পেশোয়ার এক্সপ্রেস
যখন পেশোয়ার স্টেশন ছেড়ে আসি তখন আমি তৃপ্তিতে এক দলা ধোঁয়া উগরে তুলেছিলাম। আমার খোপে-খোপে ছিল সব হিন্দু ও শিখ শরাণার্থীরা। তারা এসেছিল পেশোয়ার, হটিমর্দন, কোহাট, চরসরা, খাইবার, লাণ্ডি কোটাল, বানু নওশেরা, মানশেরা ইত্যাদি সীমান্ত প্রদেশের সব জায়গা থেকে। স্টেশনটা খুব সুরক্ষিত ছিল এবং সেনাবাহিনীর অফিসারেরাও খুব সজাগ ও দক্ষ ছিলেন। তবে, যতক্ষণ-না সেই রোমান্টিক পঞ্চনদীর দেশের দিকে আমি রওনা দিচ্ছিলাম, তারা অস্বস্তিতেই ভুগছিল। অন্য আর-পাঁচজন পাঠানের থেকে অবশ্য এই শরণার্থীদের তফাৎ করা যাচ্ছিল না। তাদের চেহারা ছিল বেশ লম্বা ও সুদর্শন, শক্ত গড়নের হাত-পা, পরনে ছিল কুল্লা ও লুঙ্গি, কারো-বা শালোয়ার। তাদের ভাষা ছিল গাঁয়ের পুশতু, প্রত্যেক খোপে দুজন করে বালুচি সেপাই খাড়া পাহারায় ছিল। রাইফেল হাতে তারা একটু ক’রে হাসি বিলিয়ে যাচ্ছিল হিন্দু পাঠানদের ও তাদের বৌ-বাচ্চাদের দিকে, যারা তাদের হাজার-হাজার বছরের বসবাসের ভূমি ছেড়ে পালাচ্ছিল। এই পাহাড়ি জমি তাদের শক্তি জুগিয়েছে, আর তুষার-ঝরনা তাদের তৃষ্ণা মিটিয়েছে, এবং এই ভূমির রোদ-ঝলমল বাগান থেকে তোলা মিষ্টি আঙুরের স্বাদে ভরে গেছে তাদের প্রাণ। হঠাৎ একদিন এই দেশ-গাঁ তাদের কাছে অপরিচিত হয়ে গেল; শরণার্থীরা, সম্ভবত অনিচ্ছুকভাবেই, পাড়ি দিল গরম ক্রান্তিদেশীয় সমভূমির এক নূতন দেশে। ঈশ্বরের কাছে তারা কৃতজ্ঞ যে তাদের প্রাণ, ধনসম্পত্তি ও মেয়েদের ইজ্জত কোনোরকমে বাঁচিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু রাগে ও দুঃখে হৃদয়ে তাদের রক্তক্ষরণ হচ্ছিল যেন, আর তাদের চোখ যেন সাতপুরুষের ভিটের ঐ গ্র্যানাইট বুকের মধ্যে গর্ত করে খুঁড়ে চলে গিয়ে অভিযোগের প্রশ্ন তুলছিল—‘মা, মাগো, নিজের সন্তানদের কেন এভাবে ফিরিয়ে দিলে? কেন তোমার বুকের উষ্ণ আশ্রয় থেকে নিজের মেয়েদের বঞ্চিত করলে? এইসব নিষ্পাপ কুমারীরা, যারা তোমার অঙ্গে আঙুরলতার মতো জড়িয়েছিল, কেন হঠাৎ তাদের টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিলে, মা, মাগো, কেন মা?’
উপত্যকার মধ্য দিয়ে আমি দ্রুত ছুটছিলাম, আর আমার গাড়িগুলোর মধ্য থেকে এই ক্যারাভানের দল সতৃষ্ণ বিষণ্ণ চোখ মেলে দেখে নিচ্ছিল বিলীয়মান মালভূমি, ছোটোবড়ো উপত্যকা ও তিরতির ক’রে ব’য়ে-যাওয়া আঁকাবাঁকা ছোটো নদী। ঝাপসা চোখের জলে শেষবারের মতো বিদায় জানাচ্ছে যেন। প্রতিটি কোনা-খাঁজড়ে যেন ওদের চোখ সেঁটে-সেঁটে যাচ্ছে, চ’লে যাবার সময়ে বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে যাবে যেন; আমার কেমন যেন মনে হ’লো আমার চাকাগুলো বোধহয় ভারি হ’য়ে উঠেছে, দুঃখে ও লজ্জায় যেন আটকে যাচ্ছে তারা, আর যেন ছোটবার শক্তি নেই আমার, আমি বোধহয় থেমেই পড়বো এবার।
হাসান আবদাল স্টেশনে আরো শরণার্থীরা এলো। ওরা শিখ, পাঞ্জা সাহেব থেকে আসছে, সঙ্গে লম্বা কৃপাণ, ভয়ে মুখ ওদের পাঁশুটে; বড়ো-বড়ো ডাগর চোখের বাচ্চাগুলো পর্যন্ত যেন এক নাম-না-জানা ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে। ওরা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার খোপে ঢুকে পড়ল। এর ঘরবাড়ি সব গেছে, ওকে পালিয়ে আসতে হয়েছে পরনের শালোয়ার-কামিজ মাত্র সম্বল ক’রে, আর একজনের পায়ে কোনো জুতো নেই; ওই কোনার লোকটি এতটাই ভাগ্যবান যে সে তার সবকিছু নিয়ে আসতে পেরেছে, মায় তার ভাঙা কাঠের তক্তপোশটা পর্যন্ত। যার সবকিছু গেছে সে ব’সে আছে শান্ত, চুপচাপ, গুম হ’য়ে, অন্যজন যে কিনা সারাজীবনে একটা পিঠের টুকরোও জোটাতে পারেনি সেও তার হারানো লাখ টাকার গল্প বলছে, আর নেড়েদের শাপশাপান্ত করছে। বালুচি সেনারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে মৃদু-মৃদু হাসছে।
তক্ষশিলায় আমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হ’লো। আমার গার্ডসাহেব স্টেশনমাস্টারকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘আশপাশের গ্রাম থেকে একদল হিন্দু শরণার্থী আসছে। তাদের জন্যে এই ট্রেনটাকে অপেক্ষা করতেই হবে।’ এক ঘণ্টা কেটে গেল। আমার গাড়ির মধ্যেকার লোকজনেরা তাদের পোঁটলা-পুঁটলি খুলল এবং পালিয়ে আসার সময়ে যৎসামান্য যে যা আনতে পেরেছিল তা-ই খেতে আরম্ভ করল। বাচ্চারা হৈ-হল্লা করছিল আর তরুণী মেয়েরা শান্ত গভীর চোখে তাকিয়ে ছিল জানলার বাইরের দিকে। হঠাৎ দূরে ঢাকের আওয়াজ শোনা গেল। হিন্দু শরণার্থীদের এক জাঠা এদিকেই আসছে। জাঠা আরো কাছে এগিয়ে এল, স্লোগান দিতে-দিতে। আরো কিছু সময় কাটল। এবারে দলটা স্টেশনের একেবারে কাছে এসে পড়ল। ঢাকের আওয়াজ আরো জোর হ’লো আর একঝাঁক গুলিগোলার আওয়াজ কানে গেল। ঐ তরুণী মেয়েরা ভয়ে জানলা থেকে সরে গেল। এই দলটা ছিল হিন্দু শরণার্থীদের এক জাঠা—প্রতিবেশী মুসলমানদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে যাদের নিয়ে আসা হয়েছে। প্রতিটি মুসলমানের কাঁধের পরে ঝোলানো রয়েছে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করা এক-একজন কাফেরের মৃতদেহ। এ-রকম মৃতদেহের সংখ্যা ছিল দুশো এবং অত্যন্ত নিরাপদে তাদের স্টেশনে এনে বালুচি রক্ষকদের হাতে দিয়ে দেয়া হলো। মুসলমান জনতা চাপ দিল যে, এই মৃত হিন্দু শরণার্থীদের যথোচিত সম্মানের সঙ্গে হিন্দুস্থানের গেট পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। বালুচি সৈন্যরা নিজেদের কাঁধে এই পবিত্র দায়িত্ব তুলে নিল, এবং প্রত্যেক গাড়ির মধ্যিখানে কয়েকটা ক’রে মৃতদেহ রাখা হ’লো। তারপর মুসলমান জনতা আকাশের দিকে তাগ ক’রে গুলির আওয়াজ করল ও স্টেশনমাস্টারকে আদেশ দিল আমাকে প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে দেবার জন্যে। আমি সবেমাত্র চলতে শুরু করেছি এমন সময়ে কেউ চেন টেনে আমাকে থামিয়ে ফেলল। তারপর মুসলমান জনতার দলপতি একটা গাড়ির কাছে এগিয়ে এসে বললেন যে, ঐ দুশোজন শরণার্থীর চ’লে যাওয়ায় তাঁদের গ্রাম তো গোল্লায় যাবে, ফলে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রেনের থেকে দুশোজন হিন্দু ও শিখ নামিয়ে নিতে হবে; যা-ই হোক না কেন, দেশের জনশক্তির ক্ষতিপূরণ করতেই হবে। বালুচি সৈন্যরা দেশপ্রেমের জন্যে উচ্চকণ্ঠে তাঁদের জয়গান করল, এবং বিভিন্ন বগি থেকে দুশোজন শরণার্থীকে বেছে নিয়ে জনতার হাতে তুলে দিল।
‘সব কাফেররা সার দিয়ে দাঁড়াও!’ ওদের নেতা হুঙ্কার দিল; ঐ নেতাটি আশপাশের গ্রামের এক শাঁসালো সামন্ত প্রভু। শরণার্থীরা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল, ম’রে জ’মে গেছে যেন। জনতা কোনোমতে ওদের একটা সারি করে দাড় কবিয়ে দিল। দুশো লোক...দুশো জীবন্ত মৃতদেহ...নগ্ন ভয়ে মুখগুলো সব নীল...চোখের তারায় বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে রক্তলোলুপ তীর...
বালুচি সৈন্যরাই শুরু করল।
পনেরো জন শরণার্থী টলমল পায়ে শ্বাস টানতে টানতে মরে পড়ে গেল। এই জায়গাটা ছিল তক্ষশিলা।
আরো কুড়িজন পড়ল।
এখানেই ছিল এশিয়ার মহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে হাজার-হাজার বছর ধরে লক্ষ-লক্ষ ছাত্রেরা মানুষের সভ্যতা বিষয়ে তাদের প্রথম পাঠ নিয়েছে।
আরো পঞ্চাশজন মুখ থুবড়ে পড়ল মরে।
তক্ষশিলার জাদুঘরে সুন্দর-সুন্দর মূর্তি ছিল, অলংকারের অতুলনীয় কারুকৃতি দুর্লভ শিল্প ও ভাস্কর্যের নিদর্শন, আমাদের গর্বের সভ্যতার ছোটো ছোটো উজ্জ্বল সব দীপশিখা।
তবুও আরো পঞ্চাশটি প্রাণ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল।
এ-সবের প্রেক্ষাপটে ছিল সিরকপের রাজপ্রাসাদ, খেলাধুলোর জন্য এক গৌরবান্বিত ও মহান এক নগরীর ধ্বংসাবশেষ।
আরো তিরিশজন মৃত।
এখানে রাজত্ব করতেন কনিষ্ক। তাঁর রাজত্বে প্রজাদের ছিল শান্তি, সমৃদ্ধি আর এক সাধারণ ভ্রাতৃত্বের বোধ।
তারা আরো কুড়িজনকে মেরে ফেলল!
এই গ্রামগুলোতেই একদিন বুদ্ধের সেই মহান সংগীতের গুঞ্জন শোনা যেত ৷ ভিক্ষুরা এখানেই ভেবেছিলেন প্রেমের আর সত্যের আর সৌন্দর্যের কথা আর এক নতুন ধাঁচের জীবনের কথা।
এবং এখন সেই দুশো জনের শেষ কয়েকজন মাত্র তাদের অন্তিম লগ্নের জন্যে অপেক্ষা করছে।
ইসলামের বাঁকা চাঁদ প্রথম এখানকার দিগন্তেই তার আলো দিয়েছিল, সাম্যের, ভ্রাতৃত্বের ও মানবিকতার প্রতীক...
সবাই এখন মৃত। আল্লা-হো-আকবর!
প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে গেল, এবং এত কাণ্ডের পরে যখন আমি আবার রওনা দিলাম আমার মনে হলো যে, এমনকী আমার নিচেকার লোহার চাকাগুলো পর্যন্ত যেন পিছলে পিছলে যাচ্ছে।
মৃত্যু স্পর্শ করেছে আমার সবকটা বগিকেই। মৃতদের শোয়ানো হয়েছিল মাঝখানে,
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment