রোজই ওকে মিলের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখি। বছর বারো বয়স, মুখে বসন্তের দাগ, রোগা, কালো ছেলেটি। রোজই ও মিলের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়। সকালবেলা হাজিরা ডাকার সময়ে, বিকেল বেলা জলখাবার খাওয়ার সময়ে, সন্ধ্যেবেলা মিল থেকে বাড়ি ফেরবার সময়ে ওকে আমি দেখি। চাকরির খোঁজে ও এখানে আসে না কারণ ও অন্ধ। আর এই দেশে চক্ষুষ্মান লোকেরাও চাকরি পায় না, অন্ধদের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক্। অন্ধদের পক্ষে সব চেয়ে উপযুক্ত জীবিকা হল ভিক্ষে করা।

কিন্তু এই ছেলেটি বেশ চালাকচতুর। ওকে আমি কখনো ভিক্ষে করতে দেখিনি। ওর গলার স্বর সরু কিন্তু চমৎকার গাইয়ে-গলা। হাতে সব সময়ে এক তাড়া গানের বই আর মিলের সামনে দাঁড়িয়ে এই বইগুলো ও এক-এক আনা দামে বিক্রি করে। বই বিক্রি করবার সময়ে নতুন নতুন সিনেমার গান গেয়ে শোনায়; এই গানগুলো মিলের মজুরদের খুবই প্রিয়।

আমি সিনেমা দেখতে ভালবাসি। প্রত্যেকেই ভালবাসে। প্রথমত, সারা দিন এমন হাড়ভাঙা খাটুনি যে সারা গা ব্যথায় টন টন করে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও মাইনে এত কম যে কোন দিকেই কুলিয়ে ওঠা যায় না। দিনের পর দিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও এতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করবার মত সামর্থ্য আমাদের নেই। কাজে কাজেই প্রত্যেকেই চায় তাড়ি গিলতে বা সিনেমায় যেতে। আমি তাড়ি ছুঁই না, কিন্তু সিনেমায় যে যাই তা অস্বীকার করি না। সিনেমায় দেখি, মেয়ে এবং পুরুষ চটকদার বেশভূষা পরে গাড়ি চেপে ঘুরে বেড়ায় আর প্রেমে পড়ে। সেখানে সবাই দিবারাত্রি প্রেম করে বেঁড়াচ্ছে। যাকেই দেখা যাক্ না কেন, হয় সে প্রেমে পড়েছে বা পড়তে যাচ্ছে বা প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে ভাবি, এই লোকগুলো কাজ করে কখন, কখনই বা এরা মিলে যাবার সময় পার আর এই মাগগিগণ্ডার বাজারে এমন ফুরফুরে জামাকাপড়ই বা এরা পায় কি করে! আর এমন বাবুয়ানি চালে দিন কাটাবার টাকা এদের আসে কোথা থেকে সে হিসেবও আমার মাথার ঢোকে না। আমরা তো সাত জন্ম চেষ্টা করেও এত টাকা জমাতে পারব না।

এ ছাড়া কথা আছে। সিনেমায় আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমি দেখেছি—ধনীরা গরীবদের সঙ্গে প্রেম করে, মালিকের ছেলের প্রেমিকা মজুরের মেয়ে, মালিকের মেয়ে মজুরের ছেলের প্রেমের কাঙ্গালিনী। শেষকালে মালিকরা পর্যন্ত টাকাপয়সার মমতা ত্যাগ করে সমাজসেবী হয়ে যায়। আমার ভারি ইচ্ছে করে কেউ আমাকে বলে দেয় কোথায় গেলে এমন সব মালিক ও মালিক-দুহিতার সাক্ষাৎ পাওয়া যেতে পারে। বাস্তবে দেখি, ফোরম্যানরা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে বন্ধুভাবে কথা বলাটা মর্যদা-হানিকর মনে করে। তবুও স্বীকার করতে হবে যে সিনেমা হচ্ছে চমৎকার একটা ফুর্তি—আর সে জন্যে খরচ মাত্র চার আনা।

তাহলেও প্রত্যেকটি সিনেমার বই যে দেখা হয়ে ওঠে তা নয়। এমন প্রায়ই হয় যে ভালো ভালো ছবি এসে চলে গেল কিন্তু চার আনা পয়সা পর্যন্ত নেই। যতবার এরকম হয় আমরা অন্ধ ছেলেটির কাছ থেকে ছবির বইটা কিনে নিই, ওর মুখে গানগুলো শুনি আর তারপর গুন গুন করে নিজেরাই গাইতে থাকি। এক আনার এই বা মন্দ কি।

আমাদের জীবনে এত বেশি শূন্যতা যে যখনই এতটুকু আশার আলো আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ঝিলিক দিয়ে বেরিয়ে যায় আমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি এই আশার আলো কোনদিন কি আমাদের কাছে ধরা দেবে না? এমন দিন কি আসবে না যেদিন এ মধুর ঝিলিক্-টুকু আমাদের কুটিরপ্রাঙ্গণে প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে? এই প্রাণোচ্ছল সুর আমাদের জীবনের গান হয়ে বেজে উঠবে কবে? কাজ করতে করতে এই সব কথা আমরা ভাবি আর স্বপ্নের জাল বুনি। ফোরম্যান এসে গালাগালি দেয় আর ভেঙে চুরমার হয়ে যায় আমাদের স্বপ্ন, কল্পনার সেই সুন্দর জাল ভাঁজ হয়ে হয়ে কোথায় অদৃশ্য হয় যেন—আমাদের স্বপ্ন ও মনপ্রাণ চিরদিনের মতই আবার নিরাবরণ হয়ে পড়ে।

আর এই জন্যেই একদিন আমরা হরতাল করে বসলাম। লাল ঝাণ্ডার লোকেরা আগেও কয়েকবার এসেছিল কিন্তু আমি ওদের ইউনিয়নে এখনো যোগ দিইনি। সারা দিন আমি কাজ করতাম। সন্ধ্যার সময় কোন কোন দিন যেতাম সিনেমায়, বাড়ি ফিরতাম কোন একটা সিনেমার গান গুন গুন করে গাইতে গাইতে। বাড়ি ফিরে শুকনো রুটি খেতাম আর এই শুকনো রুটি যে আমার কপালে জোটে সেজন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুয়ে পড়তাম। ক্রমে একদিন চালডালের দাম হল আকাশছোঁয়া, যে কয়লা আমাদের নিত্য প্রয়োজন তা একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল কালোবাজারে। মনে হল যেন আমার মজুরী চারগুণ কমে গেছে।

পেটে সর্বক্ষণ খিদে জ্বলে, ছেলেমেয়েগুলোর পরণে ছেঁড়া জামাকাপড়, ঘরভাড়া পর্যন্ত দিতে পারি না। সিনেমায় যাওয়া ঘুচে গেছে। আগে সিনেমার পুরনো গানগুলো গুন গুন করে গাইতাম, এমনও হয়েছে যে দু-একটা গান মাঝে মাঝে নিজেই বানিয়েছি। ভারি ভালো লাগত। কিন্তু এখন আমার শুকনো ঠোঁটে স্বর বেরোয় না। পুরনো গানও গুন গুন করে গাইতে পারি না, নতুন গানও বানাতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, সেই যে সিনেমার মিলমালিকের মেয়ে, যে নাকি একটি মজুরের প্রেমে পড়েছিল, সে যদি এখন আমার সামনে এসে সপ্রেম ভঙ্গিতে দাঁড়ায় তাহলে কী মজাই না হয়। কিন্তু এসব ঘটনা বাস্তব জীবনে ঘটবার জন্যে নয়। আমাদের মিলের মালিকের মেয়ে বাপের সঙ্গে দেখা করতে এসে মোটরে চেপে বেরিয়ে যায়। যেতে যেতেও আমাদের দিকে একটিবারের জন্যেও ফিরে তাকায় না। ওটুকু হলেও বরং আমরা একবার গেয়ে উঠতে পারতাম: ‘দো নয়নো মে নয়নো মিলায়!’—এটা একটা সিনেমার গান।

সুতরাং কারখানার মজুররা যেদিন হরতাল করবার জন্য ভোট নিল, আমিও তাতে যোগ দিলাম। হরতাল করাটা মোটেও একটা আয়াসের ব্যাপার নয়। যে লোকটাকে অনবরত কাজ করতে হয় তাকে হঠাৎ যাধ্য হয়ে কাজ বন্ধ করতে হলে সে স্বস্তি বোধ করে না। হরতাল মানেই পেটে কিল মেরে পড়ে থাকা। আমাদের তো আর ব্যাঙ্কে জমানো টাকা নেই যে হরতালের সময়েও আরামে দিন কাটিয়ে দেব।

সবাই বলে, শ্রমিকদের হরতাল করা উচিত নয়, তাদের আরও বেশি কাজ করা উচিত, আরও বেশি কাপড় বোনা উচিত। আমরা বলি, বহুত আচ্ছা, আমরা আরও বেশি খাটব, আরও বেশি কাপড় বুনব—ওতে আমরা গররাজি নই। কিন্তু যতই আমরা কাপড় বুনি না কেন, কাপড়ের দাম ততই বেড়ে চলে, মিল মালিকদের ভুঁড়িও ততই বাড়তে থাকে আর আমাদের মজুরিও ততই কমতে থাকে। আরে ভাই, আমাদের কথাটাও তো একটু ভাবা দরকার, না কি? আগে আমরা বড় জোর চার আনা পয়সা খরচ করে একটা সিনেমা দেখতাম, এখন তাও আর পারি না। কী করব আমরা!

তাই আমরা হরতাল করলাম আর হরতালও হল জবরদস্ত। হাতে গোনা যায় এমন কয়েকজন পা-চাটা ছাড়া আর কেউ কাজে গেল না। ভারি ফুর্তি হল আমাদের। চারদিকে পুলিস কিন্তু আমরা মিলের আশেপাশে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে খোসগল্পে মত্ত। অন্ধ ছেলেটি আসে, অন্য দিনের মতই গান গায়। কিন্তু ওর বই আর একটিও বিক্রি হয় না। মিষ্টি সুরেলা গলায় সমস্ত মাধুর্য ঢেলে দিয়ে গান গায় ও কিন্তু তবুও পকেট থেকে কেউ একটি আনি বার করে না। জান তো ভাই, আমরা হরতাল করেছি আর কতদিন এই হরতাল চলবে কেউ বলতে পারে না। একটা আস্ত আনি, চার-চারটে পয়সা। এফ আনার ভুট্টা কিনলে দুপুরের আর রাত্রের খাওয়া হয়ে যায়।

লোকে

Already have account? LOG IN

To continue reading,

subscribe today with our

introductory offers


Unlock the article
or

Existing subscribers

Already have account

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion