জয়ন্তীতে-জয়ন্তীতে পুষ্পমাল্যের অর্ঘ্যনিবেদন সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, বাদবিসংবাদের অবসান হয়নি কখনো। সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত অনুরাগ ও বিদ্বেষের শাদা-কালো ধারায় আপ্লুত হয়েছেন তিনি। তাঁকে নিয়েই সকল গর্ব আমাদের, আবার বিক্ষোভের কেন্দ্রস্থলে পাতা হয়েছে তাঁর আসন।

শতাব্দীর প্রথমার্ধে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজে যে ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তার কয়েকটি দিকের উল্লেখ করা চলে এখানে। রবীন্দ্রনাথ যে মহাকাব্য রচনায় নামলেন না, এ-নিয়ে নবীন সেনের মতো কবি কায়কোবাদও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। ঐ আঙ্গিকের মোহে তিনি এমনই আবদ্ধ ছিলেন যে, যিনি মহাকাব্যকার নন, তাঁকে বড় কবি বলতে কুণ্ঠাবোধ করেছিলেন তিনি। ‘গীতাঞ্জলি’র কাব্য-সৌন্দর্য মেনে নিতে সরাসরি অস্বীকার করেছিলেন ‘মোহম্মদী’ পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথের রচনায় মুসলমানের জীবন উপেক্ষিত, এ-বিষয়ে অভিমান প্রকাশ করা হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগও এনেছিলেন কেউ কেউ। আবার আধ্যাত্মিকতার সন্ধানীরা তাঁর মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন আত্মার আত্মীয়কে—যেমন, তৃতীয় দশকে প্রকাশিত “ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ” শীর্ষক প্রবন্ধে গোলাম মোস্তাফা বলেছিলেন যে, শুধু এই ‘গীতাঞ্জলি’তেই ইসলামের সকল মর্মকথা লুকিয়ে রয়েছে। অনুরাগী মন নিয়ে একরামউদ্দীন লিখেছিলেন ‘রবীন্দ্র-প্রতিভা’। আর ‘মুসলিম-সাহিত্য-সমাজে’র সদস্যেরা তাঁদের প্রেরণার উৎস বলে ঘোষণা করেছিলেন রামমোহন-রবীন্দ্রনাথ-কামাল আতাতুর্ককে। এই সমাজের বিশিষ্ট নেতা কাজী আবদুল ওদুদের রবীন্দ্রচর্চার সঙ্গে সকলেরই পরিচয় আছে।

স্বাধীনতা-লাভের পরেই রবীন্দ্রনাথ জনগণের কবি-কিনা, সে তর্ক পূর্ব বাঙলায়ও উঠেছিল। তারপরে আরো নানাভাবে রবীন্দ্রনাথকে দেখা হয়েছে সেখানে। পূর্ববাঙলায় রবীন্দ্রনাথের যে ব্যাখ্যাদান করা হয়েছে, তাঁকে মূলত তিনটে ধারায় ভাগ করে দেখা যেতে পারে।

সংখ্যায় অল্প, এমন এক দল রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন প্রধানত সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে। রবীন্দ্র-ভুবন নির্মাণে উপনিষদের যে-দান, তাকেই তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। তাঁদের মতে, এই ঐতিহ্যের ধারা থেকে বাঙালি মুসলমানের লাভ করবার মতো কোনো প্রেরণা নেই—কেননা, এ তার ধর্মবোধের পরিপন্থী। এঁরা আরো গুরুত্ব দেন ‘কথা ও কাহিনী’র মতো কাব্য, “দুরাশা” ও “সমস্যাপূরণে”র মতো গল্প ও “ব্রাহ্মণে”র মতো প্রবন্ধকে। এসব চিত্র ও বক্তব্য মুসলমানের মর্মে আঘাত করে—এই হলো তাদের বক্তব্য। রবীন্দ্রনাথ যে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন এবং “শিবাজী-উৎসবে”র মতো কবিতা লিখেছিলেন, এ-কথাও তাঁরা ভুলতে পারেন না। সুতরাং তাঁরা কবিকে পরিত্যাগ করার পক্ষপাতি।

দ্বিতীয় দলে কিছু প্রবীণ লেখক আছেন। তাঁরা জোর দেন রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতার উপরে। ব্রাহ্মরা যে-চিন্তায় মুসলমানের সন্নিকটবর্তী, দেবেন্দ্রনাথ যে হাফিজের অনুরাগী পাঠক ছিলেন, এ-সব কথাও তাঁরা স্মরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের শ্মশ্রুমণ্ডিত আলখেল্লা পরিহিত চিত্র তাঁদেরকে বেশ আশ্বস্ত করে। ‘গীতাঞ্জলি’-‘গীতিমাল্য’-‘গীতালি’তে তাঁরা অন্বিষ্ট আধ্যাত্মিকতার পোষকতা দেখতে পেয়েছেন, ‘রাজা’র মতো নাটক ও ‘শান্তিনিকেতন’ প্রবন্ধাবলীর কয়েকটিতেও তাঁরা নিজেদের চিন্তার সমর্থন খুঁজেছেন। ডক্টর শহীদুল্লাহর মতো পণ্ডিতজন “উর্বশী” কবিতারও একটা সুফীবাদী ব্যাখ্যা রচনা করেছিলেন।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যে-আধুনিক পাঠকের দল পূর্ব বাঙলায় দলে ভারি ধর্মভাবনায় তাঁরা উৎকণ্ঠিত নন। উপনিষদ ও সুফীবাদ দুইই তাঁদের দিগ্বলয়ের বাইরে। ‘বলাকা’ থেকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাস, ‘রক্তকরবী’র মতো নাটক, ‘রাজা-প্রজা’-‘কালান্তর’-‘সভ্যতার সঙ্কটে’র মতো প্রবন্ধ—এগুলো থেকেই তাঁরা প্রেরণা লাভ করেন সবচাইতে বেশি। শুধু সাহিত্যগত নয়, সামাজিক প্রেরণাও। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কি প্রবলের প্রতাপের মুখে যখন তাঁরা দাঁড়ান, বঞ্চিতের অধিকার প্রতিষ্ঠার, কি অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার কথা যখন তাঁরা বলেন, রবীন্দ্রনাথের বাণী তখন তাঁদের সহায় হয়।

সেই সঙ্গে তাঁরা এ-কথাও বলেন যে, রবীন্দ্রনাথকে সমগ্ররূপে দেখতে হবে। রবীন্দ্র-ভাবনায় যেখানে তাঁদের মতে দুর্বলতা, সেখানে তাঁরা তা স্পষ্ট করে বলবার পক্ষপাতী ৷ এত দীর্ঘকাল ধরে, এত বিচিত্র ধারায় যার লেখনী প্রবাহিত তাঁর মধ্যে ভাবের ঐক্য দাবী করা সঙ্গত নয়। কিন্তু তাই বলে মনগড়া আদর্শের পরিমাপে ছেঁটেকেটে ফেলতে হবে কবিকে, এতে তাঁদের ভয়ানক আপত্তি।

সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পূর্ব বাঙলার বুদ্ধিজীবিদের সঙ্গে সরকারী নীতি-নির্ধারক ও তাঁদের পৃষ্ঠপোষিত কিছুসংখ্যক ব্যক্তির বিরোধের একটা মূল এখানেই নিহিত। বাঙলাদেশের সংস্কৃতির যে

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion