চীন-সম্রাটের প্রাসাদের মতো চমৎকার প্রাসাদ পৃথিবীতে আর একটিও ছিল না। আগাগোড়া মিহি চীনে-মাটির তৈরি, এমনি পাতলা যে, এতটুকু ছুঁলেই বুঝি ভেঙে পড়ে!

বাগানে ছিল দুনিয়ার যত সেরা ফুল। সব চাইতে সুন্দর ফুলগুলোর গায়ে আবার ছোটো-ছোটো রুপোর ঘুন্টি বাঁধা থাকত, তার টুং-টাং শব্দ কানে গেলে ফুলের দিকে একবার না চেয়ে পাশ দিয়ে কারো যাবার উপায় ছিল না। বাস্তবিকই চীন সম্রাটের বাগানের সব কিছু সাজান, গোছান নিখুঁত। তার উপর এত বড়ো বাগান যে মালীরাও জানত না কোথায় তার শেষ। কিন্তু কেউ যদি হাঁটতে হাঁটতে বাগানের সীমানা ছাড়িয়ে যেত, দেখতে পেত তার পরে ঘন বন, তার গাছগুলি কি উঁচু আর তার পরেই সমুদ্র। বন একেবারে সাগরতীর অবধি নেমে গেছিল, সে সাগরের জল কি গভীর, কি ঘন নীল! বড়ো-বড়ো জাহাজগুলি বনের গাছতলার কাছ ঘেঁষে ভেসে যেত। গাছের ডালপালার মধ্যে একটি নাইটিঙেল পাখি থাকত। সে পাখি এমনি মধুর সুরে গান গাইত যে রাতে যখন জেলেরা মাছ ধরার জাল নিয়ে বেরুত, সে সুরের রেশ কানে গেলেই, হাজার কাজ ফেলে তারা চুপ করে দাঁড়িয়ে গান শুনত।

পৃথিবীর সব দেশ থেকে ভ্রমণকারীরা সম্রাটের রাজধানীতে আসত, শহর, প্রাসাদ, বাগান, যা দেখত তারই সুখ্যাতি করত। কিন্তু যেই না তারা নাইটিঙেল পাখির গান শুনত, অমনি সবাই একবাক্যে বলত, "এই হল সবার সেরা জিনিস।" দেশে ফিরে গিয়ে তারা ঐ পাখির গল্প করত আর যে-সমস্ত পণ্ডিতরা শহর, প্রাসাদ, বাগানের গুণগান করে বই লিখত, তারাও বলত ঐ পাখির কোনো তুলনা নেই। সাগরতীরের সেই বনের নাইটিঙেল পাখির বিষয়ে কবিরা সব অপূর্ব কবিতা রচনা করত।

সে-সব বই পৃথিবীর সব দেশে যেত; এমনি করে একটি বই একবার চীন সম্রাটের হাতেও এল। সম্রাট সে বই পড়ছেন তো পড়ছেন-ই, পড়ছেন আর ঘন ঘন মাথা নাড়ছেন। বইতে তাঁর শহরের, প্রাসাদের, বাগানের যা উচ্ছসিত প্রশংসা, সম্রাট পড়ে আহলাদে আটখানা। কিন্তু শেষের দিকে একটি কথা পড়ে তিনি তো অবাক! বইতে লিখেছে, 'কিন্তু সেখানকার সব. জিনিসের সেরা জিনিস হল ঐ নাইটিঙেল পাখি।'

সম্রাট বললেন, "এ আবার কি মাথা-মুণ্ডু লিখেছে! নাইটিঙেল আবার কি? এমন কথা তো শুনিও নি, জানিও নি! আমার সাম্রাজ্যে-শুধু তাই কেন, আমারই বাগানে—এমন পাখি আছে, অথচ আমি সে কথা কখনো শুনি নি! বাস্তবিকই বই পড়ে কিছু কিছু শেখা যায়!”

অতএব প্রধানমন্ত্রীর ডাক পড়ল। তিনি এমনি হোমরা-চোমরা ব্যক্তিবিশেষ যে, সাধারণ লোকে তাঁর সঙ্গে কথাই বলতে পেত না। যদি-বা সাহস করে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করত, তাঁর একমাত্র উত্তর ছিল, "দুঃস্!” তাকে তো আর কিছু উত্তর বলা চলে না।

সম্রাট বললেন, "শুনছি নাকি এখানে নাইটিঙেল নামে এক আশ্চর্য পাখি আছে; আমার গোটা সাম্রাজ্যে তার গানের মতো মূল্যবান জিনিস নাকি আর কিছু নেই! তার কথা আমাকে বলা হয় নি কেন?"

প্রধানমন্ত্রী তো অবাক! “সে কি কথা! আমি তো কস্মিন্ কালে তার নামও শুনিনি; সে তো কখনো রাজসভায় হাজিরা দেয় নি যে জানব।"

সম্রাট বললেন, "আমার ইচ্ছা আজ সন্ধ্যাবেলায় সে আমার কাছে এসে গান শোনাক! আমার কি আছে না আছে সারা পৃথিবীর লোকে জানে, অথচ আমিই জানি না!” প্রধানমন্ত্রী বললেন, "কি জানি আমি তো তার বিষয়ে কিছুই শুনি নি। খুঁজে দেখব, পাবও নিশ্চয়।”

কিন্তু পাবেটা কোথায়? প্রধানমন্ত্রী এখানকার সিঁড়ি বেয়ে ওঠেন, ওখানকার সিঁড়ি বেয়ে নামেন, এখানে সভাঘরে দেখেন, ওখানে দালানে দেখেন, কত লোকের সঙ্গে দেখা হয়, কেউ নাইটিঙেলের নামও শোনে নি। অগত্যা সম্রাটের কাছে ফিরে গিয়ে বললেন, "ঐ লোকটা আগাগোড়া বানিয়ে লিখেছে। বইয়ে যা কিছু লেখে জাঁহাপনা যেন তা সব বিশ্বাস না করেন, কারণ তার অনেকখানিই স্রেফ মন-গড়া।"

সম্রাট বললেন, "তা বললে হবে কেন? যে বইতে ও কথা লেখা আছে, সে বই মহামান্য জাপান-সম্রাট আমাকে পাঠিয়েছেন, কাজেই কথাটা মিথ্যা হতে পারে না। মোট কথা আমি নাইটিঙেলের গান শুনতে চাই, তাকে আজ সন্ধ্যায় এখানে উপস্থিত হতে হবে, না হলে সভাসুদ্ধ সক্কলকে বেত মারা হবে।"

বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী। আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠলেন, সিঁড়ি বেয়ে নামলেন,। সভাঘর দেখলেন, দালান

দেখলেন। সঙ্গে সঙ্গে সভার অর্ধেক মানুষও দৌড়োদৌড়ি করতে লাগল, কারণ বেত খাবার শখ একজনেরও ছিল না। সেই আশ্চর্য নাইটিঙেল পাখি সম্বন্ধে কত প্রশ্নই-না করা হল; আশ্চর্যের বিষয় যে দুনিয়াসুদ্ধ সবাই তার কথা বলে আর সভার কেউ কিছু জানে না!

অবশেষে রান্নাঘরে একটা বেজায় গরিব ছোটো মেয়ের সঙ্গে তাদের দেখা হল। সেই মেয়ে বলল, "আরে হ্যাঁ, হ্যাঁ, ও পাখি আমার খুব চেনা। আহা, কি মিষ্টি গান গায়! রোজ সন্ধেবেলা আমি এখানকার পাত-কুড়নি নিয়ে যাই আমার রুগ্ন মায়ের জন্য। মা থাকে সমুদ্রের ধারে। ফেরবার সময় ছোটো বনটাতে একটু জিরিয়ে নিই আর সেই সময় নাইটিঙেল পাখির গান শুনতে পাই, শুনে আমার চোখে জল আসে!"

প্রধানমন্ত্রী বললেন, “শোন, শোন, পাকশালের দাসী, আমাদের যদি নাইটিঙেল পাখির কাছে নিয়ে যেতে পার, রান্নাঘরে তোমাকে ভালো চাকরি পাইয়ে দেব। ওকে যে আজ সন্ধ্যায় রাজসভায় হাজিরা দিতে হবে।”

তার পর তারা সবাই মিলে যে বনে নিত্যি নাইটিঙেল গান গাইত, সেখানে গিয়ে উপস্থিত হল। সঙ্গে গেল রাজসভার অর্ধেক লোক। যাবার পথে একটা গোরুকে হাম্বা-হাম্বা করে ডাকতে শোনা গেল। তাই শুনে রাজসভার ছোকরা অনুচররা বলে উঠল, "ঐ যে! শেষটা সত্যি পাওয়া গেল! কিন্তু অতটুকু জানোয়ার এমনি জোরে ডাকে! কোথায় যেন আগে শুনেছি এইরকম ডাক!"

পাকশালের ছোট্টো দাসী বলল, "না, না, ও তো গোরুর ডাক, এখনো ঢের পথ বাকি।”

পুকুরে ব্যাঙ ডাকছিল।

রাজসভার প্রধান পুরোহিত বললেন, "আহা, ঐ তো! ঠিক যেন মন্দিরে ছোটো-ছোটো ঘণ্টা বাজছে!"

পাকশালের ছোট্টো দাসী বলল, "আজ্ঞে না, ও তো ব্যাঙ, তবে আর বেশি দেরি নেই।”

তার পর নাইটিঙেল পাখি গান ধরল।

ছোটো দাসী বলল, "ঐ তো, শোন, শোন!” গাছের ডালে বসা ছোট্টো একটা ছাই রঙের পাখিকে দেখিয়ে বলল, "ঐ-যে ঐখানে!"

প্রধানমন্ত্রী বললেন, "এ-ও কি সম্ভব? এমন আমি ভাবতে পারিনি! কি সাদা-সিধে চেহারা। হোমরা-চোমরা এত লোক দেখে হয়তো রং বদলেছে!"

পাকশালের ছোট্টো দাসী ডেকে বলল, "ওগো, ছোটো নাইটিঙেল, আমাদের মহানুভব সম্রাটের বড়ো ইচ্ছা তুমি তাঁকে গান শোনাও।”

নাইটিঙেল বলল, “খুব খুশি হয়েই শোনাব।” এই বলে এমনি মধুর সুরে গাইতে লাগল যে, শুনে সবাই মুগ্ধ হল।

প্রধানমন্ত্রী বললেন, "শুনে মনে হয় যেন কাঁচের ঘণ্টা বাজছে। আহা, দেখ দেখ, ঐ অতটুকু গলাটি কেমন নড়ছে! আগে কখনো ওর গান শুনি নি, এ কি অদ্ভুত ব্যাপার! সভা জমাবে ভালো!"

নাইটিঙেল বলল, "সম্রাটকে আরো গান শোনাব?” ও ভেবেছিল ওঁদের সঙ্গে বুঝি সম্রাটও আছেন।

প্রধানমন্ত্রী বললেন, "হে মহিমাময়ী নাইটিঙেল, আমি আপনাকে আজ সন্ধ্যাকালে রাজসভার এক বিশেষ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করতে এসেছি, সম্রাট আপনার গান শুনলে বড়োই আনন্দ লাভ করবেন।"

নাইটিঙেল বলল, "কিন্তু সবুজ গাছপালার মধ্যে আমার গান আরো ভালো শোনায়।” তবু সম্রাটের ইচ্ছার কথা শুনে খুশি হয়েই সে ওঁদের সঙ্গে চলল।

সুসজ্জিত প্রকাণ্ড সভাঘরে সম্রাট বসেছেন, ঘরের মাঝখানে নাইটিঙেল পাখির জন্য সোনার দাঁড় প্রস্তুত। সভাসদরা সকলে উপস্থিত। পাকশালের ছোট্টো দাসীও দরজার পিছনে দাঁড়াবার অনুমতি পেয়েছে; এখন কি না সে পদ পেয়েছে, উপাধি পেয়েছে, পাক-পরিচারিকা হয়েছে!

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion