যব খেত জাগে
উর্দু থেকে অনুবাদ: কমলেশ সেন
আমি যদিও কৃষক নই, কিন্তু কৃষকদের মধ্যে থাকার সুযোগ আমার জীবনে অনেক ঘটেছে। আমার শৈশব এবং কৈশোর কৃষকদের মধ্যেই কেটেছে। কৃষকদের প্রতিদিনকার জীবনের সঙ্গে জড়িত যে-সব কাজ—যেমন হাল চালানো, নিড়াই করা ধান বোনা, ফসল তোলা, এসব তাদের কাছে থেকেই আমি জেনেছি। খেতে-খামারে যারা কাজ করে, তাদের প্রতি যে ভালোবাসা, সেই ভালোবাসা আমাকে ভারতীয় কৃষকরাই শিখিয়েছে। প্রকৃতির প্রতি যে ভালোবাসা এবং স্বতন্ত্র পরিবেশে থাকা এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার যে বাসনা আমার অধিকাংশ গল্পে আপনারা পেয়েছেন, তা আমি কৃষকদের কাছ থেকেই পেয়েছি। তাদের সঙ্গে থাকার জন্যেই, তাদের ওপর যে সমস্ত অত্যাচার চলে, তা আমি নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছি। আর বর্তমান জীবন-ব্যবস্থা পুরোনো জীবন-ব্যবস্থার সঙ্গে গাঁটছাড়া বেঁধে যেন তাদের ওপর পাথরের মতো চেপে বসে আছে। একেক সময় মনে হয়, আমি নিজেই তাদের ঘাড়ের ওপর এই জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছি। কারণ গ্রামের যে শাসকশ্রেণী, সেই শাসক শ্রেণীরই আমি একজন সন্তান। আমার মনে হয়, বর্তমানে যা কিছু ঘটে চলেছে, এর জন্যে আমার বাবা-ই দায়ী। দায়ী আমার বাবার বন্ধুরা এবং তাদের বন্ধুরা। অন্যদিকে কৃষক এবং কৃষকের ছেলে-মেয়েরাই ছিল আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাদের বাড়ির দরজা আমার জন্যে ছিল সর্বদাই উন্মুক্ত। কিন্তু আমাকে থাকতে হত আমার উচ্চবর্গ বাবার কাছে। সে জন্যেই কৃষকদের জীবনকে আমি দু-দিকের দুটি দরজা দিয়ে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি। পেরেছি, তার কারণ, আমি তাদের জীবন দেখতে চেয়েছিলাম। আর দেখতে বাধ্য ও হয়েছি।
শোষণের এই যে ধারা, তা শুরু হয় এক দরজা থেকে আর শেষ হয় গিয়ে আর এক দরজায়। আর আমি এই শোষণের ধারার শুরু থেকে অন্ত পর্যন্ত চোখ মেলে দেখতাম। সে সময় যে-জিনিসটা আমি বুঝতে পারতাম না, তা হচ্ছে নৈতিকতার দুটি সাম্প্রতিক রূপ, যার একটি সৃষ্টি করেছে অভিজাত বর্গ আর অন্যটি কৃষকরা। অভিজাতদের দামী এবং ভালো কাপড়-জামার প্রয়োজন, আর কৃষকদের এসবের কোন প্রয়োজন নেই, কারণ ভালো জামাকাপড় পরলে তারা মর্যাদাশীল হয়ে উঠবে। আমাদের বাড়িতে এবং অন্যান্য অভিজাতবর্গের বাড়িতে প্রতিটি মানুষ দিনে দু-তিনবার ভর-পেট আহার করত, কিন্তু কৃষকরা যদি দিনে দু-তিনবার আহার করত, তবে তা অন্যায় বেআদপী বলে মনে করা হত। কারণ তাতে তাদের স্বভাব খারাপ হয়ে যাবে এবং সেবা করার যে মনোবৃত্তি তা আর থাকবে না। কেউ শ্রম দিলে, সেই শ্রমের বিনিময়ে তার মজুরী পাওয়া অবশ্যই উচিত। কিন্তু আমরা তাদের বেগার খাটিয়ে নিতাম।
আমাদের অভিজাতবর্গের ঘরে মা-বোনের ইজ্জত আছে। তাদের খুব সম্মান করা হয়। আমাদের এলাকার তহসিলদার হিন্দু। হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও সে তার স্ত্রীকে পর্দানশীন করে রেখেছিল। কিন্তু কৃষকদের মা বোন এবং স্ত্রীদের বেইজ্জত করা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার।
আমি আমার কিশোর বয়সে একজন রাজা সাহাবকে দেখেছি। সে যখন তার জমিদারী পরিদর্শনে বের হত, এবং যে-সব গ্রামে যেত, সেই সব গ্রামের কিসান আর তাদের মেয়ে-বৌ এবং শিশুদের বেঁধে আনত। পুরুষ আর মেয়েদের পৃথক পৃথক সারিতে দাঁড় করাত। পুরুষদের জুতো দিয়ে পেটাত, আর মেয়েদের পাঠিয়ে দিতো সারা রাতের জন্যে তার কর্মচারীদের তাবুতে। এ দৃশ্য নিজের চোখে দেখেছি একবার নয়, অজস্রবার। আর না জানি এ দৃশ্য কল্পনায় কতবার প্রত্যক্ষ করেছি।
এসব আমার শৈশবের ঘটনা। আমার এক কংগ্রেসী বন্ধু বলেন, চণ্ডিগড় ছাড়িয়ে সিমলা যাওয়ার পথে আজও এমন অনেক গ্রাম আছে, যেখানে জলের প্রচণ্ড অভাব। এখানে দেহাতি মেয়েদের জলের জন্যে জঙ্গলের ঝরণায় যেতে হয়। আর এই জঙ্গল এক পাহাড়ি ঘাঁটির ওপর অবস্থিত। এই পাহাড় আর জঙ্গলের ভার যাঁর ওপর আছে তিনি একজন বিরাট উচ্চপদস্থ অফিসার। তাই ঝরণার জলে তেষ্টা মেটানোর জন্যে মেয়েদের উপঢৌকন দিতে হয় তাদের সতীত্ব—তাদের ইজ্জত। আর এই উচ্চপদস্থ অফিসার হচ্ছেন একজন কংগ্রেসী পত্রিকার এডিটরও। তাঁর পত্রিকাতেই এই খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। এই ঘটনা পড়ে মনে হয়, কৃষকদের ওপর যে অত্যাচার চলে আসছে, তা এতটুকু কম হয়নি। আর কৃষকদের এই যে সমস্যা, সেই সমস্যা সারা ভারতবর্ষে কমবেশী একই রকম। যুগ যুগ ধরে তাদের ওপর চলছে অত্যাচার। ইংরেজরা এ দেশে আসার আগেও ছিল, তাদের সময়েও ছিল, পরেও তেমনি চলছে। আমাদের কৃষকদের ওপর যারা অত্যাচার চালিয়ে আসছে, তাদের সঙ্গে কৃষকদের ঘনিষ্ঠতা খুবই কম। এই অত্যাচারীদের তারা জীবনভর ঘৃণা করে। কারণ যারা তাদের ওপর অত্যাচার করে আসছে, আগেও তাদের হৃদয় ছিল মূক; আজও তেমনি দয়া-মায়াহীন। তাই তাদের যখন বলা হয়, ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ চলে গিয়েছে, এখন ফুর্তি কর, তখন কিন্তু তাদের চোখ আনন্দ আর খুশিতে জ্বলজ্বল করে ওঠে না। স্বাধীনতার যে আবেগ, সেই আবেগ তো আপনার থেকেই সৃষ্টি হয়।
কৃষকদের ওপর এই যে অত্যচার, সেই অত্যাচারের রূপ এত গভীরভাবে প্রোথিত দৃঢ় এবং সংগঠিত যে, এর শিকড়মূল হাজার হাজার বছর অতীত পর্যন্ত প্রসারিত। যাঁরা শহরে থাকেন, তাঁরাও কৃষকদের ওপর এই অত্যাচারকে আনন্দের সঙ্গেই সমর্থন করেন। নৈতিকতা সম্পর্কে এই যে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, তা শহরেও অগোচর নয়। এমন বহু মানুষ আছেন, যাঁরা এই অত্যাচারকে অন্যায় বলে মনে করেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা কৃষকদেরও দোষারোপ করেন। তাঁদের ধারণা কৃষকরা মুর্খ বেকুব পশু এবং নিষ্কর্মা। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে এবং জাগরণের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই—নেই বলে তাদের এরকম ব্যবহার করা হয়। কারা তাদের মুর্খ করে রেখেছে, কারা তাদের বোকা আর বেকুব বানিয়ে রেখেছে, কারা তাদের সভ্যতার সমস্ত অগ্রগতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে? এসবের অনুসন্ধান করার সাহস তাঁদের মোটেই নেই।
যদি আমরা সত্যি সত্যি আমাদের জীবন এবং সমাজকে সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরপুর করতে চাই, তবে অবশ্যই আমাদের এসব কারণের অনুসন্ধান করার জন্যে সাহসী হতে হবে। অত্যাচারের সেইসব রূপকেও দেখতে হবে, যা দু-এক বছর থেকে নয়, যুগ যুগ ধরে কৃষকদের ওপর চলে আসছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, আমরাও কৃষকদের ওপর এই অত্যাচারকে দেখতে চাই না। অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্যে কোনরকম সৃজনশীল ভূমিকা নিই না, কৃষকদের সমস্যা সমাধানের জন্যে কোমরকম মদতও দিই না। কিন্তু কৃষকরা যখন চারদিক থেকে তাদের ওপর সংগঠিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিজেরাই উপায়হীন ভাবে নিজেদের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করে,—‘নিজেদের জমি ভিটেমাটি মা-বোন এবং স্ত্রীর ইজ্জত রক্ষা করার জন্যে উঠে দাঁড়ায় এবং যখন এই অত্যাচারের হাত থেকে নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্যে পথ খুঁজে বের করে, তখন তাদের ওপর জুলুম কায়েম রাখার জন্যে তাদের গ্রামে পাঠিয়ে দিই পুলিস আর মিলিটারি। আমরা দাঁড়িয়ে থেকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাঁক করে দিই তাদের ঘর-বাড়ি আর ফসল। আর তাদের ওপরই দোষারোপ দিই, তারা হিংসাত্মক কার্যকলাপ করছে। যারা গুলি করছে আর গ্যাস ছাড়ছে, দিনরাত বল আর হিংসার আশ্রয় নিচ্ছে, পুলিস আর ফৌজ পাঠাচ্ছে, তাদের মুখ থেকে এই দোষারোপ মোটেই শোভা পায় না।
‘যব খেত জাগে’-তে কৃষকদের এই নতুন আন্দোলনকে আমি কাহিনীতে লিপিবদ্ধ করেছি—যে আন্দোলন অন্ধ্রের মাটিতে অঙ্কুরিত হয়েছে। এর আগেও কৃষকরা নিজেদের অধিকারের জন্যে লড়াই করেছে, কিন্তু সেই লড়াই-এ তারা শহরের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোন সম্পর্ক তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু এবার অন্ধ্রে এবং দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন যেভাবে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে, তা শহরের মানুষের কাছে এবার সহানুভূতি পেয়েছে। এই সহানুভূতি পেয়েছে, তার সবচেয়ে বড় কারণ এবার সমাজের সবচেয়ে অগ্রণী অংশ শ্রমিক
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment