অর্জুন মণ্ডল
কড়া নাড়ার শব্দে উঠে বসলাম। শীতকালে এতরাত্রে কে এল আবার !
“কে—”
“আমি, আমি, কপাট খোলো।”
খুললাম। সুইচ টিপে আলোটা জ্বাললাম। দেখি খর্বকায় একটি বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। আজানুলম্বিত গলাবন্ধ খদ্দরের কোট গায়ে। মাথার সামনের দিকটা কেশ-বিরল, চোখ নিষ্প্রভ, ভুরুতে পাক ধরেছে, সমস্ত মুখে বলি-রেখা, সামনে গোটা দুই দাঁত নেই। “আমার চিঠি পাওনি নিশ্চয়?”
“না।”
“চিতুয়া পোস্ট করেনি তাহলে। শালা ডাকু। নিজে হাতে পোস্ট করলেই ঠিক হত... তাকে দেওয়াটাই ভুল হয়েছিল। ভুল, ভুল, এ জীবনটা ভুল করতে করতেই কাটল বীরেনবাবু।”
হঠাৎ অর্জুনকাকাকে চিনতে পারলাম আমি। ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বরই চিনিয়ে দিলে তাঁকে। বহুদিনের যবনিকা সরে গেল যেন।
“অর্জুনকাকা! হঠাৎ এত রাত্রে কোথা থেকে?”
“তীর্থে যাচ্ছি। ভাবলাম তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই। শহরে জিনিসপত্রও কিনতে হবে কিছু। তোমাকে এত রাত্রে ঘুম ভাঙিয়ে কষ্ট দিলাম বোধ হয়। আমার ধারণা ছিল চিঠি পেয়েছ তুমি।”
“না, না, তার জন্যে কী হয়েছে—”
“হয় নি কিছু। তোমার কাছে খবর না দিয়ে আসবার জোরও আমার আছে। কিন্তু চিতুয়াটার কথাই ভাবছি। এই সব ছোটোখাটো ব্যাপার থেকেই মানুষের ভবিষ্যৎ বুঝা যায় কি না—”
অর্জুনকাকা মাঝে মাঝে কথাবার্তাতেও শুদ্ধ ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেন। ‘বুঝা’ ‘দিব’ নিয়ে আগে কত হাসাহাসি করেছি আমরা।
“ডাকের গোলমাল হয়েছে হয়তো।”
“না, ও কথা মানব না আমি।”
অর্জুনকাকা বারান্দা থেকে নেমে গেলেন এবং গাড়ি থেকে নিজেই নিজের জিনিসপত্র নামাতে উদ্যত হলেন।
“আপনি ছেড়ে দিন না, গাড়োয়ানই নামাবে এখন।”
“কেন ওকে বেশি পয়সা দিতে যাব মিছামিছি—”
‘মিছামিছি’ও অর্জুনকাকার বিশেষত্ব!
“দাঁড়ান, আমার চাকরটাকে ডাকি তাহলে—”
“চাকরকেই বা ডাকবে কেন। আমার গায়ে জোর নাই না কি?”
অবলীলাক্রমে নামিয়ে ফেললেন সব। বিছানা, প্রকাণ্ড একটা তোরঙ্গ, লোহার উনুনও একটা। চুক্তিমাফিক গাড়োয়ানকে পাই-পয়সা মিটিয়ে দিয়ে আমার দিকে ফিরে বললেন—“কোন্ ঘরটায় শুব?”
বাইরের দিকে খালি ঘর ছিল একখানা। তাতে একটা চৌকিও ছিল। সেইটেই খুলে দিলাম। অর্জুনকাকা বললেন—“যাও, তুমি শুয়ে পড় এইবার। অনেক রাত হয়েছে। আমি এই চৌকির উপর নিজেই বিছানা বিছিয়ে নিচ্ছি। তুমি যাও।”
“আপনার খাওয়া-দাওয়া?”
“রাত্রে আমি কিছুই খাই না।”
“দুই-চারখানা লুচিটুচি ভেজে দিক না, কী আর এমন রাত হয়েছে—”
বিছানা পাততে পাততে অর্জুনকাকা বললেন—“তোমার সঙ্গে কি আমি লৌকিকতা করছি?”
চুপ করে রইলাম।
হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, “চিতুয়া এবারও ম্যাট্রিক পাস করতে পারেনি, বুঝলে?”
“নিজেই ভুগবে শালা। আমার কী—”
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
“যাও, আর রাত করো না, শুয়ে পড়ো।”
“সত্যিই কিছু খাবেন না ? ”
“দেখ, বেশি যদি পীড়াপীড়ি কর বিছানাপত্র গুটিয়ে নিয়ে স্টেশন-প্লাটফর্মে চলে যাব তাহলে।”
বুঝলাম অর্জুনকাকা বদলাননি। আর দ্বিরুক্তি না করে শুতে চলে গেলাম। শুলাম বটে, কিন্তু ঘুম এল না। অর্জুনকাকার কথাই ভাবতে লাগলাম। অর্জুনকাকার কথা বাবার মুখে খানিকটা শুনেছি—নিজেও দেখেছি খানিকটা। আশ্চর্য জীবন লোকটার। স্বাধীন দেশে জন্মালে দিগ্বিজয় করতে পারতেন। এ দেশে কিছু হল না। জাতে জেলে। চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিরক্ষর ছিলেন। মাথায় করে মাছের ঝুড়ি বয়ে নিয়ে এসে হাটে বেচতেন আমাদেরই বাড়ির সামনে। আমাদের বাড়ির ঠিক সামনেই হাট বসত। অর্জুনকাকার সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয়ের দৃশ্যটা এখনও আমার মনে আছে।
হাটে প্রচণ্ড একটা গোলমাল উঠল একদিন। চিৎকার চেঁচামেচি কলরব আর্তনাদে সমস্ত জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল যেন। একটা জায়গায় ভিড়টা জমাট বেঁধে গেল। মনে হতে লাগল তার কেন্দ্রে ভয়াবহ কী যেন একটা হচ্ছে। হঠাৎ ভিড় ঠেলে অর্জুনকাকা বেরিয়ে এলেন। তাঁর বগলে একটা রুই মাছ। বাবা হাসপাতালের বারান্দায় বসে কাজ করছিলেন। অর্জুনকাকা ছুটে এসে মাছটা দড়াম করে সামনে ফেলে বাবার পা দুটো জড়িয়ে ধরলেন।
“আমায় বাঁচান আপনি ডাক্তারবাবু, শালারা আমার সব কেড়ে নিচ্ছে।”
বাবা শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
“কি কেড়ে
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment