কবিতা কি এ-জিজ্ঞাসার কোনো আবছা উত্তর দেওয়ার আগে এটুকু অন্তত স্পষ্টভাবে বলতে পারা যায় যে কবিতা অনেক রকম। হোমরও কবিতা লিখেছিলেন, মালার্মে র‍্যাঁবো ও রিলকেও। শেকস্‌পীয়র বদ্‌লেয়র রবীন্দ্রনাথ ও এলিয়টও কবিতা রচনা ক’রে গেছেন। কেউ-কেউ কবিকে সবের ওপরে সংস্কারকের ভূমিকায় দ্যাখেন; কারো-কারো ঝোঁক একান্তই রসের দিকে। কবিতা রসেরই ব্যাপার, কিন্তু এক ধরনের উৎকৃষ্ট চিত্তের বিশেষ সব অভিজ্ঞতা ও চেতনার জিনিস—শুদ্ধ কল্পনা বা একান্ত বুদ্ধির রস নয়।

বিভিন্ন অভিজ্ঞ পাঠকের বিচার ও রুচির সঙ্গে যুক্ত থাকা দরকার কবির; কবিতার সম্পর্কে পাঠক ও সমালোচকেরা কি ভাবে দায়িত্ব সম্পন্ন করছেন—এবং কি ভাবে তা’ করা উচিত সেই সব চেতনার ওপর কবির ভবিষ্যৎ কাব্য, আমার মনে হয়, আরো স্পষ্টভাবে দাঁড়াবার সুযোগ পেতে পারে। কাব্য চেনবার আস্বাদ করবার ও বিচার করবার নানারকম স্বভাব ও পদ্ধতির বিচিত্র সত্যমিথ্যার পথে আধুনিক কাব্যের আধুনিক সমালোচককে প্রায়ই চলতে দেখা যায়, কিন্তু সেই কাব্যের মোটামুটি সত্যও অনেক সময়ই তাঁকে এড়িয়ে যায়।

আমার কবিতাকে বা এ-কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে; কেউ বলেছেন, এ-কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা প্রধানত ইতিহাস ও সমাজ -চেতনার, অন্য মতে নিশ্চেতনার; কারো মীমাংসায় এ-কাব্য একান্তই প্রতীকী; সম্পূর্ণ অবচেতনার; সুররিয়ালিস্ট। আরো নানা-রকম আখ্যা চোখে পড়েছে। প্রায় সবই আংশিকভাবে সত্য—কোনো-কোনো কবিতা বা কাব্যের কোনো-কোনো অধ্যায় সম্বন্ধে খাটে; সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়। কিন্তু কবিতাসৃষ্টি ও কাব্যপাঠ দুই-ই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি-মনের ব্যাপার; কাজেই পাঠক ও সমালোচকদের উপলব্ধি ও মীমাংসায় এত তারতম্য। একটা সীমারেখা আছে এ-তারতম্যের; সেটা ছাড়িয়ে গেলে বড়ো সমালোচককে অবহিত হ’তে হয়।

নানা দেশে অনেক দিন থেকেই কাব্যের সংগ্রহ বেরুচ্ছে। বাংলায় কবিতার সঞ্চয়ন খুবই কম। নানা শতকের অক্‌স্‌ফোর্ড বুক অব ভর্সের সংকলকদের মধ্যে বড়ো কবি প্রায়ই কেউ নেই; কিন্তু সংকলনগুলো ভালো হয়েছে; ঢের পুরোনো কাব্যের বাছবিচারে বেশি সার্থকতা বেশি সহজ, নতুন কবি ও কবিতার খাঁটি বিচার বেশি কঠিন। অনেক কবির সমাবেশে একটি সংগ্রহ; একজন কবির প্রায় সমস্ত উল্লেখ্য কবিতা নিয়ে আর-এক জাতীয় সংকলন; পশ্চিমে এ-ধরনের অনেক বই আছে; তাদের ভেতর কয়েকটি তাৎপর্যে–এমন কি মাহাত্ম্যে প্রায় অক্ষুণ্ণ। আমাদের দেশে দু-একজন পূর্বজ (উনিশ-বিশ শতকের) কবির নির্বাচিত কাব্যাংশ প্রকাশিত হয়েছিলো; কতো দূর সফল হয়েছে এখনও ঠিক বলতে পারছি না। ভালো কবিতা যাচাই করবার বিশেষ শক্তি সংকলকের থাকলেও আদি নির্বাচন অনেক সময়ই কবির মৃত্যুর পরে খাঁটি সংকলনে গিয়ে দাঁড়াবার সুযোগ পায়। কিন্তু কোনো-কোনো সংকলনে প্রথম থেকেই যথেষ্ট নির্ভুল চেতনার প্রয়োগ দেখা যায়। পাঠকদের সঙ্গে বিশেষভাবে যোগ-স্থাপনের দিক দিয়ে এ-ধরনের প্রাথমিক সংকলনের মূল্য আমাদের দেশেও লেখক পাঠক ও প্রকাশকদের কাছে ক্রমেই বেশি স্বীকৃত হচ্ছে হয়তো। যিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেননি তাঁর কবিতার এ-রকম সংগ্রহ থেকে পাঠক ও সমালোচক এ-কাব্যের যথেষ্ট সংগত পরিচয় পেতে পারেন; যদিও শেষ পরিচয় লাভ সমসাময়িকদের পক্ষে নানা কারণেই দুঃসাধ্য।

এই সংকলনের কবিতাগুলো শ্রীযুক্ত বিরাম মুখোপাধ্যায় আমার পাঁচখানা কবিতার বই ও অন্যান্য প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত রচনা থেকে সঞ্চয় করেছেন, তাঁর নির্বাচনে বিশেষ শুদ্ধতার পরিচয় পেয়েছি। বিন্যাসসাধনে মোটামুটিভাবে রচনার কালক্রম অনুসরণ করা হয়েছে।

কলকাতা২০.০৪.১৯৫৪

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion