পূর্ববঙ্গের সেই অঞ্চলে দুটি উৎসব বাল্যকালে মনকে খুব বেশি নাড়া দিত, দুটিই ছিল স্নানের উৎসব। তার মধ্যে প্রধান ছিল অতি জনপ্রিয় ব্ৰহ্মপুত্ৰ-স্নান, অন্যটি ছিল বারুণী স্নান, চৈত্র মাসের কৃষ্ণাত্রয়োদশীতে।

এই উপলক্ষ্যে অসংখ্য নারী-পুরুষ দলবেঁধে স্নান করবার জন্য লাঙ্গলবন্ধের দিকে যেতো-নয়তো স্থানীয় নদী বা পুকুরে স্নান করত। কিন্তু বাল সমাজের প্রধান আকর্ষণ ছিল এই উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা যাকে চলিত ভাষায় বলা হতো গলইয়া। এখানে সদ্য আকর্ষণের বস্তু ছিল চিনির গড়া মঠ আর পোড়ামাটির আল্লাদী। সাধারণ নাম মঠ হলেও সব চিনির মিষ্টিই মঠের আকারের ছিল না; হাতি ঘোড়া নানা পোশাকের মানুষের আকারের এই চিনির মিষ্টি এখনও বাজারছাড়া হয়নি। কিন্তু চলতি মাটির পুতুলের আকৃতির পরিবর্তন হয়ে গেছে মৌলিক। দেশভাগের পর হঠাৎ কলকাতার বাজারে সেই সুদূর মৈমনসিং-এর পুতুল দেখে অনেক পুরোনো স্মৃতিই মনে এসেছিল; আমাদের আশুতোষ সংগ্রহশালায় ঐ পুতুলের খুব ভালো একটা সংগ্রহ তাড়াতাড়ি জোগাড় করে নেওয়া হয়েছিল প্রাণকৃষ্ণবাবুর উৎসাহ আর তৎপরতায়। ঢাকার সরা, বরিশালের মনসাঘট, ফরিদপুরের কাঁথা আর যশোরের পোড়ামাটির মন্দির ফলক নিয়ে পূর্ব বঙ্গের চলিত শিল্পের একটা সংগ্রহ আমাদের সংগ্রহশালার অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় নেয়নি। শুনেছি বাঙলাদেশে চলতি সংস্কৃতির দিকে স্থানীয় অধিবাসীদের দৃষ্টি ক্রমে গভীর অনুরাগের দিকে এগুচ্ছিল। তবে এই সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে চলতি সাহিত্যই যে হয়ে উঠেছিল প্রধান আকর্ষণের উপকরণ এ-সংবাদ সকলেই রাখেন। আকাশী বোমা আর জঙ্গী মারণাস্ত্রের নির্ঘোষের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো দিনের যেসব কথা মনে পড়ছে গভীর বেদনার সঙ্গে তার মধ্যে উজ্জ্বল একটা ছবি— একদিন সেই আধাসহর চৌকির পথে হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল জসীমউদ্দীনের সঙ্গে। বয়সে তরুণ কবি তখন মৈমনসিং-এর গ্রামে গ্রামে গীতি কবিতার সন্ধানে ঘুরছেন; কদিন আগেই হঠাৎ আগে থেকে না-জানা অনেকগুলি পদ আবিষ্কার করে মনটা তাঁর খুবই উৎফুল্ল। কলকাতায় কেশব সেন স্ট্রিটের ওয়াই এম সি এ তে অবস্থানের সময় কবির সঙ্গে তার গ্রাম অঞ্চলে বেড়াবার গল্পের সমজদার শ্রোতা খুব বেশি ছিল না। পরে আশুতোষ মিউজিয়ম প্রতিষ্ঠিত হলে প্রায়ই জসীমউদ্দীন মিউজিয়ামে এসে আড্ডা জমাতেন, তাঁর লোকশিল্প প্রীতির অনেক নিদর্শন, কিছু কাঁথা, ছবি, পুঁথির পাতা মিউজিয়ামের সংগ্রহে সযত্নে রাখা আছে।

পূর্ব বঙ্গের আর যারা আমাদের সংগ্রহশালার সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন তাদের মধ্যে ঢাকা সংগ্রহশালার কার্যাধ্যক্ষ নলিনী কুমার ভট্টশালী আর রাজসাহী বরেন্দ্র সংগ্রহশালার শ্রীযুত নীরদবরণ সান্যালের কথাও আজ মনে পড়ছে। নীরদবাবুকে পরে রাজসাহী ছাড়তে হলেও নলিনীবাবু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ঐকান্তিক যত্ন ও আবেগের সঙ্গে ঢাকা সংগ্রহশালার সেবা করে গিয়েছেন। রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের পরেও ঢাকার মানুষ যে ভট্টশালী মশাইকে ভুলতে পারেনি তার পরিচয় আছে পূর্বে ঢাকা সংগ্ৰহশালার পঞ্চাশৎ বৎসর পূর্তী উপলক্ষে প্রকাশিত ভট্টশালী স্মৃতি গ্রন্থ। বস্তুত ভিন্ন সম্প্রদায়ের এক পরলোকগত গুণীজনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এ শ্রদ্ধার্ঘ্য ঢাকার শিক্ষানুরাগীদের সাম্প্রদায়িকতার উর্ধে উত্তরণের দিকে ছিল এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। আজ বিশেষ করে এই গ্রন্থপ্রকাশের উদ্যোক্তা ডাক্তার মহম্মদ হবিবুল্লা মশাই এবং তদীয় জামাতা ঢাকা সংগ্রহশালার তরুণ কর্মাধ্যক্ষ ভট্টশালীর যোগ্য উত্তরাধিকারী ডাক্তার এনামুল হকের কথা গভীর বেদনার সঙ্গে স্মরণ হচ্ছে। এনামুল হক এখন কোথায় আছেন জানি না কিন্তু হবিবুল্লা সংক্রান্ত সংবাদে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওঁর সহকর্মীরা তীব্র আবেগ ও জঙ্গীপাশবতার বিরুদ্ধে দুর্দমনীয় ঘৃণা অনুভব না করে পারবে না। হবিবুল্লা ছিলেন বর্ধমানের মানুষ; লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ ডি ও গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে উপাধি লাভের পর এখানে তিনি ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপকতায় ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁর একখানি পুস্তকে দিল্লী আগ্রার চতুস্পার্শ্বের অধিবাসী ভারতজনের বহিরাগত তুর্কী-মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে কালজয়ী দুর্দান্ত সংগ্রামের ইতিহাস ভারতীয় ইতিহাসবিদদের অবজ্ঞাত এক অধ্যায়ের প্রতিষ্ঠায় সত্যানুসন্ধানের এক অগ্রণী

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion