সংস্কৃতিকেন্দ্র ঢাকা : তখন ও এখন
বাঙলাদেশ জ্বলছে। জ্বলছে ঢাকা শহর, এখনকার বাঙলাদেশের রাজধানী শুধু জ্বলেনি, অনেক পরিমাণে নিশ্চিহ্ন। যেমন বাঙলাদেশের আর সব গ্রামে ও শহরে তেমনি পূর্ববঙ্গের এই ইতিহাস প্রসিদ্ধ সংস্কৃতিকেন্দ্র ঢাকায়ও হানা দিয়েছে মনুষ্যত্বহীন বিবেকবুদ্ধি বর্জিত মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত রক্তচক্ষু শাসকের নরখাদক বাহিনী। ঢাকা এখন ধ্বংসস্তূপ, লড়াই চলেছে এখানে-সেখানে। নির্জন পথঘাটে শ্মশানের স্তব্ধতা।
এই ঢাকা শহরেই জন্মেছিলাম, কাটিয়েছি শৈশব থেকে যৌবনের বেশ কিছু সময় পর্যন্ত। কখনো ভাবিনি ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হবে। খাওয়া-দাওয়া শস্তা, লেখা-পড়ার সুযোগ পর্যাপ্ত, বারো মাসে তেরো পার্বনের ঢেউ। ঢাকা শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রও নিশ্চয়। ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি ঢাকায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণ ছেলেদের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের উদ্বোধন, শরীরচর্চা খেলাধুলোর মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবোধকে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা। শিক্ষার সঙ্গে স্বদেশ চিন্তা অঙ্গাঙ্গীভাবে মিলেমিশে ছিল, আলাদা করে দেখার উপায় ছিল না। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধকে জিইয়ে রাখবার জন্যে বাঙলাদেশকে দু-ভাগ করতে চেয়েছিল তৎকালীন বৃটিশ শাসক। কিন্তু প্রবল আন্দোলনের ফলে ১৯০৫ সনের বঙ্গবিভাগ রদ হলেও পূর্ব-বাঙলার মুসলমান সমাজের জন্য কতকগুলো সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখা হলো ঢাকা শহরে। ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই সুযোগ-সুবিধার নিদর্শন। বৃটিশ সরকার ভেবেছিল কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্যে আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা থাকলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ অব্যাহত থাকবে। অথচ শেষ পর্যন্ত ফল হলো অন্য রকম। ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মৈত্রীর সৌধ হয়ে দাড়িয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয়েছিলেন বাঙলাদেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী ও মনীষীবৃন্দ।
আমার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছরের ছাত্রজীবন এখন সুবর্ণ যুগের একটি অধ্যায় বলে মনে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গিয়েছে, চতুর্দিকে দুর্যোগের ঘনঘটা। সাহিত্যচর্চায় আগ্রহ ছিল, রাজনীতি সম্পর্কেও সচেতন হয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে, মাঠে, গাছের নিচে ছাত্রদের সাহিত্য ও রাজনীতির আলোচনা। টেররিস্ট যুগের অবসানের পর ঢাকার রাজনীতি তখন নতুন মোড় নিয়েছে, দেশের যুবশক্তি ক্রমশই মার্কসবাদের দিকে ঝুঁকেছে, নতুন উদ্দীপনা আর আলোড়ন প্রত্যেকের মনে। সাহিত্য যারা ভালোবাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি এবং পাঠাগারের আকর্ষণ তাদের কাছে ছিল দুর্নিবার। দেশী-বিদেশী অনেক পত্র-পত্রিকা হাতের কাছেই পাওয়া যেত। বিরাট হলঘর, ছাত্ররা বসে বসে পড়ছেন, কোথাও শব্দ নেই। ছাত্ৰাবাসগুলো ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি : ঢাকা হল, জগন্নাথ হল, সলিমুল্লা হল। প্রতিটি হল থেকে একটি করে বার্ষিকী প্রকাশিত হতো ছাত্র এবং অধ্যাপকদের রচনায় সমৃদ্ধ হয়ে। আমি সে-সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যে-সময় কৃতী অধ্যাপকের সংখ্যা অনেক। কলা বিভাগে ছিলেন মোহিতলাল মজুমদার, মহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রফুল্ল কুমার গুহ, সুশীল কুমার দে প্রভৃতি। বিজ্ঞান বিভাগে স্বনামধন্য জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ এবং অধ্যাপক সত্যেন বসু। আরো যাঁরা তরুণ অধ্যাপক তাঁদের মধ্যে অমলেন্দু বসু, আশুতোষ ভট্টাচার্য, জসীম উদ্দীন, অমিয় কুমার দাশগুপ্ত, পরিমল রায়। হরিদাস ভট্টাচার্য, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, দেবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বিভিন্ন শাস্ত্রের বিভাগীয় প্রধান। এঁদের মধ্যে অধিকাংশই পরবর্তীকালে উচ্চতর পদমর্যাদায় ভূষিত হয়েছিলেন। তিরিশের শেষাশেষি বামপন্থী রাজনীতির ঢেউ এসে লাগল ঢাকা শহরে। তার প্রভাব দেখা দিল সাহিত্যেও। একদল তরুণ লেখকের উদ্যোগে স্থাপিত হলো ‘প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত একটানা দশ বছর এই সঙ্ঘের কর্মোদ্যোগ ব্যাপকতা লাভ করেছিল। ১৯২৮-২৯ সনে ঢাকায় আধুনিক সাহিত্য আন্দোলন ছিল প্রধানত বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্ত সম্পাদিত ‘প্ৰগতি’ মাসিক পত্রকে অবলম্বন করে। ‘প্রগতি’র লেখক গোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের প্রভাব এড়িয়ে ভিন্নতর দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টিতে উৎসাহী হলেও এই গোষ্ঠীর কোনো লেখকই রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন সাহিত্য আন্দোলনের সামিল হননি। ‘প্রগতি’র লেখকরা ছিলেন মোটামুটিভাবে বিশুদ্ধ শিল্পের সমর্থক, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, অজিত দত্ত প্রমুখের তৎকালীন রচনায় যার নিদর্শন। বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, জীবনানন্দ লেখা পাঠাতেন বরিশাল থেকে।
ঢাকায় প্রগতি লেখক
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment