এক শতক আগে, বার্লিনে, ১৯১৫ সালের ২৫ নভেম্বর, আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ করেন। তারপর অনেক বছর পর্যন্ত খুব কমসংখ্যক পদার্থবিদ এটা বুঝতে পারতেন। তবুও ১৯৬০ সাল থেকে, পরবর্তী বিতর্কিত দশকগুলোতে অধিকাংশ সৃষ্টিতত্ত্ববিদগণ অসম্পূর্ণ বর্ণনা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বকেই কৃষ্ণ-গহ্বরসহ পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব ব্যাখ্যার সবচেয়ে ভালো তত্ত্ব হিসেবে বিবেচনা করতেন।

এবং এখনো, তাঁর প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব (থিওরি অফ ন্যাচারাল সিলেকশন), মৌলের পর্যায় সারণি, (দ্য পেরিওডিক টেবল অব দ্যা এলিমেন্টস), এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের তরঙ্গ-কণা’র দ্বৈততার মতো বিজ্ঞানের সাড়া জাগানো বিষয়গুলো অনেকে সহজে বুঝলেও গুটিকয় বিশেষজ্ঞ ছাড়া খুব কমসংখ্যক মানুষ সাধারণ আপেক্ষিকতা বোঝে। কিন্তু কথা হচ্ছে যে, তবুও কেন আইনস্টাইন এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সবচেয়ে উদ্ধৃত (এবং ভুলভাবে উদ্ধৃত) বিজ্ঞানী? কেন তিনি আইজাক নিউটন বা স্টিফেন হকিং-এর তুলনায়ও এগিয়ে? স্রেফ প্রতিভার জন্যই কী তাঁর এই বিশ্বজনীন খ্যাতি-জনশ্রুতি?

আইনস্টাইনের খ্যাতি প্রকৃতপক্ষে খুবই রহস্যময়! যখন তিনি ১৯৩১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ আপেক্ষিকতা সম্পর্কে বক্তৃতা দেন, তখন অ্যাকাডেমিক শ্রোতাদের ঢল নামে। এক পর্যায়ে তাঁর দুর্বোধ্য গণিত এবং জার্মান বুঝতে না পেরে শুধুমাত্র গুটিকয় বিশেষজ্ঞ ছাড়া বাকি সবাই হল ছেড়ে পালিয়ে বাঁচেন। বক্তৃতা শেষে একজন ক্লিনার এসে তাঁর আঁকিবুকি করা গাণিতিক সমীকরণগুলো ব্ল্যাকবোর্ড থেকে মুছে দেয়। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন একটি ব্ল্যাকবোর্ড মুছে যাওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায় এবং পরে তা অক্সফোর্ড-এর বিজ্ঞানের ইতিহাস জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়।

১৯৩১ সালের ৩০ জানুয়ারি চার্লি চ্যাপলিনের চলচ্চিত্র ‘সিটি লাইটস’-এর প্রিমিয়ার শো হয়। লস এঞ্জেলেস থিয়েটার হলে আয়োজিত ওই শোতে চ্যাপলিনের ব্যক্তিগত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সস্ত্রীক আইনস্টাইন। একদিকে চার্লি চ্যাপলিন, অন্যদিকে সস্ত্রীক আইনস্টাইন! ফলে দর্শক-শ্রোতার ঠাসাঠাসি ভিড় হয়। তাদের উন্মাদনা সামলাতে হিমসিম খেতে হয় পুলিশকে। এক পর্যায়ে টিয়ার গ্যাস ব্যবহারের হুমকিও দিতে হয়। আইনস্টাইন এবং চ্যাপলিন হাজির হওয়ামাত্র তাঁদের সম্মানে উঠে দাঁড়ায় সবাই। চিৎকার চেঁচামেচি করে তারা তাদের ভালোবাসা এবং উল্লাস প্রকাশ করে। হট্টগোলের মধ্যেই আইনস্টাইন চ্যাপলিনের কাছে বিষয়টি বুঝতে চাইলেন, জিজ্ঞেস করলেন, সবাই এত উত্তেজিত কেন? চ্যাপলিন আইনস্টাইনকে বললেন, তারা আমাকে দেখে উল্লাস প্রকাশ করছে, কারণ, তারা সবাই আমাকে বুঝতে পারে; এবং তারা তোমাকে দেখেও উল্লাস প্রকাশ করছে, কারণ, তারা কেউই তোমাকে বুঝতে পারে না!’

১৯৪০ সালে আইনস্টাইন তাঁর একজন জীবনীলেখককে বলেন, আমি এই বিষয়টি কিছুতেই কখনোই বুঝতে পারিনি, আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ধারণাগত জটিলতা, সমস্যা এবং এর সাথে ব্যবহারিক জীবনের কোনো সংযোগ না থাকা সত্ত্বেও, কেমন করে তা জনসাধারণের বিস্তৃত অঙ্গনে এতটা জীবন্ত ও প্রাণবন্তভাবে ছড়িয়ে পড়লো... আমি এখনও এই প্রশ্নের একটি সত্যিকারের বিশ্বাসযোগ্য উত্তর কারো কাছ থেকেই শুনি নি...’ একইভাবে তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছিলেন, আমাকে কেউ-ই বুঝতে পারে না, তবু কেন সবাই আমাকে এখনো এত পছন্দ করে?

এটা নিশ্চিতভাবেই স্বীকার করতে পারি যে, আইনস্টাইনের খ্যাতির পেছনে তাঁর প্রথম জীবনের কৃতিত্বের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে তাঁর ১৯০৫ সালের আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের কৃতিত্ব; কোনো পূর্ব-কৃতিত্ব ছাড়াই যেটি তিনি করেছিলেন। অনেকটা নিউটনের মতো (কিন্তু চার্লস ডারউইনের মতো নয়) আইনস্টানের পরিবারে এমন কেউ ছিলেন না, যাকে আমরা তাঁর প্রেরণা বা আদর্শ হিসেবে মনে করতে পারি। এছাড়া স্কুল-কলেজে পড়াশোনা অবস্থাতেও আইনস্টাইন খুব একটা ‘ভালো ছাত্র’ ছিলেন, এমন কথা কেউ কোনোদিন বলেনি (যেমনটা ম্যারি কুরি); বরং জানা যায়, স্নাতকের পর তিনি আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে পারেননি। এমনকি তিনি তাঁর সমসাময়িক বিজ্ঞানপরিমণ্ডল বা বিজ্ঞানীমহলেরও অংশ ছিলেন না; প্রতিষ্ঠিত কারো সাথেই তাঁর যোগাযোগ ছিল না। বেশিরভাগ সময়ই তিনি নিঃসঙ্গ পথচারী, একা একাই কাজ করতেন। ১৯০৫ সালে তাঁকে আমরা দেখতে পাই একজন সাদামাটা সাধারণ সংগ্রামী মানুষ হিসেবে; যিনি একটি নবজাত সন্তানের পিতা—জীবিকার জন্য যুদ্ধ করে চলেছেন—যাপন করছেন স্রেফ ছকেবাঁধা নিছক কেরানির জীবন! যা-ই হোক, আমরা আপেক্ষিকতাকে যেভাবেই উপলব্ধি করি না কেন, এটা যে এক অনন্য প্রতিভাধরের প্রতিভার অনিবার্য বিস্ফোরণ ছিল, এতে আমাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

আইনস্টাইনের খ্যাতির আরও অনেকগুলো কারণ ছিল। পদার্থবিদ্যার মতো রসকষহীন বিষয়ের পন্ডিত হয়েও রাজনীতি এবং জায়নবাদ ও ধর্মসহ বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয়ে তিনি উল্লেখযোগ্যভাবে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৩৩ সাল থেকেই তিনি নাৎসি জার্মানির তীব্র সমালোচক এবং প্রকাশ্য বিরোধিতাকারী হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পান। এবং ১৯৩৯ সালে পরমাণু বোমা তৈরির ব্যাপারে তাঁর ব্যক্তিগত সাহায্য-সহযোগিতা-সমর্থন, এবং ১৯৫০ সালে হাইড্রোজেন বোমা এবং ম্যাককার্থিজম-এর বিষয়ে তাঁর খোলামেলা সমালোচনা (যে কারণে তাঁকে এফবিআই ও জে এডগার হুভারের গোপন তদন্তের শিকার হতে হয়)। এছাড়া ১৯৫২ সালে ইসরায়েলের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁকে মনোনীত করার ঘটনাকেও আমরা স্মরণ করতে পারি।

এটা স্পষ্ট যে, সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিয়ে ধাঁধায় পড়লেও আইনস্টাইনের পরবর্তী উড়নচণ্ডী জীবন এবং সাহসী পদক্ষেপের কারণে সাধারণ মানুষসহ অনেকেই তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। তাঁর গুণমুগ্ধ মনীষী বা্রট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, ‘আইনস্টাইন শুধুমাত্র এক মহান বিজ্ঞানী ছিলেন না, তিনি একজন মহান মানুষ ছিলেন।’ জ্যাকব ব্রনোস্কি বলেছিলেন,‘নিউটন যদি ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বর হন, তবে নিউ টেস্টামেন্টে সেই তিনিই আইনস্টাইন... যিনি মানবতাপূর্ণ, সমব্যথী এবং এক বিরাট সহানুভূতিপূর্ণ হৃদয়ের অধিকারী।’

আর্থার সি ক্লার্ক এটা বিশ্বাস করতেন যে, ‘আইনস্টাইন হচ্ছেন অনন্য প্রতিভা, মানবতাবাদী, শান্তিবাদী এবং প্রথা-বিরোধিতার অপূর্ব সংমিশ্রণ...’ এ কারণেই তিনি ‘সবার কাছে এত গ্রহণযোগ্য, এত প্রিয়, এবং এ কারণেই লাখ লাখ মানুষ তাঁকে ভালোবাসে।’ রিচার্ড ডকিন্স নিজেকে ‘আইনস্টাইনের জুতার ফিতা বাঁধারও অযোগ্য’ মনে করে বলেছেন, ‘আমি সানন্দে তাঁর চমৎকার ঈশ্বরবিহীন আধ্যাত্মিকতার অনুগামী হই।’

একইসঙ্গে নিঃসঙ্গ প্রতিভা, ব্যক্তিগত সততা, এবং গণআন্দোলনে সক্রিয় সম্পৃক্ততাÑএমন সংমিশ্রণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিরল। যখন কেউ সংবাদমাধ্যম এবং জনসাধারণের সঙ্গে আইনস্টাইনের জীবনব্যাপী উপহার হিসেবে তাঁর সুরসিক বিদগ্ধতার কথা বলে, তখন তাঁর এই অনন্য এবং অটল খ্যাতি আমার কাছে ধাঁধা বলে মনে হয়। কে না জানে আপেক্ষিকতা নিয়ে তাঁর সেই বিখ্যাত সরস সারমর্ম: ‘একজন সুন্দর মেয়ের সাথে পার্কের বেঞ্চে বসে একঘণ্টা কাটালেও মনে হবে মাত্র এক মিনিট; কিন্তু একটি গরম চুলার উপর এক মিনিট বসলেই মনে হবে এক ঘন্টা!’ সবশেষে, আমার নিজের প্রিয় উক্তি দিয়ে শেষ করছি : ‘কর্তৃপক্ষকে অবমাননার অভিযোগে শাস্তি হিসেবে ভাগ্য আমাকেই আমার কর্তৃপক্ষ বানিয়েছে!’


মূল: অ্যান্ড্রু রবিনসন

[আইনস্টাইন : অ্যা হান্ড্রেড ইয়ার্স অব রিলেটিভিটি অ্যান্ড জিনিয়াস,অ্যা ভেরি শর্ট ইন্ট্রুডাকশান-এর লেখক]

তর্জমা: মাহফুজ জুয়েল, কবি ও সাংবাদিক

বিজ্ঞানপাঠ

ছবি: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রসূত

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion