ছেলেটা গেল কই! যে দিনকাল পড়িয়াছে তাহাতে যে আসিবার সে যদি আসিতে এক প্রহরও বিলম্ব করে তবেই ভাবনা হয়। দুশ্চিন্তার তো কোনো মাথামুণ্ডু নাই, শুধু একবার আরম্ভ হইলেই হইল। হয়তো কাল খবরের কাগজ খুলিয়াই দেখিব পুলিশের গুলিতে নিহত তরুণ অথবা কলোনির মাঠের মধ্যে গলাকাটা মৃতদেহ প্রাপ্তির নিয়মিত সংবাদের পাতায় ছেলেটার নাম। সত্যিই, ছেলেটা গেল কোথায়! তিনদিন আগেই উহার ফিরিয়া আসার কথা। কিন্তু আজও পর্যন্ত পাত্তা নাই।

বাঙলাদেশ শরণার্থীদের জন্য রিলিফের মাল লইয়া দিনকয়েক হইল সে কৃষ্ণনগরের পথে সীমান্তের দিকে গিয়াছে। একাজ সে নতুন করিতেছে না। গত দুই মাস ধরিয়া ছেলেটাকে আমি এই কাজই করিতে দেখিতেছি। আজ আগরতলা, কাল বনগাঁ, পরশু কৃষ্ণনগর—কখনও সে শরণার্থী শিবিরে বাঁশের মাথায় ত্রিপল বাঁধিতেছে, কখনও কলেরার ইনজেকশন দিতেছে, কখনও বা চিড়া গুড় লইয়া ছুটাছুটি করিতেছে। এমন অনায়াসে, এমন অনুত্তেজ চোখে মুখে ছেলেটা এই কাজ করে যে দেখিলে মনে হইবে আবহমানকাল ধরিয়া ও এই কাজই করিয়া চলিয়াছে। মনে হইবে রিলিফের কাজের জন্যই ও জন্মিয়াছে আর ভবিষ্যতে ও রিলিফ দিয়াই যাইবে।

আসলে মাসকয়েক আগেও ছেলেটা ছিল কেরানি। ওর দশটা পাঁচটা অফিসের জীবনে ভূমিকম্প আনিয়া দিল বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। কিছু একটা করা দরকার এইরকম একটা মানসিক তাগিদে কিছুদিন ও কখনও থ্রি নট থ্রি, বুলেটের ব্যর্থ সন্ধানে, কখনও পেটি পেটি ডিনামাইট সংগ্রহের স্বপ্নে ছুঁচা-বাজির মতো ছটফট করিয়া শেষপর্যন্ত ক্লান্ত, হতাশ হইয়া দিনকয়েক গুম হইয়া বাড়িতে বসিয়া রহিল। তারপর যখন প্রতিদিন হাজারে হাজারে শরণার্থী সীমান্ত পার হইয়া আসিতে শুরু করিল তখন একদিন হঠাৎ ‘দূর শালা! লোকগুলো মরে গেলে ফিরে গিয়ে লড়বে কে’—বলিয়া ছেলেটা সোজা আসিয়া উঠিল সহায়ক সমিতির অফিসে! সেই যে কাজে হাত লাগাইল আর আসে নাই। কিন্তু বাহাত্তর ঘণ্টা পার হইয়া গেল সীমান্ত হইতে ফিরিয়া আবার মাল লইয়া অন্যত্র যাইবার কথা অথচ ছেলেটা এখনও ফিরিল না। আশ্চর্য!

* * * * *

চতুর্থদিন সন্ধ্যায় সে ফিরিল। পান চিবাইতে চিবাইতে, গুনগুন করিয়া সুর ভাঁজিতে ভাঁজিতে সে ফিরিয়া আসিল। চোখে মুখে তিলমাত্র লজ্জা বা সঙ্কোচের চিহ্ন নাই। যেন এইরকমই কথা ছিল। দেখিয়া আমার হাড়পিত্তি জ্বলিয়া গেল। বেশ রুষ্ট স্বরেই জিজ্ঞাসা করিলাম—‘এতদিন কোথায় ছিলে?’ পা নাচাইতে নাচাইতে ছেলেটা জবাব দিল—‘শ্বশুরবাড়িতে।’

যতদূর খবর রাখি ছেলেটার স্ত্রী ও কন্যা রানাঘাটে উহার শ্বশুরবাড়িতে আছে। ছেলেটার দাঁত বাহির করা দায়িত্বজ্ঞানের বহর দেখিয়া জ্বলিয়া উঠিলাম—‘এটা কি শ্বশুরবাড়ি যারার সময়?’

হঠাৎ ও দপ করিয়া নিভিয়া গেল। কাতর কণ্ঠে বলিল—‘মাইরি বিশ্বাস করুন দাদা মেয়েটাকে একটু দেখতে গিয়েছিলাম। অমন দৃশ্য চোখের সামনে দেখলে আপনিও নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন না। আপনিও ছুটে গিয়ে আপনার মেয়ের নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখতেন তার নিশ্বাস পড়ে কিনা, গায়ে হাত দিয়ে আপনিও নিশ্চিত হতে চাইতেন তার ধমনীতে প্রাণস্রোতের প্রমাণ পেয়ে।’

নিশ্চিত প্রাণস্রোত ও ধমনী—ছেলেটার মুখে এই অস্বাভাবিক সাধু শব্দের উচ্চারণে চমকিয়া উঠিলাম। বুঝিলাম ও যাহা বলিতেছে তাহার মধ্যে সত্য ছাড়া একবর্ণ মিথ্যা নাই। মানুষের প্রকৃতিই এই। দারুণ বেদনায় নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি দাড়াইলে সে সাধু ভাষায় কথা বলে। মরণকে বলে ‘স্বর্গারোহণ’, বাবাকে বলে ‘পিতা’ মাকে ‘জননী’। সে ভাষা তাহাকে আয়ত্ত করিতে হয় না, সে পায়। মনকে ভারমুক্ত করিবার তাগিদ সেই দুর্লভ ভাষা তাহার কণ্ঠে জুটাইয়া দেয়।

বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম—‘তার মানে?’

অতঃপর ছেলেটা যে কাহিনী বলিল তাহাই হারামজাদির উপাখ্যান।

* * * * *

বিশ্বাস করুন ক্যাম্পে মালপত্তর নামিয়ে দিয়ে এক মুহূর্তও দেরি করিনি। হেঁটেই ফিরছিলাম। বাজারের কাছে এসে বাস ধরব। ক্যাম্প থেকে কিছু দূরে গাছ তলায় একটা চায়ের দোকানে এক গেলাস চা খেয়ে আবার

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion