নীল তারা
ষাট বৎসর আগেকার কথা, কুইন ভিক্টোরিয়ার আমল। তখন কলকাতায় বিজলী বাতি মোটর গাড়ি রেডিও লাউড স্পীকার ছিল না, আকাশে এয়ারোপ্লেন উড়ত না, রবীন্দ্রনাথ প্রখ্যাত হন নি, লোকে হেমচন্দ্রকে শ্রেষ্ঠ কবি বলত। কিন্তু রাখাল মাষ্টার মনে করত সে আরও উঁচু দরের কবি, হতাশের আক্ষেপের চাইতেও ভাল কবিতা লিখতে পারে। সে তার অনুগত ছাত্র নারানকে বলত, আজ কি একখানা লিখেছি শুনবি?—ক্ষিপ্ত বায়ু ধূলি মাখে গায়। আর একটা শুনবি?—শুষ্ক বৃদ্ধে ঝটিকার প্রভাব কোথায়। আর কেউ পারে এমন লিখতে?
রাখাল মুস্তাফী শুধু এনট্রান্স পাস, কিন্তু বিদ্বান লোক, বিস্তর বাংলা ইংরেজী বই পড়েছিল। সেকালে বেশী পাস না করলেও মাস্টারি করা চলত। কবিতা রচনা ছাড়া গান বাজনা আর দাবা খেলাতেও তার শখ ছিল। প্রথম বয়সে রাখাল বেহালা জুবিলি হাইস্কুলে থার্ড মাস্টারি করত, তার পর দৈবক্রমে রূপচাঁদপুরের রাজাবাহাদুর রৌপ্যেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর সুনজরে পড়ে দু বৎসর তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারির কাজ করেছিল। কোনও কারণে সে চাকরি ছেড়ে তাকে চলে আসতে হয়। তার পর দশ বৎসর কেটে গেছে, এখন রাখাল বেহালায় তার পৈতৃক বাড়িতেই থাকে এবং আবার জুবিলি স্কুলে মাস্টারি করছে।
যখনকার কথা বলছি তখন রাখালের বয়স প্রায় তেত্রিশ। সুপুরুষ, কিন্তু চেহারার যত্ন নেয় না, উস্কখুস্ক চুল, দাড়ি কামায় না, তাতে একটু পাকও ধরেছে। পাড়ার লোকে বলে পাগলা মাষ্টার। সেকালে লোকে অল্প বয়সে বিবাহ করত, কিন্তু রাখাল এখনও অবিবাহিত। বাড়িতে সে একাই থাকে, তার মা দু বৎসর আগে মারা গেছেন।
রবিবার, সকাল আটটা। রাখাল তার বাইরের ঘরের সামনের বারান্দায় একটা তক্তপোশে বসে হুঁকো টানছে আর কবিতা লিখছে। বাড়ি থেকে প্রায় এক শ গজ দূরে একটা আধপাকা রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে। রাখাল দেখতে পেল, একটা ভাড়াটে ফিটন গাড়ি এসে থামল, তা থেকে দুজন সাহেব আর একজন বাঙালী নামল। গাড়ি দাঁড়িয়ে রইল, আরোহীরা হনহন করে রাখালের বাড়ির দিকে এগিয়ে এল।
সাহেবদের একজন লম্বা রোগা, গোঁফদাড়ি নেই, গাল একটু তোবড়া, সামনের চুল কমে যাওয়ায় কপাল প্রশস্ত দেখাচ্ছে। অন্য জন মাঝারি আকারের, দোহারা গড়ন, গোঁফ আছে, একটু খুঁড়িয়ে চলেন। তাঁদের বাঙালী সঙ্গীটি কালো, পাকাটে মজবুত গড়ন, চুল ছোট করে ছাঁটা, গোঁফের ডগা পাক দেওয়া, পরনে ধুতি আর সাদা ড্রিলের কোট। রাখাল হুঁকোটি রেখে অবাক হয়ে আগন্তুকদের দিকে চেয়ে রইল।
কাছে এসে লম্বা সাহেব হ্যাট তুলে বললেন, গুড মর্নিং সার। অন্য সাহেব হ্যাট না খুলেই বললেন, গড মর্নিং বাবু। তাঁদের বাঙালী সঙ্গী নীরবে রইলেন।
রাখাল সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে উঠে সেলাম করে বলল, গুড মর্নিং, গুড মর্নিং সার। ভেরি সরি, আমার বাড়িতে চেয়ার নেই, দয়া করে এই তক্তপোশে—এই উড্ন প্ল্যাটফর্মে বসুন।
লম্বা বললেন, দ্যাট্স অল রাইট, আমরা বসছি, আপনিও বসুন। মিস্টার রাখাল মুস্তৌফীর সঙ্গেই কি কথা বলছি?
—আজ্ঞে হাঁ।
দুই সাহেব নিজের নিজের কার্ড রাখালকে দিয়ে তক্তপোশে বসলেন, রাখালও বসল। আগন্তুক বাঙালী ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রইলেন, সাহেবের সঙ্গে একাসনে বসতে তিনি পারেন না।
গুঁফো সাহেব মুখের সিগারেট ফেলে দিয়ে বললেন, এই বেঙ্গলী বাবু হচ্ছেন আমাদের দোভাষী বাঞ্ছারাম খাঞ্জা। বোধ হয় এঁর দরকার হবে না, আপনি ইংরেজী জানেন দেখছি, আমরা সরাসরি আলাপ করতে পারব। ওয়েল মুস্তৌফী বাবু, আমার এই ফেমস্ ফ্রেণ্ডের নাম আপনি শুনেছেন বোধ হয়?
কার্ড দুটো ভাল করে পড়ে রাখাল বলল, আজ্ঞে শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না, ভেরি সরি।
—কি আশ্চর্য, আপনি তো একজন শিক্ষিত লোক, স্ট্রাণ্ড ম্যাগাজিনে এঁর কথা পড়েন নি?
—পুওর ম্যান সার, স্ট্রাণ্ড ম্যাগাজিন কোথা পাব? শুধু বঙ্গবাসী জন্মভূমি আর মাঝে মাঝে হিন্দু পেট্রিয়ট পড়ি।
—ইংরেজী গল্পের বই পড়েন না?
—তা অনেক পড়েছি, স্কট ডিকেন্স লীটন জর্জ ইলিয়ট আমার পড়া আছে।
—ক্রাইম স্টোরিজ পড়েন না?
—রেনল্ড্সের বিস্তর নভেল পড়েছি, মায় মিস্ট্রিজ অভ দি ফোর্ট অভ লণ্ডন।
—ফর শেম মুস্তৌফী বাবু। ওর বই ছুঁতে নেই, দেশদ্রোহী বজ্জাত লোক।
—তিনি কি করেছেন সার?
—সে লিখেছে, ফ্রেঞ্চ জাতি সবচেয়ে সভ্য, নেপোলিয়নের মতন গ্রেট ম্যান জন্মায় নি, আর ব্রিটিশ মন্ত্রীরা এতই অপদার্থ যে যত সব জার্মন বদমাশ ধরে এনে আমাদের রাজকুমারীদের সঙ্গে বিয়ে দেয়। যাক সে কথা। তা হলে আমার এই বিখ্যাত বন্ধু সম্বন্ধে আপনি কিছুই জানেন না?
রাখাল একটু কুণ্ঠিত হয়ে বলল, শুধু এইটুকু জানি, ইনি এই প্রথম এদেশে এসেছেন, কিন্তু আপনি নতুন আসেন নি।
লম্বা সাহেব আশ্চর্য হয়ে বললেন, দ্যাট্স ফাইন! আর কি জানেন মিস্টার মুস্তৌফী?
—কাল রাত্রে আপনাদের ভাল ঘুম হয় নি।
—ভেরি ভেরি গুড। আর কি জানেন?
—আপনারা কাল লংকা খেয়েছিলেন।
—লংকা? ইউ মীন সীলোন, আইল্যাণ্ড অভ রাবণ?
—আজ্ঞে সে লংকা নয়। হিন্দী নাম মিরচাই, ইংরেজী নামটা মনে আসছে না। রেড অ্যাণ্ড গ্রীন পড—হাঁ হাঁ মনে পড়েছে, চিলি, রেড পেপার, ক্যাপ্সিকম, ভেরি হট স্পাইস।
লম্বা সাহেব তাঁর বন্ধুকে বললেন, ওহে ওআটসন, দেখছ তো, সায়েন্স অভ ডিডক্শন এই বেঙ্গলী জেণ্টলম্যান ভালই জানেন। নাঃ, এদেশে শারলক হোম্সের পসার হবে না।
ওআটসন বললেন, মস্তৌফী বাবু আপনি কি ইয়োগা প্র্যাকটিস করেন?
রাখাল বলল, যোগশাস্ত্র? না, তা আমার জানা নেই। আমার বাবা কবিরাজি করতেন—ইণ্ডিয়ান সিস্টেম অভ মেডিসিন, তাঁর কাছ থেকে আমি কিছু শিখেছি। সমস্ত লক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে কারণ অনুমান করা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।
ওয়াটসন প্রশ্ন করলেন, কাল রাতে আমাদের ভাল ঘুম হয় নি তা বুঝলেন কি করে?
শারলক হোম্স বললেন, এলিমেণ্টারি ওআটসন, অতি সহজ। আমাদের মুখে মশার কামড়ের দাগ রয়েছে। আমরা মশারির মধ্যে শুই নি, পাংখাপুলারও মাঝরাত্রে পালিয়েছিল। কিন্তু আর দুটো বিষয় টের পেলেন কি করে?
রাখাল বলল, খুব সহজে। আপনি এসেই টুপি খুলে আমাকে ‘সার’ বললেন। অভিজ্ঞ সাহেবরা সামান্য নেটিভকে এত খাতির করে না। এতে বুঝলাম আপনি এই প্রথমবার বিলাত থেকে এসেছেন। ডক্টর ওআটসন টুপি খোলেন নি, আমাকে ‘বাবু’ বললেন, তাতে বুঝলাম ইনি পাক্কা সাহেব, নতুন আসেন নি, এদেশের দস্তুর জানেন।
—লংকা খাওয়া জানলেন কি করে?
—আপনার আঙুলে তামাকের রং ধরেছে, দেখেই বোঝা যায় আপনি খুব সিগারেট সিগার বা পাইপ টানেন। ডক্টর ওআটসনের সঙ্গে সিগারেট ছিল, কিন্তু আপনার ছিল না। আপনি মাঝে মাঝে জিবের ডগা বার করছিলেন, অর্থাৎ জিব জ্বালা করছে। অনভ্যস্ত লোকে লংকা খেলে এইরকম হয়, সিগারেট টানতে পারে না। ডক্টর ওআটসন পাকা লোক, লংকায় ওঁর কিছু হয় নি।
হোম্স হেসে বললেন, চমৎকার। এই ওআটসনের কথা শুনেই কাল রাত্রে হোটেলে মাল্লিগাটানি সূপ, চিকেন কারি, আর বেঙ্গল ক্লার চাটনি খেয়েছিলাম, তিনটেই প্রচণ্ড ঝাল। আচ্ছা, আমাদের সঙ্গী এই মিস্টার খাঞ্জা সম্বন্ধে কিছু বলতে পারেন?
বাঞ্ছারামকে নিরীক্ষণ করে রাখাল বলল, ইনি তো পুলিসের লোক, চুলের ছাঁট, গোঁফের তা, আর ড্রিলের কোট দেখলেই বোঝা যায়; তা ছাড়া থুতনির নীচে টুপির ফিতের দাগ রয়েছে।
বাঞ্ছারাম খাঞ্জা মাতৃভাষায় বললেন, হঃ, তুমি খুব চালাক লোক বট হে। আর ভি কিছু শুনাও তো দেখি?
—পঞ্চকোটে বাড়ি। সম্প্রতি খুব মার খেয়েছিলেন, কাঁধে আর হাতে লাঠির চোট লেগেছিল। তার জড়ানো মির্জাপুরী লাঠি, তার ছাপ এখনও চামড়ার ওপর রয়েছে।
—আমার গায়ের দাগটাই দেখলে হে? শালা বলদেও পানওয়ালাকে কি পিটান পিটাইছি তার খবর রাখ মাস্টর?
হোম্স বললেন,
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment