মানুষের জীবন এগিয়ে চলে নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। যারা সচেতনভাবে বৃহত্তর জীবনের পথ বেছে নিতে চায় তাদের বেলায় সংঘাত হল অনুক্ষণের সাথী। তাই বুঝি কিছুদিন পরেই প্রিয় সঙ্গীর সঙ্গে তীব্র মতান্তর শুরু হয়। আমার ওপর তখন অধ্যাত্মবাদের প্রভাব খুব বেশি। বাড়িতে দাদার আমন্ত্রণে নানা আশ্রমের সন্ন্যাসীরা এসে সময়ে সময়ে অতিথি হন। দাদার সঙ্গে তাঁদের শাস্ত্র ও দর্শন সম্বন্ধে অনেক আলোচনা হয়। কখনও বা হয় তুমুল তর্কবিতর্ক। তার অনেক কিছুই বুঝতে পারি না, তবু মনে কিছু কিছু রেশ থেকে যায়। সেগুলিকে নিজের ধারণার রঙে রাঙিয়ে নিতে চাই। সেই সময়টা হিন্দু মিশন থেকে পার্থসারথিরূপে শ্রীকৃষ্ণের একখানা ছবিকে খুব জনপ্রিয় করে তুলেছিল। সেটি ছিল বংশীবাদন ননীগোপালের বদলে শঙ্খচক্রধারী বীরত্বব্যঞ্জক মূর্তি। নিচে লেখা ছিল “অবনত ভারত চাহে তোমারে, এস সুদর্শনধারী মুরারী।” সেদিন অনেকের কাছেই তা সংগ্রামী চেতনার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমিও ছিলাম তার একজন। সন্ধ্যায় নির্জন রুদ্ধদ্বার ঘরে বসে সে মূর্তিকে ধ্যাননেত্রের সামনে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করতাম। শশাঙ্ক এই সব কিছুকে হানত বিদ্রূপের তীব্র কশাঘাত। সে মোটেই অধ্যাত্মবাদী নয় এবং অন্তর্মুখীনতাকে উপহাস করে। ফলে আর আগের মত বন্ধুর সামনে মনের কপাট উন্মুক্ত করে ধরতে ইচ্ছা হয় না। সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে না বটে কিন্তু বিরোধ বেড়ে চলে আরো এক কারণে। শশাঙ্ক সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হতে অনিচ্ছুক। তার দেশসেবার কাজ সমাজ-সংস্কারের চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায়। ফলে ধীরে ধীরে পরস্পরের সাহচর্যে ভাঁটা পড়ে। আরার নিজেকে নিঃসঙ্গ বোধ করি।

দাদা ততদিনে ‘থিওজফি’র আশ্রয় নিয়েছেন বোধ হয় সংস্কারের প্রতি আনুগত্য এবং স্বাধীন চিন্তার মধ্যে আপসের উপায় হিসাবে। একযুগে থিওজফিক্যাল সোসাইটি সারা ভারতের উচ্চশিক্ষিত উদার মতাবলম্বী লোকদের আকর্ষণের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সোসাইটির সভাপতি ডা. অ্যানি বেসান্তের ব্যক্তিত্বও ছিল বোধহয় তার অন্যতম কারণ। আমি যখন জানার সুযোগ পেয়েছি তখন তা পেন্সনপ্রাপ্ত উচ্চ সরকারী কর্মচারী, উদার মতাবলম্বী জমিদার রায়বাহাদুর, আইনজীবী ইত্যাদির অবসর বিনোদনের সংগঠন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চশিক্ষা এবং খানিকটা দার্শনিক মনোভাবের ফলে বোধ হয় তাঁরা সুরুচি সম্মতভাবে অবসর বিনোদনের জন্য এই পন্থা বেছে নিয়েছিলেন। বড়দা যখনই থিওজফিক্যাল সোসাইটির কোনো সম্মেলনে যেতেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। প্রথম প্রথম ভালই লাগত। গণ্ডীঘেরা জীবনের বাইরে একটা নূতনত্বের স্বাদ পাওয়া যেত। অনেক ভাল ভাল কথা, যেমন বিশ্বভ্রাতৃত্ব, সর্বধর্ম সমন্বয়, সমস্ত ধর্মের সার গ্রহণ ইত্যাদি শুনতাম। সম্মেলনের সভা শুরু হওয়ার আগে প্রতিদিনই সমস্ত ধর্মের প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হত। প্রথমে উপনিষদের ‘পুরুষসুক্ত’ দিয়ে শুরু এবং ঐতিহাসিক পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধর্মের প্রার্থনা পর পর চলতে থাকত। এই পরিবেশটি বিশেষ করে কোনো ধর্মের গোঁড়ামী থেকে মুক্ত হতে খানিকটা সাহায্য করেছে বই কি! তবে থিওজফির সঙ্গে বেশিদিন সম্পর্ক রাখা সম্ভব হয় নি। ক্ৰমে বুঝতে লাগলাম যে ভাল ভাল কথাগুলিকে কাজে পরিণত করার দিকে এঁদের কোনো তাগিদ নেই। কাজেই সেগুলি নিছক সৌখীন বিলাসে পরিণত হয়েছে। উপরন্তু এঁরা রাজনীতি, বিশেষতঃ সংগ্রামী রাজনীতির ছোঁয়াচটুকুও এড়িয়ে চলেন। দেশের দরিদ্র জনসাধারণের দুঃখবেদনা সম্বন্ধে উদাসীন থেকে মানবপ্রেমের কথা আবৃত্তিকে বেশিদিন বরদাস্ত করা সম্ভব হল না। তাই থিওজফির সঙ্গে সম্পর্ক ভালভাবে গড়ে ওঠার আগেই শেষ হয়ে গেল। তবু স্বীকার করতে হবে যে প্রথমদিনগুলিতে তা মনের দিগন্ত প্রসারে সাহায্য করেছে। আমাদের ছোট্ট শহরটির বাইরে ছড়িয়ে আছে যে ভারতবর্ষ এবং পৃথিবী তার সঙ্গে সংযোগের যোগসুত্ররূপে কাজ করেছে। দাদার কাছে নানা জায়গা থেকে চিঠি এবং পত্রিকা আসত। সোসাইটির মাতব্বরদের অনেকে দার্জিলিং বা কালিম্পং যাওয়ার পথে আমাদের বাসায় অতিথি হতেন। তাঁদের মধ্যে দু-একজন অ-ভারতীয়ও ছিলেন। কারো কারো ব্যবহার সত্যি শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে।

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion