজই তাকে বেরুতে হ’ত পেটের ধান্ধায়-দাসী-বাঁদির কাজে, হাত লাগাতে হ’ত সব কাজেই, গলির বড়ো-বড়ো বাড়ির বাসিন্দাদের জন্যে বাসন-কোসন মাজতে হ’ত, কিংবা খানাটার কূপের পাশে অন্ধকার একতলার ঘরে সকলের চোখের আড়ালে, অন্দরমহলে, সব কাজকর্ম সারতে হ’ত।
“কোথায় যে আছি, বেটা, তা আমি নিজেই জানি না…” উদাস অবসাদে বুড়ি বলে—তোতাটাকে যে তার খেয়াল আছে সে-বিষয়ে তাকে আশ্বস্ত ক’রে পাখিটাকে সে চুপ করাতে চায়। “আমি শুধু এটাই জানি ফাচত্তা যদি তার বুরখাটা আমায় না-দিত, তবে আজ আর আমি এখানে থাকতাম না…”
“নি তুন কী করনি হাঁয়?” রুকমনির বন্ধুবা তাদের তৃতীয় যে-ডাক ছাড়ত, সেটা ডেকে তোতা নাছোড় লেগেই থাকে।
“কিছুই না, বেটা, আমি কিছুই করছি না—শুধু ব’সে আছি”, ক্লান্ত স্বরে বলে বুড়ি—এমনভাবে বলে যাতে মনে হয় সে যেন তার পৃষ্যির সঙ্গে কোনো আলংকারিক কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে, মনটাকে যাতে কোনোকিছুতে ব্যস্ত রাখা যায়। কারণ একেবারে তার, আঁতের মধ্যটা থেকে কেমন একটা বিশৃঙ্খলা চেতিয়ে উঠছে এখন—ঠিক সেইরকম, যখন সে ভয় পেয়েছিল, যখন খ্যাপা গলাগুলো থেকে সেই বিভীষিকার রাত্রে ‘আল্লা হো আকবর।’ ‘হর হর মহাদেও!’ ‘সৎশ্ৰী আকাল!’ ফেটে পড়েছিল। এবং তখনই সে গলিটা ছেড়ে পালিয়ে আসে।
লেলিহান আগুনেব ঝিলিক, ফট ফটা ফট ফেটে যাচ্ছে বাড়িগুলোর থাম, সব ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার, দমআটকানো ধোঁয়া; আর সে ভেবেছিল তার জীবনের শেষ দিনটা বুঝি এই, ভেবেছিল কলিযুগের সব পাপে ধরতি মায়ি বুঝি কেঁপে উঠছে, ভেবেছিল যে ধরতি এখনই হাঁ হয়ে গিয়ে সবকিছু গিলে খাবে...আর তারপরই নিয়তি এসে তাকে বলেছিল সে যদি জায়গাটা ছেড়ে চলে না যায় তবে তাকে জানে মেরে ফেলা হবে।
“নি তুন কী করনি হাঁয়,” তোতা ফের আওড়ায়, “নি তুন কী করনি হাঁয়?”
“কিছুই করছি না, বেটা, কিছুই না,” রুকমনি জবাব দেয়, “আর এও জানি না আমি এখন কোথায় আছি…” আর সে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে। ম্যাল রোড আর কাছারি রোডের মোড়টার দিকে—কিন্তু ডেপুটি কমিশনারের কোনো চিহ্নই সে দেখতে পায় না, আর তার শেষ কথাটা যেন বিশেষ একটা তাৎপর্যে ভ’রে যায়। “রুকমনিআই নি রুকমনিআই!” তোতা আবার ডাকে।
তার এই ধাতব রিনরিনে নাকিগলার প্রশ্নের উত্তরে তার নিজের জবাবগুলো এখন আর তাকে বিরক্তও করে না, বরং যেন বিভীষিকার রাত্রির দানোগুলোর ভারি চাপটা তার মাথা বুক আর তলপেট থেকে সরিয়ে দেয়।
“নি তুন কী করনি হায়?” তোতা তার গোঁ ছাড়ে না।
“বেটা, আমি সাহেবের জন্যে ব’সে আছি, যাতে রুটি কিনতে দুটো পয়সা দেন—ওরা বলল আমরা যা হারিয়েছি কংগ্রেস রাজ তা সবই ফিরিয়ে দেবে। বেটা, লোক এইসবই বলল—টিশনে শুনলাম, বেটা, টিশনে শুনলাম। কী-রে বেটা, তোর খিদে পেয়েছে?... নিশ্চয়ই জবব খিদে পেয়েছে তোর...একটু সবুর কর, সাহেব আমাকে পয়সা দিলেই ঐ দোকানির কাছ থেকে দুটি ছোলা কিনে দেবো তোকে…”
“মায়ি, তুমি কি স্বপন দেখছ? পাগল হয়ে গেছ না কি তুমি?” ছোলাওলা বলে। “যাও, বরং শহরেই চলে যাও তুমি...হয়তো দরবার সাহেব গুরুদোয়ারায় কিছু খাবার মিলে যাবে। ডিপটি কলাটরের কাছ থেকে তুমি কিছুই পাবে না…”
“আ-বে, সা-যা, মালিকখোর কোথাকার!” তেতো স্বরে বুড়ি চ্যাঁচায়। আত্মতৃপ্ত ছোলাওলার এমনতর কাণ্ডজ্ঞান যেন তার আশার মেটে হাঁড়িটাকে ভেঙে দিয়েছে। আর তারপর তার কথার শেষে কোনো গোরুব মতো সে ডুকরে ওঠে।
“আচ্ছা আচ্ছা, আমাকে আর গাল দিয়ো না। আমি তোমার ভালোর জন্যেই বলছিলাম,” ছোলাওল৷ জানায়। তার নোংরা ফতুয়াটা নেড়ে-নেড়ে সে ছোলার ওপর থেকে মাছি তাড়ায়।
“ওঃ, কেন-যে মরতে এ-রকম দোরে দোরে হাত পাতবার জন্যে বাড়ি ছেড়ে এলাম,” বুড়ি রুকমনি ঘ্যান ঘ্যান করে, “ওঃ, ভগবান, এই বুড়ো বয়সে আমাকে তুমি ঘরের বার করে দিলে কেন...হায়, কেন...কেন যা-টাকা জমিয়েছিলাম দুপাট্টার আঁচলে বেঁধে রাখিনি...হায়, রাব্বা!”
নিজের কাছেই সে গুঙিয়ে বলতে থাকে, আর তার গায়ে শিহরন খেলে যায় কোমলতার। আর দু-চোখ জলে ভ’রে যায়। আর তার সামনে ধুলোর ঐ আবছায়ায় সে দেখতে পায় বিভীষিকার ছন্দ–বাড়িগুলো সব ভেঙে পড়ছে, কত যে মানুষ টেশে যাচ্ছে, কেউ-বা কাৎরাচ্ছে কেউ-বা জিঘাংসায় চ্যাঁচাচ্ছে; রৌদ্রের ঢেউয়ে সব যেন এক করাল নাচ জুড়ে দিয়েছে তার সামনে, শ্মশানের প্রেতগুলোর মতোই অস্পষ্ট আর বিদেহী—যখনই কোনো শ্মশানযাত্রায় গেছে এদের সামনে সে ভয়ে কুঁকড়ে গেছে।
“রুকমনিআই নি রুকমনিআই!” তোতা ডাক পাড়ে, তাকে ফিরিয়ে আনে নিজের কাছে।
এবার রোদের চিড়চিড় তাপ এসে চড়াও হয় তার ওপর, আরো দরদর ক’রে ঘামতে থাকে সে। তবু, সে যেখানে ছিল সেখানেই গুঁড়ি মেরে ব’সে থাকে, যতটুকু ছটফট করে তা যেন ডিমগুলোর ওপর বসে-থাকা এক মুরগির মতো।
রোদের তাপে তার চোখের তারা পুড়ে যেতে থাকে। দুপাট্টার আঁচল দিয়ে সে তার মুখ মোছে, তারপর এমন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে যেন শতাব্দীর সব দুঃখ বেরিয়ে এল তার বুক থেকে। তারপর সে তার লোহার খাঁচাটার হাতল চেপে ধরে—তার পোষা তোতাটা খাঁচার মধ্যে দাঁড়ের ওপর বসে আছে; তারপর ঝুঁকে কিন্তু
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment