[১৯৪৭এ দেশ বিভাগের পরে অনিবার্যরূপেই একটা জিজ্ঞাসা আমাকে পেয়ে বসেছিল, কি করে সম্ভব হলো বাঙালির এই ‘হারিকরি’? যা আমার ধারণা তা বলবার জন্যই লিখতে বসেছিলাম ‘বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা’। লেখা শেষ হয়নি—বিশেষ করে যেখানে এসে দুর্ভাগ্যের সূচনা—ঊনবিংশ শতাব্দী—সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতেই দ্বিতীয় ভাগ শেষ হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙলা সাহিত্য থেকে বাঙালি মুসলমানের স্বেচ্ছা নির্বাসন কেন, তার ফল কী? বিশদ করে তা বলবার সমর্থ আয়ুতে আর কুলোবে কিনা জানি না, কিন্তু তার কথা বলবার সুযোগ আর উপেক্ষা করলাম না। দিল্লীতে ১৯৭১-এর গত ১০ই এপ্রিলের বাঙলা সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজিত সমসাময়িক ‘বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে’র আলোচনাসভার সভাপতির মৌখিক ভাষণে সে-চেষ্টা করেছি। সে-সভায় সমসাময়িক বাঙলা সাহিত্যের বিষয়ে চমৎকার আলোচনা করেছিলেন শ্রীযুক্ত নীহাররঞ্জন রায়, শ্রীযুক্তা আশাপূর্ণা দেবী, শ্রীশান্তি সিংহরায়, আমার বক্তব্য কিন্তু ‘সমসাময়িকে’র সেরূপ সমীক্ষা ও পরীক্ষা নয়, তার পরিপ্রেক্ষিতের সন্ধান। ইতি ১৭৷৪৷৭১ ইং, লেখক]

সমসাময়িক বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য একটা বিশেষ বিবর্তনের সম্ভাবনায় এসে দাঁড়াচ্ছে—কারণ ভাবী বাঙলার জন্মবেদনায় আজকের বাঙলা অস্থির। নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষায় বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য সোনার বাঙলার জন্য অপেক্ষমান। গোড়ার একটা কথা, সমসাময়িক কাল বলতে আমি শুধু এই ১৯৭০-৭১-এর বা ওরূপ দু-একটা বৎসর বোঝাতে চাই না। অবশ্য এ-যুগে সভ্যতার গতিবেগ দিনের পর দিন খরতর হয়ে উঠছে। তাই মানুষ আর দীর্ঘ করে যুগ গণনা করে না। বাঙলা সাহিত্যে প্রায়ই ‘পঞ্চাশের দশক’ ‘ষাটের দশক’ এরূপ দশক হিসাবে সাহিত্য সমীক্ষাও এখন একটা নিয়ম। সে হিসাবে সমসাময়িক বলতে ষাটের দশকই বোঝানো উচিত।—সত্তরের দশক মাতৃগর্ভে না হোক এখনো মাতৃক্রোড়ে। এরূপ গণনায় সাময়িকতার সম্মান রক্ষা হতে পারে। সমতার অর্থ সঙ্কীর্ণ হওয়া অনিবার্য। সাহিত্যের দিক থেকে বরং আমরা বলতে পারি—রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের (১৯৪১) পরেই সমসাময়িক কালের প্রারম্ভ। অথবা, ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা লাভের থেকেই কালাস্তর; আর বাঙলাদেশের পক্ষে বাঙলা বিভাগেই সেই কালান্তর—অর্থাৎ সঙ্কটকাল,—কালগ্রাসের বিভীষিকা। অবশ্য কেউ কেউ ১৯৪৭ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত কালটাকে ‘সাম্প্রতিক’ বলতে পারেন, আর ১৯৬০-এর পরেকার বছরগুলিকে বলতে পারেন, ‘সমসাময়িক’। আপত্তি করি না। তবে ১৯৪৭-এ যে একটা কালান্তর তা এই ১৯৭১-এ পৌঁছে আমাদের কাছে স্পষ্ট। কথাটা স্পষ্টতর হয়ে ওঠে যদি আমরা সমগ্রভাবে বাঙলা সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে চেষ্টা করি—তাহলেই ১৯৭০-৭১-এর বাঙালি জীবনের এই মুহূর্তের তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়, সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িক বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রকৃত রূপটা প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে।

অতীতের উত্তরাধিকার
সে দৃষ্টিতে রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কালটাকে আমরা বলতে পারি ‘আধুনিক যুগ’, তার পূর্বেকার যুগটাকে ‘মধ্যযুগ’ অন্তত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ থেকে ভারতচন্দ্র পর্যন্ত যার বিস্তার। পিছনে অবশ্য ছিল চর্যাপদের কাল বা প্রাচীন বাঙলা সাহিত্য। এই প্রেক্ষাপটও অবশ্য চূড়ান্ত নয়, কারণ বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের পিছনেও তো ছিল ভারতীয় জীবন ও সংস্কৃতির হাজার দুই বৎসর। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য তো সে-উত্তরাধিকার বঞ্চিত নয়—ভারতের আধুনিক ভাষা ও সাহিত্যের থেকে বাঙলায় এ-সম্পদ বেশি সঞ্চিত। সমসাময়িক বাঙলা সাহিত্য সে-বিষয়ে উৎসাহী না হতে পারে, কিন্তু সে-দান অস্বীকার করাও তার পক্ষে অসম্ভব। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথে এই উত্তরাধিকার আবার নায়িত হয়েছে।

বাঙলা সাহিত্য আরও যে বিষয় গৌরবে পরিপুষ্ট তা মনে রাখাও এজন্য প্রয়োজনীয়। বাঙলা সাহিত্যের প্রধান বিষয় কি কি?—একটা প্রধান বিষয় তো দেখলাম—প্রাচীন ভারতীয় বিষয়; সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত ভাষায় রচিত সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তা বাঙলা ভাষায় এসে পৌঁছেছে—বেদ, উপনিষদ রামায়ণ মহাভারত জাতক কাব্য, অলঙ্কার, দর্শন প্রভৃতি অজস্র গ্রন্থের সূত্রে একটা বৃহৎ ঐতিহ্য প্রবাহিত হয়ে চলেছিল সমগ্র ভারতেই তার বিস্তার কখনো ক্ষীণ কখনো বিপুল, কিন্তু একেবারে লুপ্ত হতে পারেনি। এ-একটা সর্বভারতীয় ঐতিহ্য—প্রাচীন ভারতীয় বিষয়। বিশেষ করে ‘রামায়ণ’ ভারত ‘মহাভারত’ ও ভাগবত মুক্তি দিল

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion