আন্তন চেখফ
রুশ দেশ ও রুশ জাতির সঙ্গে আমার কালের বাঙালীদের অনেকেরই পরিচয় করিয়েছে রুশ সাহিত্য। আর শুধু রুশিয়ার নয়, নিজেদের সঙ্গেও আমরা তাতে পরিচিত হয়েছি। আসলে পরিচিত হয়েছি মানুষের সঙ্গে, আর মানুষের জীবন-সত্যের সঙ্গে। সব সাহিত্যেরই এই ব্রত। রুশ সাহিত্যে সে ব্রত সার্থকভাবে পালন করতে পেরেছে বলেই আমরা অনুবাদে পড়া রুশ-সাহিত্যের নামেও পাগল হতাম। তাই আজও আমরা শুধু লেনিনের নামেই রুশিয়ার সম্মুখে প্রীতি ও শ্রদ্ধাভরে দাঁড়াই না, দাঁড়াই তার রুশ সাহিত্যিকদের নামেও। চেখফ তেমনি একটি নাম।
একটা প্রশ্ন তবু আছে—রুশ-জীবনের এই পরিণতির কী আভাস ছিল চেখফ-এর গল্পে নাট্যে? একথা তো জানি এবং অনুভব করতে পারি—সেদিনের রাজনৈতিক দল ও মতবাদ সম্বন্ধে চেখফ ছিলেন উদাসীন; অন্তত চেখফ-এর সাহিত্যিক মেজাজ ছিল মতবাদ সাহিত্যের বিরোধী। চেখফ-এর সাহিত্যের সঙ্গে তৎকালীন রুশ-জীবনের সম্পর্ক কি, এ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা পরিষ্কার করে নিলে সাহিত্যের সত্য ও সমাজ-সত্য সম্বন্ধে ধারণাও আরও স্পষ্ট হবার কথা।
জীবন-কথা
“সেই তরুণটিকে নিয়ে একটি গল্প লেখ,—বাপ ছিল যার ভূমি-দাস, পরে দোকান-কর্মচারী। ছিল যে গির্জার ছোকরা-গাইয়ে, বিদ্যালয়ের ছাত্র—আমলাতান্ত্রিক সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে যে ছাত্রটি উঠেছিল বেড়ে। যাকে শেখানো হয়েছিল পাদ্রির হাতে চুমো খেয়ে তাকে পুজো করতে, অন্যের মতামত নির্বিচারে মেনে নিতে আর প্রতিটি রুটির টুকরোর জন্য কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে উঠতে। দিনের পর দিন চাবুক পড়ছে পিঠে, খালি পায়ে যায় স্কুলে, মারপিট করে অন্য ছেলেদের সঙ্গে; জীবজন্তুর উপর চালায় সে নিষ্ঠুর পীড়ন—আর ধনী আত্মীয়দের বাড়ি খাবার জন্য যার দারুণ লোলুপতা। ঈশ্বর ও মানুষ দুয়ের সম্পর্কেই সে হয়ে উঠেছিল ভণ্ড, কপটাচারী; আর তার একমাত্র কারণ এই যে, নিজের দৈন্য, নিজের ক্ষুদ্রতা সম্বন্ধে সে ছিল সম্পূর্ণ সচেতন। লেখ, কেমন করে সেই তরুণ তিলে তিলে তার অন্তরের ক্রীতদাসটাকে ধ্বংস করে ফেলে, আর তার পরে এক সুন্দর প্রভাতে ঘুম ভেঙে জেগে উঠেই অনুভব করে তার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে মানুষেরই রক্ত,—ক্রীতদাসের নয়।”
চেখফ যখন সাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত (ইং ১৮৮৯) তখন সম্পাদক-বন্ধু সুভরিনকে লিখেছিলেন এই পত্রখানি। কেউ যদি সেই তরুণের কথা লিখতেন তাহলে তিনি লিখতেন যার জীবন-কথা তিনি আন্তন পাবলব চেখফ। চেখফ ছাড়া আর কেউ যদি তা লিখতে পারতেন, তাহলে লিখতে পারতেন—গর্কি। অবশ্য সেই রেখাচিত্রের প্রতিটি রেখায় পড়ত এক শিশুর ‘রক্ত, অশ্রু ও শ্রমের’ দাগ। কারণ, চেখফ-এর কথাতেই বলতে হয়—“শৈশবে, শৈশব বলেই আমার কিছু ছিল না।” এই রক্তঝরা জীবন থেকেই তিনি তবু উদ্ধার করেছিলেন মুক্তির পথ, আর সৃষ্টি করেছিলেন শুভ্র-করুণ আলোক-ছটা। চুয়াল্লিশ বছরের এ জীবনকে সত্যই বলতে হয়—অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো।
আন্তনপাবলব চেখফ, জন্মেছিলেন তগন-রগ-শহরে ইং ১৮৬০ সালের ২১শে জানুয়ারি। তাঁর পিতামহ ছিলেন ভূমিদাস কৃষক; কিন্তু নিজের চেষ্টায় তিনি অর্জন করেছিলেন নিজের ও পুত্রকন্যাদের মুক্তি। নিঃসন্দেহ শক্তিমান পুরুষ ছিলেন তিনি, তাই প্রবলের ধর্মানুযায়ী ছিলেন ক্রীতদাস প্রথারও প্রবল সমর্থক। শক্তির অভাব তাঁর পুত্র পাবলব ইগরোভিচ-এরও ছিল না। পিতার অপেক্ষা বেশিই ছিল পাবলবের চণ্ডতা, দুর্ধর্ষতা, স্ত্রী-পুত্রের উপর শাসন-পীড়ন, দৌরাত্ম্য। সেই সঙ্গে ছিল না পিতার বৈষয়িক সুবুদ্ধি, কিন্তু ছিল গির্জার গানে ও মূর্তি-অঙ্কনে নিজস্ব ঝোঁক। পিতার অকথ্য পীড়ন ও দৈন্যের বোঝার সঙ্গে আন্তনও তাঁর ভ্রাতারা পেয়েছিলেন এই উত্তরাধিকার। আন্তনছিলেন পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে তৃতীয় ভ্রাতা। জ্যেষ্ঠ দুই ভাই শক্তি থাকলেও আলস্যে, অস্থিরচিত্ততায়, সুরাশক্তিতে তা উড়িয়ে দেন—বয়ঃকনিষ্ঠ আন্তনের সমস্ত প্রয়াস ও সহায়তা সেদিকে ব্যর্থ হয়।
আনতনের যখন ষোলো বৎসর তখন বাপ তাঁকে তগন-রগ-এ রেখে দেনার দায়ে সপরিবারে পালিয়ে যান মস্কোতে। উপেক্ষা ও উপহাস মাথায় নিয়ে আন্তনতিন বৎসর পরে প্রবেশিকা পাশ করে এলেন তাঁদের কাছে, আরম্ভ করলেন চিকিৎসা-বিদ্যা অধ্যয়ন। সঙ্গে সঙ্গে সেই দৈন্য-প্রপীড়িত বৃহৎ সংসারটির সমস্ত বোঝা পড়ল তাঁরই মাথায়। সেই দুর্ভার দায়িত্ব বহনের চেষ্টাতেই চিকিৎসা-বিজ্ঞানের ছাত্র আন্তনউনিশ বৎসর বয়সে লিখতে আরম্ভ করেন তখনকার রুশ রঙ্গ-ব্যঙ্গের পত্রিকাসমূহে ছোট ছোট হাসির গল্প। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ চুটকি-গল্প অজস্র লিখতে হয়েছে তাঁকে নানা নামে। সব চেয়ে বেশি লিখেছেন ‘আনতোশা চেখন্তে’ এই নামে—ইং ১৮৭৯–১৮৮৭ এই আট বছরে প্রায় চারশো গল্প, ছোট গল্প, নক্সা, নভেল, রিপোর্ট এভাবে লেখা হয়েছিল। এ সব লোক হাসাবার রচনার মধ্যে যে সাহিত্য-শক্তি ফুটে উঠছিল আন্তন চেখফ প্রথম তাতে গুরুত্ব দেন নি। লেখক হবার কথা তাঁর কল্পনায় ছিল না একটা গোটা সংসার তিনি পালন করছেন, চিকিৎসা-বিজ্ঞান অধ্যয়ন করছেন, ভাবতেন ডাক্তার হবেন। চেখফ ডাক্তার হলেন (ইং ১৮৮৪), মস্কোর কাছে ইস্ত্রার (জেম্স্তভো) হাসপাতালে কাজও নিলেন। আর ঠিক সেই সময়েই প্রথম রক্ত উঠল মুখে—ক্ষয় রোগের পূর্ব লক্ষণ বোঝা গেল। নিকটস্থ বাবকিনোতে গিয়ে তিনি বিশ্রাম নিলেন কিছুদিন। তাঁর দু-খণ্ড লঘু গল্পের সংগ্রহ ততদিনে (১৮৮৫) প্রকাশিত হয়েছে। কিছু কিছু সাহিত্যিকের সঙ্গেও ইস্ত্রা ও ববকিনোতে তাঁর পরিচয় ঘটেছে। বিশেষতঃ ডাক্তার হিসাবে পেয়েছেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ও পল্লী-জীবনের অভিজ্ঞতা। আর সাময়িক পত্রের সঙ্কীর্ণ পরিধিতে চুটকি লেখা লিখতে লিখতে তিনি আয়ত্ত করছিলেন অভাবনীয় বাক্-সংযম। বিদ্রূপের ভঙ্গি ছাড়িয়ে তাঁর ব্যঙ্গ-রচনায় তাই ফুটে উঠতে লাগল জীবন-রসিকের তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি। রঙ্গোপজীবীর লঘু-রচনায় দেখা দিল সুক্ষ্ম জীবন-বোধের, দৃঢ় মূল্য-বোধের আভাস। তখনকার রঙ্গ-ব্যঙ্গের গল্পেও চেখফ-এর এ ধরনের বিকাশ তাই লক্ষ্য করা যায়—অমর সেই মানবতার চেতনা, হালকা বিষয়ের পিছনে বেদনার ছায়া, মুখের হাসির সঙ্গে চোখের অদৃশ্য অশ্ৰু।
ইং ১৮৮৫তে তাই চেখফ আর এক অঙ্ক উত্তীর্ণ হলেন। সে বৎসরের লেখা ‘দুর্ভাগ্য’ নামে গল্পটি থেকে তা অনুভব করা যায়। ছোট গল্পটির বিষয় সামান্য: সমস্ত জেলায় গ্রিগরি পেত্রভের যেমন নাম ছিল কাঠের কাজে, তেমনি নাম ছিল মাতাল বলে। সেই গ্রিগরি মরণাপন্ন স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটল। বরফ-বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চলছে। নেশায় চোখ জড়ানো। নিজেই বলছে—ডাক্তারকে সে একটা সুন্দর সিগারেট-কেস নিজের হাতে তৈরি করে দেবে পরে। চল্লিশ বছর সে ও মত্রোনা ঘর করছে এক সঙ্গে। চল্লিশ বছর ধরে বেচারীকে সে জ্বালিয়েছে। গ্রিগরি বুঝিয়ে বলছে—লোকটা সে মন্দ নয়। মত্রোনাকে সত্যই ভালোবাসে। কিন্তু মত্রোনা কি শুনছে? ...চোখে জল আসে! সত্যি, দেখতে না-দেখতে দিন কেমন ফুরিয়ে যায়। আবার যদি জীবন ফিরে পাওয়া যায়—মত্রোনাকে সে বুঝিয়ে বলত—সত্যই ভালোবাসত—।
গ্রিগরির যখন হাসপাতালে জ্ঞান হল মত্রোনা তো তার আগে গাড়িতেই শেষ হয়ে গিয়েছে, গ্রিগরির হাত-পাও বরফে খেয়ে বিনষ্ট। ডাক্তার বলছেন, “অনেক তো হয়েছে। ষাট পেরিয়ে গেছ, না? আবার কি চাই?...”
“হুজুর, আর ছটা বৎসর।” গ্রিগরি গুঙিয়ে ওঠে।
“কেন?”
“পরের ঘোড়া এনেছি, ফিরিয়ে দিতে হবে। ইস্ত্রীকে গোর দিতে হবে। আর আপনাকে একটা খাশা সিগারেট কেস বানিয়ে দোব—”
ডাক্তার হাত নেড়ে তার কথা উড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মিস্ত্রির সে দিন গিয়েছে।
এই তো গল্প, অল্পই ঘটনা। তবু দুইটি ট্রাজিডি—স্ত্রী নেই, মিস্ত্রিরও হাত-পা গিয়েছে। কিন্তু সে ভাবছে সিগারেট-কেস বানাবে—ভাগ্যের পরিহাস। অথচ মিস্ত্রির গোটা জীবন যেন সুস্পষ্ট গল্পের ওই স্বল্প পরিসরে। আর সমস্ত মানব-নিয়তিই আভাসিত মাতাল মিস্ত্রির একটি কথায়—“দেখতে না দেখতে দিন কেমন ফুরিয়ে যায়।”
চেখফ-এরই গল্প নিঃসন্দেহ, কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্প নয়,। এ গল্প পড়ে সেদিনের খ্যাতনামা লেখক গ্রিগোরিভিচ নিজ থেকে চেখফকে চিঠি লিখলেন,—তোমার শক্তি আছে। তুমি বাজে লেখা লিখে নিজেকে নষ্ট করো না। চেখফ চমকিত হলেন, সবিনয়ে জানালেন নিজের দ্বিধা-সংকোচ। অবশ্য যে প্রত্যয় চেখফ-এর নিজের মধ্যে গোপনে জন্মাচ্ছিল তা এবার প্রকাশ্যে সচেতন না হয়ে পারল না।
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment