আমি আমার খাঁচা বন্ধ করেছি, আমার ছোটভাইয়ের খাঁচা বন্ধ করে দিয়েছি, মা-র খাঁচাও বন্ধ। রাত হলে এই তিন খাঁচা বন্ধ হয়ে যায়। ঘরকে আমি খাঁচা বলে ভাবি, কেন এমন ভাবি জানি না। খাঁচা বন্ধ না-হলে সমূহবিপদ আমার ছোটভাই বেরিয়ে যেতে পারে, আমার মা কেঁদে আহাজারি তুলতে পারে। রাতে, অন্ধকারে, ঘর ছেড়ে কেউ গেলে কিংবা বিরান মাঠ, এবড়োথেবড়ো রাস্তায় দৌড়াতে শুরু করলে তাকে ধরে আনা কঠিন। একা তো সম্ভব নয়, লোকজন ডাকতে হয়, অন্ধকার রাত হলে লণ্ঠন নিতে হয়, চাঁদনী হলে তবু কিছুটা সুবিধা। আমার ছোটভাইকে ফেরত নিয়ে এলেও মার আহাজারি থামে না। তিনি নালিশ জানিয়ে বিলাপ করতে থাকেন। এই বিলাপের লক্ষ্য আমার বাবা, তিনি জান্নাতবাসী এই বিলাপের লক্ষ্য আল্লাহ, তিনি অদৃশ্যের বাসিন্দা। এই বিলাপের লক্ষ্য পাড়াপ্রতিবেশী, তারা ছোটাছুটির পর এতক্ষণে ঘুমিয়ে এবং এই বিলাপের চূড়ান্ত লক্ষ্য আমি: বাবার মতো আমি জান্নাতবাসী নই, আল্লাহর মতো আমি অদৃশ্য নই, পাড়াপ্রতিবেশীর মতো ঘুমন্ত নই। আমাকে সব সহ্য করতে হয়। আমার পক্ষে সহ্য করা সবসময় অসম্ভব হয়ে ওঠে। মনে হয় ছোটভাইটিকে মেরে ফেলি, মনে হয় মা-র গলা টিপে ধরি, মনে হয় কতকিছু। তারপর মাপ চাই ইচ্ছাটার জন্যে, কার কাছে জানি না। কল্পনার হত্যা এবং বাস্তবের হত্যার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। সেই ছাত্রজীবনে পড়া, কোনো বিদেশী নাটকের অংশ: হত্যার রক্ত হাত থেকে কিছুতেই মুছে যায় না। আমি হাতের দিকে চেয়ে থাকি, হাতে রক্তের দাগ কর রেখার মতো: আমার নিয়তি। নিয়তির বিরুদ্ধে আমি কতদিন যুদ্ধ করতে পারব?


আমার ভাই ফাত্তা অন্যকে, অন্যদের বিশ্বাস করে। অন্যকে, অন্যদের বিশ্বাস করা তার স্বভাব। বিশেষ করে সেধরনের অন্য কিংবা অন্যরা যারা স্বপ্ন দেখতে শেখায়। যেমন দেশটা বদলে দেয়া, দেশের মানুষের ভাগ্য বদলে দেয়া। ফাত্তা লোকজন জড়ো করে এসব শোনাতে ভালোবাসে। আমি দেখেছি চায়ের দোকানে, স্কুলের মাঠে, হাটবার হাটের মধ্যে ফাত্তা লোকজন নিয়ে বসে আছে। মানুষ প্রেম, ঘৃণা, লোভ, দুঃখ, সুখ এবং ভয়ের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকে। সেখানে কেউ যদি সবকিছু বদলে দেবার কথা বলে তখন অসম্ভবের জন্য তৃষ্ণা জাগে। ফাত্তার কথাবার্তার মধ্যে হয়তো সেধরনের কিছু আছে। তুমি বুঝবে না। তুমি বুর্জোয়া। আমি বলেছি, আমি ঘর-সংসার দেখি, জমিজমা দেখি। সেজন্য তুমি এসব করে বেড়াতে পার।

ফাত্তার হাসি থামে না। হাসির তোড়ে বাড়িঘর বোধহয় উড়ে যায়। আমি যদি বুর্জোয়া হই ফাত্তা তাহলে বিপ্লবী। ফাত্তা সবকিছু বদলাতে চায়, আমি সবকিছু ধরে রাখতে চাই। এই হচ্ছে ডায়ালেকটিকস। আমার হাসি পায়, গমকে-গমকে হাসি মুখ ফুড়ে বার হতে থাকে। এক সহোদর বুর্জোয়া, অন্যজন বিপ্লবী: আমি হাসতে থাকি। মা পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, কী হয়েছে?

আমি বলি, হাসছি।

মা বিব্রত হয়ে বলেন, তোদের মাথায় ছিট আছে।

মা-র কথাই ঠিক হয়। এক সন্ধ্যায় চাঁদ উঠেছে। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় গ্রামটা বদলে গেছে। গাছপালা হলদে হয়ে গেছে, স্কুলের মাঠটা রূপালি, আর বড় পুকুরটায় মাছের বুড়বুড়ি সোনালি ঢেউ ছড়িয়ে দিয়েছে। চাঁদের সেই হলদে রূপালি সোনালি আভার মধ্যে ফাত্তা হাতে একটা দড়ি নিয়ে দৌড় দিয়েছে। আমি কাছারি ঘরের সামনে শেফালি গাছটার পাশে চেয়ারে বসে গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলছি আর ফাঁকে ফাঁকে চাঁদটার দিকে চেয়ে দেখছি। ফাত্তা দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে উন্নয়নের জোয়ার এসেছে। গাছপালা, ঘরবাড়ি, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ভেসে যাবে। শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে, নয়তো ভেসে যাবে সবকিছু। ফাত্তা ছুড়ে ছুড়ে চাঁদটাকে বাঁধতে চাচ্ছে আর চিৎকার করছে।

আমি এবং আমার সঙ্গের লোকজন ফাত্তাকে ধরে নিয়ে আসি। মা-র কথাই ঠিক হয়। গ্রামের

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion