গণিতের আধুনিক চিন্তাধারা
গাণিতিক চিন্তার অগ্রদূতেরাঅনেকের ধারণা যে গণিত এক ধরনের স্থবির বিষয়। নিঃসন্দেহে ধারণাটি ভুল। তবে একথা সত্যি যে মানুষের ইতিহাসে এমন অনেক সময় ছিল যখন গাণিতিক চিন্তার অগ্রগতি একেবারে হয়নি। সে সব সময়ের কোনো গাণিতিক সৃজনশীলতা আমাদের নজরে পড়ে না। কিন্তু ক্রমাগত গণিতকে বোঝার ফলে ঘটতে থাকে তার বিকাশ। গাণিতিক বিকাশের প্রেক্ষিতে আমরা বর্তমান সময়কে আর সব সময়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলতে পারি।
যখন আমরা গণিত নিয়ে কথা বলছি তখন ‘কী গণিত’ আর ‘কী গণিত নয়’ সেটা জানা আমাদের জন্য বেশ জরুরি। তবে এক্ষেত্রে হয়ত সব গণিতবিদ একমত হবেন না। এ প্রসঙ্গে বার্ট্রান্ড রাসেল বলছেন, “গণিত হচ্ছে ‘p থেকে q-এ আসা যায়’ এ জাতীয় সব ধরনের প্রতিজ্ঞা (proposition)-র সমাবেশ।” বর্তমান আলোচনায় গাণিতিক পদ্ধতিকে এ ভাবে সংজ্ঞায়িত করা যথাযথ হবে যে গাণিতিক পদ্ধতি হচ্ছে একগুচ্ছ স্বতসিদ্ধ ধারণা (axiom) এবং এক সারি যুক্তিবোধ (Logic)-এর সমন্বয়। এবং গণিত, পুরোপুরিভাবে গাণিতিক পদ্ধতিগুলোর দ্বারা গঠিত একটি সুসমন্বিত অবয়ব। ধারণাটি অনেকটা রাসেলের দেয়া সংজ্ঞার সাথে খাপ খেয়ে যায়; তবে আমাদের এই আলোচনায় আমরা গণিতকে দুটো উপাদান, যথা: স্বতসিদ্ধ ধারণা এবং যুক্তিবোধের সমন্বয় বলব। সাধারণত, এ দু’টি উপাদানকে গাণিতিক বিশ্লেষণের উপাদান বলে মনে করা হয়।
যে কোনো গাণিতিক নিয়ম শুরু হয় স্বীকার্যমূলক (postulational) পদ্ধতির মাধ্যমে। স্বীকার্য বা স্বতঃসিদ্ধ বিষয়ের ধারণাটা গাণিতিক নিয়মে এতটা প্রয়োজনীয় যে অনেক সময় গাণিতিক নিয়মকে স্বীকার্যমূলক পদ্ধতি (postulational or axiomatic method) বলা হয়ে থাকে। সুতরাং, গাণিতিক নিয়মের প্রথম উপাদান হিসাবে স্বতঃসিদ্ধ ধারণার বিষয়ে বলাটা যথাযথ হবে। এ প্রসঙ্গে দেখা যায় যে আধুনিক গণিতবিদেরা স্বীকার্য (postulate) এবং স্বতঃসিদ্ধ ধারণা (axiom)-র মাঝে কোনো ভিন্নতা নির্দেশ করেননি। তবে সচরাচর স্বীকার্য, স্বতঃসিদ্ধ ধারণা এবং অনুমান (assumption) এ জাতীয় শব্দগুলোকে সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
সম্ভবত অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রি.পূ.) সবার আগে স্বতঃসিদ্ধ ধারণার বিষয়ে গভীরভাবে ভাবেন। তবে তাঁর চিন্তাধারা প্লেটোর চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকবে। অবশ্য নৈয়ায়িক বা যুক্তিবিদেরা (Logicians) অ্যারিস্টটলকে ন্যায়শাস্ত্র (Science of logic)-এর আদিপিতা বলে ভাবেন। যুক্তিবিষয়ে অ্যারিস্টটলের দেয়া বিধিবিধানগুলো নিশ্চিত ভাবেই গণিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু গণিতবিদেরা তাঁর স্বতঃসিদ্ধ ধারণা এবং আরোহী (deductive) চিন্তাভাবনা অধ্যয়নের পর তাকে উপেক্ষা করে যান। খ্রিস্টীয় ১৯০৪ সালে হেইবার্গ (Heiberg) অ্যারিস্টটলের মূল্যবান সব গাণিতিক চিন্তাভাবনার একটা সঙ্কলন করেন। সেখানে লিপিবদ্ধ অ্যারিস্টটলের উদ্ধৃতিগুলো থেকে মনে হয় যে আধুনিক গাণিতিক চিন্তার বিষয়ে তাঁর ধারণাগুলো ছিল প্রশংসনীয়।
আনুমানিক খ্রি.পূ. ৩০০ অব্দে তিনি ইউক্লিড আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে খুব কমই আমরা জানি। সম্ভবত তিনি মিশরীয় ছিলেন না। জাতিগতভাবে তিনি ছিলেন গ্রীক। তবে এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত যে তিনিই সেই মহান গণিতবিদ যাঁর হাতে গাণিতিক ধারণাগুলো প্রথমবারের মতো একটা সমন্বিত রূপ পায়। ‘দ্য এলিমেন্টস’ (The Elements) তাঁর একটি অনবদ্য কর্ম। বইটি আজকালকার স্কুলছাত্রদের কাছেও পরিচিত। বইটির মোট তের খণ্ডের ছয়টিতে (১ম, ৩য়, ৪র্থ, ৬ষ্ঠ, ১১শ এবং ১২শ) আলোচিত হয়েছে আধুনিক সরল জ্যামিতি এবং ঘন জ্যামিতির ধারণাগুলো। বইটির কতটুকু তাঁর নিজের সে সম্বন্ধে সঠিক কিছু আমরা জানিনা তবে এটা জানা গেছে যে তাঁর আগে ম্যাগনেসিয়ার থুডিয়াস (Theodius of Magnesia) জ্যামিতি বিষয়ক বই লেখেন। এছাড়াও তাঁর চিন্তাভাবনা প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের ছাত্রদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকবে। এক্ষেত্রে তাঁর মহত্ত্ব হলো যে, যে কোনো বিশ্লেষণ তিনি শুরু করেন ঐ বিষয়ক স্বতঃসিদ্ধ ধারণাগুলোর বিশদ বিবরণ ও সংজ্ঞার মধ্য দিয়ে, যা গাণিতিক চিন্তার ক্ষেত্রে একটা মাইলফলক হিসাবে কাজ করেছে। তাঁর মহতী অবদানের ভিতর যে ত্রুটি রয়ে গেছে তা হলো, তাঁর সংজ্ঞা এবং স্বতঃসিদ্ধ ধারণার অনেক কিছুই আধুনিক গাণিতিক চিন্তার থেকেই বেশ দূরে রয়ে গেছে।
স্বীকার্যমূলক গাণিতিক চিন্তার দ্বিতীয় মাইল ফলকটি স্থাপিত হয় উনিশ শতকে। বোলি (Bolyai) এবং লোবাচভস্কি ( Lobachevsky)-র হাতে যথাযথভাবেই আধুনিক গাণিতিক চিন্তার সূত্রপাত ঘটে। এই মানুষ দু’জনের প্রত্যেকে আলাদা আলাদাভাবে ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সীমানা অতিক্রম করেন এবং নির্মাণ করেন নতুন কিছু। তাঁদের কাজের ভিত্তিভূমি প্রস্তুত করে দিয়ে যান স্যাকেরি (Saccheri), গ্যাওস (Gauss) এবং অন্যরা। একুশ বছর বয়সে বোলি যখন তাঁর বাবাকে লেখেন ‘আমি একটি নতুন বিশ্বলোক নির্মাণ করেছি স্রেফ শূন্য থেকে’; ততোদিনে একটি যুগের সমাপ্তি ঘটেছে, এসেছে নতুন যুগ।
বোলি এবং লোবাচভস্কি ইউক্লিডের সমান্তরাল স্বীকার্যটি (The parallel postulate) অন্য একটি অনুমান দ্বারা প্রতিস্থাপন করেন। অনেকের মনে হতে পারে যে এ দু’জন আবিষ্কারকই এটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন যে এই বদলের ফলে উপপাদ্য (Theorem)-টি কী রূপ নেয়। তবে তাঁদের এ সুনির্দিষ্ট বদলটি জ্যামিতিতে নতুন মাত্রার সূচনা করে। ইউক্লিডের আর যেসব উপপাদ্যে এ স্বীকার্যের (৫ম স্বীকার্য) ব্যবহার নেই নতুন জ্যামিতিতে তারা টিকে আছে বহাল তবিয়তে। পুরানো জ্যামিতির অন্যসব উপপাদ্যগুলোকে এই সমাধানের মধ্য দিয়ে শেষ করা হয়েছে যে, একটি সমতলে একটি বিন্দুর ভিতর দিয়ে এমন দু’টি রেখা টানা সম্ভব যারা অপর একটি রেখার সমান্তরাল, এবং ঐ বিন্দুটির ভিতর দিয়ে অসীম সংখ্যক রেখা টানা সম্ভব যারা প্রথম রেখাদু’টির ভিতরে থাকবে এবং কোনোভাবেই অপর রেখাটিকে ছেদ করবেনা।
১৮৫৪-তে রিম্যান (Riemann) আরেক ধরনের জ্যামিতির কথা বলেন। তিনি সমান্তরাল স্বীকার্যটিকে ভিন্ন একটি অনুমানের দ্বারা প্রতিস্থাপন করেন। তিনি যে জ্যামিতির কথা বলেন তাতে রেখাগুলোর প্রত্যেকটির দৈর্ঘ্য সসীম (Finite), এবং যে কোনো ত্রিভুজের তিনকোণের সমষ্টি দুইসমকোণের চেয়ে বড়।
শিক্ষার্থীদের কাছে এ ধরনের একটি বক্তব্য অদ্ভুত এবং অসম্ভব বলে মনে হতে পারে, কিন্তু গণিতবিদদের নিকট এটি অত্যন্ত মূল্যবান একটি ফলাফল। কোনো একটি গাণিতিক পদ্ধতির অন্তর্গত স্বীকার্যকে যে একেবারে সত্য হতে হবে আধুনিকেরা তেমনটা মনে করেন না। এখন আর এটা আবশ্যক নয় যে স্বতঃসিদ্ধ ধারণা বা তার প্রয়োগের ফলে প্রাপ্ত উপপাদ্য মানুষের মনে সত্যের ধারণা যোগাবে। কিছু কিছু স্বীকার্যকে মনে হবে সত্য, কোনো কোনোটাকে মনে হবে মিথ্যা—আবার কোনোটাকে না সত্য না মিথ্যা, অর্থাৎ, তাদের প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই। তবে এটা দেখা হয় যে সেগুলো যুক্তিগতভাবে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ (consistent)। বাস্তবত: সামঞ্জস্যতা (consistency)-ই গাণিতিক চিন্তার মূল কথা। এক সেট স্বতঃসিদ্ধ ধারণাকে যথার্থ হতে হলে তাকে কতগুলো সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হয় যদিও এগুলো একজনের একান্ত ইচ্ছাধীন বক্তব্য।
স্বীকার্যমূলক পদ্ধতির জন্য উনিশ শতকে স্বীকার্যগুলোকে উচ্চতর মানসম্পন্ন হতে হবে বলা হয়। ফলে এ বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রথমে সমস্যার সম্মুখীন হন এনো (Peano), ১৮৮৯ সালে। এ-বিষয়ে বিশ শতকের গোড়ার দিকে আরও অবদান রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের ই এইচ মুর (E H Moore) এবং তাঁর অনুগামীরা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেন গোটিনজেন (Gottingen) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিলবার্ট (Hilbert)। তিনি সেখানে ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির ওপর বক্তৃতা করেন ১৮৯৮-৯৯ সালের শীতকালীন সেমিস্টারে। পরবর্তীতে তাঁর এই বক্তব্য ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনা হচ্ছে গণিতকে নতুন নতুন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে প্রকাশ করার প্রবণতা। সত্যিকার অর্থে একটা নতুন গাণিতিক পদ্ধতির জন্য যা প্রয়োজন তা হলো একসেট নতুন স্বীকার্য। যেহেতু স্বীকার্যগুলো অনেকাংশেই কোনো নির্দিষ্টতার ধার ধারে না তাই কোনো একদিকে গণিতের সাম্প্রতিক অগ্রগতি বা ক্রিয়াকর্মগুলো সহজেই বোঝা যায়।
আধুনিক গণিতের অনেক কিছুই একজন শিক্ষার্থীর কাছে অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে, অথচ তিনি যদি জানেন যে সেখানে ব্যবহৃত স্বীকার্যগুলো কী হিসাবে
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment