[১৯৫৪ সালে প্রকাশিত ‘নানা লেখা’ সংকলন থেকে গোর্কির দুটি রচনা পুনর্মুদ্রিত করা হল। লেখাদুটিতে সংক্ষেপিত ছাপার ভুলগুলি শুদ্ধ করে নেওয়া হয়েছে, বানান ও যতিচিহ্নের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে। ‘ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে’ এই শিরোনাম আমাদেরই দেওয়া।—সম্পাদক,  পরিচয় ]

সংস্কৃতি
ফ্যাসিবাদের ধ্বংসাত্মক আক্রমণ হইতে সংস্কৃতিকে রক্ষা করাই প্যারিসের লেখক-মহাসম্মেলনের মূল লক্ষ্য বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে। ধরিয়া লওয়া হইয়াছে, আধুনিক বুর্জোয়া সংস্কৃতির সত্যকার অন্তর্নিহিত বস্তুটি কি, তাহা সমস্ত প্রতিনিধিই একইভাবে বুঝিবেন এবং ইহা লইয়া কোনো মতভেদ হইবে না। কিন্তু সত্যই কি তাই?

বুর্জোয়া সংস্কৃতির অবস্থা আজ ক্ষয় ও ভাঙনের অবস্থা। ফ্যাসিবাদ এই বুর্জোয়া সংস্কৃতিরই সৃষ্টি, বুর্জোয়া সংস্কৃতির ওপর সে এক ক্যানসারের স্ফীতি। ফ্যাসিবাদের তাত্ত্বিকেরা ও প্রয়োগকর্তা সেই সব ভাগ্যান্বেষীরা, বুর্জোয়াশ্রেণী নিজের মধ্য হইতে যাহাদের সৃষ্টি করিয়াছে। ইতালি ও জার্মানিতে বুর্জোয়ারা ফ্যাসিস্তদের হাতে রাজনৈতিক ও কায়িক ক্ষমতা তুলিয়া দিয়াছে। ইতালীয় শহরগুলির মধ্যযুগীয় বুর্জোয়ারা ভাড়াটিয়া সৈন্যদলের পরিচালকদের ম্যাকিয়াভেলীসুলভ ধূর্ততার সহিত নিয়ন্ত্রণ করিতেন, প্রায় সেই ধূর্ততার সহিতই জার্মানি ও ইতালির বুর্জোয়ারা ফ্যাসিস্তদের নিয়ন্ত্রণ করিতেছেন। ফ্যাসিস্তদের হাতে শ্রমিকদের উচ্ছেদসাধনকে তাহারা শুধু খুশি মনেই উৎসাহ দেয় নাই, লেখক ও বিজ্ঞানীদের শাস্তি দিতে ও দেশ হইতে তাড়াইয়া দিতেও ফ্যাসিস্তদের তাহারা বাধা দেয় না। অথচ ইহারাই তাহাদের মানসশক্তির প্রতিনিধি, এই সেদিন পর্যন্তও যাহারা ছিল তাহাদের গর্ব ও দম্ভের বস্তু।

আর-একটি বিশ্বযুদ্ধের সাহায্যে নূতনভাবে ‘দুনিয়া বাটোয়ারা’র জন্য সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের মনে যে ইচ্ছা জাগিয়াছে, সেই ইচ্ছাপূরণের জন্ম ফ্যাসিবাদ এই তত্ত্ব প্রচার করিয়াছে যে, সমস্ত জগৎকে ও অন্য সমস্ত জাতিকে শাসন করিবার অধিকার আছে জার্মান জাতির। ইহা ফ্রিডরিক নিটশের বিকৃত মনের সৃষ্টি ‘শ্বেত জানোয়ার’-এর শ্রেষ্ঠত্বের সেই বহুবিস্মৃত তত্ত্ব। ভারতীয়, ইন্দোচীনা, মেলানেশিয়ান, পলিনেশিয়ান, নিগ্রো প্রভৃতি জাতিগুলি লাল চুল ও সাদা মাথাওয়ালা জাতিদের দ্বারা শাসিত হইতেছে—এই ঘটনা হইতেই এই তত্ত্বের সৃষ্টি। অস্ট্রীয় ও ফরাসী বুর্জোয়াদের পরাজিত করিয়া জার্মান বুর্জোয়ারা যখন ব্রিটিশ, ডাচ ও ফরাসী বুর্জোয়াদের ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনে ভাগ বসাইবার ইচ্ছা পোষণ করিতে শুরু করিল, তখনই এই তত্ত্বের বিকাশ হয়। সমগ্র দুনিয়ার উপর শ্বেত জাতির প্রতিযোগীহীন কর্তৃত্বের অধিকারের তত্ত্ব হইতেই প্রত্যেক জাতীয় বুর্জোয়া দল শুধু সমস্ত কৃষ্ণাঙ্গ জাতিকে নহে, নিজেদের শ্বেতাঙ্গ ইয়োরোপীয় প্রতিবেশীদের পর্যন্ত বর্বর বলিয়া মনে করিতেছে এবং বর্বর বলিয়াই তাহাদের পদদলিত রাখা অথবা ধ্বংস করার কথা চিন্তা করিতেছে। ইতালি ও জাপানের বুর্জোয়াশ্রেণী ইতোমধ্যেই এই তত্ত্বকে কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করিতে শুরু করিয়াছে; ‘সংস্কৃতি’র আধুনিক ‘ধারণা’র মধ্যে এই তত্ত্বটির একটি বিশেষ বাস্তব স্থান রহিয়াছে।

বুদ্ধিজীবীদের অতি-উৎপাদন ঘটিয়া গিয়াছে, শিক্ষাকে সীমাবদ্ধ করিতে হইবে, ‘অন্তরায়’ সৃষ্টি করিতে হইবে সংস্কৃতির বিকাশের পথে, যন্ত্রপাতির সংখ্যা পর্যন্ত বাড়িয়া গিয়াছে এবং হস্তশিল্পে ফিরিয়া যাইবার দিন আসিয়াছে—ইয়োরোপীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা তারস্বরে এই কথাগুলি ঘোষণা করিতেছেন। তাঁহাদের কণ্ঠস্বরের তীব্রতা ক্রমেই বাড়িতেছে। ইয়র্কের আর্কবিশপ বোর্নমাউথের একটি স্কুলের উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলিয়াছেন, “আমি দেখিতে চাই, সমস্ত আবিষ্কার বন্ধ হইয়া গিয়াছে। যদি আমি ‘ইন্টার্নাল কমবাস্শন ইঞ্জিন’ তুলিয়া দিতে পারিতাম, তবে নিশ্চয়ই তাহা দিতাম।” তাঁহার মর্যাদাচ্যুত পেশার সহযোগী ক্যান্টারবেরীর আর্কবিশপ যন্ত্রের প্রয়োজন স্বীকার করিয়াছেন, কারণ তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ প্রচার করিতেছেন এবং বিশেষজ্ঞেরা বলিতেছেন আগামী যুদ্ধ হইবে ‘যন্ত্রের যুদ্ধ’। খ্রীস্টের লন্ডন ও রোমের পার্থিব প্রতিনিধিদের এই বক্তৃতাগুলি এবং অনিবার্য সামাজিক বিপর্যয়ের আতঙ্কে অথবা শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি ঘৃণায় উন্মাদ যে-বুর্জোয়ারা সাংস্কৃতিক বিকাশ রোধের জন্য প্রচার চালাইতেছেন তাঁহাদের বক্তৃতাগুলি, যদি ধরুন, ১৮৮০ সালে প্রদত্ত হইত, তাহা হইলে বুর্জোয়ারাই এই বক্তৃতাগুলিকে মূঢ়তার নিদর্শন ও বর্বরতার যুগে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান বলিয়া আখ্যা দান করিত।

আজ যখন বুর্জোয়াশ্রেণীর চোখে সাহস ও লজ্জাহীনতার মধ্যে কোনো পার্থক্যই নাই, তখন মধ্যযুগে প্রত্যাবর্তনের আহ্বানকেই বলা হইতেছে ‘দুঃসাহসী

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion