Banglapuran

উপক্রমণিকা (prologue)

অনেক সময়ই আমরা পত্রিকার পাতায় বা অন্তর্জালে [Internet] এই ধরনের খবর দেখে থাকি—পুঁইশাকের চচ্চড়ি খেলে এইডস হওয়ার সম্ভাবনা কমে কিংবা এই আশ্চর্য অভ্যাস আপনাকে ক্যান্সার থেকে দূরে রাখবে...ইত্যাদি। সচেতন পাঠক হয়ত এগুলোকে বিশেষ পাত্তা দেন না। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, দুটো ঘটনার মধ্যে একটিকে কারণ এবং অপরটিকে ফলাফল বলতে গেলে কী কী শর্ত মানতে হবে? আমরা কীভাবে জানি যে, কোনো একটা রোগের কারণ একটি বিশেষ রোগজীবাণু বা একসেট জীবনাচরণ? কেমন করে জানা যায় যে অমুক ওষুধ বা চিকিৎসায় তমুক অসুখটা সারে, নিছক দৈবক্রমে নয়? কারণ ও ফলাফলের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন সংক্রান্ত এরূপ প্রশ্নের মীমাংসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বিভিন্ন উপায়ে করার চেষ্টা করে। সাধারণীকরণের স্বার্থে চিকিৎসাশাস্ত্র সংশ্লিষ্ট উদাহরণের সাথে সাথে ভৌতবিজ্ঞানের অপেক্ষাকৃত সুপরিচিত কিছু উদাহরণ দেখে নেয়া যাক।

প্রথম নীতি: অনুষঙ্গ (strength of association)

দুটি ঘটনার মধ্যে কোনো একটি যেখানে উপস্থিত থাকে সেখানে যদি প্রায় সবসময় অপর ঘটনাটিকেও খুঁজে পাওয়া যায় তবে বলা যায় তাদের মধ্যে চমৎকার অনুষঙ্গ রয়েছে। যেমন: আগুনের সাথে ধোঁয়ার অনুষঙ্গ। তবে অনুষঙ্গ থাকলেই যে দুটি ঘটনার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক থাকবে, এমন নয়। যেমন: প্রাচীন মিশরীয়রা আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের বিশেষ বিশেষ অবস্থানের সাথে কৃষিকাজ ও বন্যার সময়কালের মধ্যকার অনুষঙ্গ নির্ণয় করেছিল এবং সফলভাবে তা প্রয়োগও করেছিল। তারা ধরে নিয়েছিল, গ্রহ-নক্ষত্রের সেই বিশেষ সজ্জাগুলোর কারণে দুর্ভিক্ষ আসে, ফসল ফলে কিংবা বন্যা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর বার্ষিক গতির ফলে জ্যোতিষ্কসমূহের আপেক্ষিক অবস্থান চক্রাকারে পাল্টায়। অন্যদিকে, পৃথিবীর আহ্নিক ঘূর্ণন অক্ষ তার কক্ষতলের সাথে লম্ব না হওয়ার দরুণ বার্ষিকগতির কারণে ঋতু পরিবর্তন হয় এবং কৃষিকাজ, দুর্ভিক্ষ বা বন্যার উপযোগী আবহাওয়া তাই চক্রাকারে আসে যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দুটি ঘটনার মধ্যে অনুষঙ্গ থাকলে তার অর্থ এটাও হতে পারে যে সেই ঘটনা দুটির পেছনে তৃতীয় কোনো ঘটনা লুকিয়ে আছে যা উল্লিখিত দুটি ঘটনার সাধারণ কারণ। সুতরাং, স্রেফ অনুষঙ্গ থাকলেই দুটো ঘটনার একটিকে কার্য অপরটিকে কারণ বলা যায় না। তারপরও কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অনুষঙ্গ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কেননা, দুটি ঘটনার মধ্যে যদি অনুষঙ্গ না থাকে তবে তাদের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়া বৃথা।

যারা সারাদিন শুয়েবসে কাটায়, মাত্রাতিরিক্ত আহার করে এবং বংশগতভাবে ডায়াবেটিস বা উচ্চরক্তচাপের বাহক, তাদের মধ্যে উল্লিখিত অসুখের প্রাদুর্ভাব সর্বাধিক। এটি একটি অনুষঙ্গ। তবে এখান থেকে বলা সম্ভব নয় যে বেশি খাওয়া কিংবা শরীরচর্চা না করা অথবা পূর্বপুরুষের একই অসুখ থাকা—এগুলো ডায়াবেটিস বা উচ্চরক্তচাপের কারণ। বরং সেগুলোকে চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় বলে ঝুঁকি সূচক (risk factor)। কারণ এবং ঝুঁকি সূচককে আলাদা করাটা স্রেফ ভাষাগত খুঁটিনাটির বাহুল্য নয়, এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক শিক্ষা রয়েছে। এক সময় ভাবা হত, দুর্গন্ধযুক্ত বাতাস হল কলেরার কারণ। কেননা, যে এলাকায় পুঁতিগন্ধময় পরিবেশ থাকত সেখানেই দেখা দিত কলেরার মহামারি। এজন্য কলেরার যাবতীয় চিকিৎসার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ‘বায়ু পরিবর্তন’ করা। কিন্তু আমরা পরে জেনেছি কলেরা ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ যা দূষিত পানির মাধ্যমে ছড়ায়। যেখানে পানি মাত্রাতিরিক্ত দূষিত থাকে সেখানকার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার দুরবস্থার কারণে এলাকায় দুর্গন্ধ বিরাজ করত; যেটাকে স্রেফ অনুষঙ্গের ভিত্তিতে কলেরার কারণ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছিল। পানি শোধন করাই যে কলেরার নিদান তা প্রতিষ্ঠা করতে ইংরেজ চিকিৎসাবিজ্ঞানী জন স্নোকে-কে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। কেননা, তাঁর সময়ে ইয়োরোপে প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে খারাপ বায়ুর কারণে কলেরা হয়। ইতোমধ্যে কেটে যায় বহু বছর এবং ঝরে যায় বহু প্রাণ। একারণে চিকিৎসাশাস্ত্রে ‘কারণ’ তকমাটি খুব সযত্নে আলাদা করে রাখা হয় যাতে অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।

দ্বিতীয় নীতি: সামঞ্জস্য (consistency)

দুটি ঘটনা অনুষঙ্গিত কি না তা নির্ণয়ের জন্য শুধু একটি পর্যবেণ যথেষ্ট নয়, কেননা, তা আপতনিক হতে পারে। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যবেক্ষক যখন দুটি ঘটনার মধ্যে একই ধরনের অনুষঙ্গ খুঁজে পান তখন তাদের পর্যবেক্ষণের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে বলা যায়। প্রাচীন মিশরীয়রা জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর অবস্থান এবং আবহাওয়ার মধ্যকার অনুষঙ্গ বহু বছর ধরে দেখার পর তা নিয়ম হিসেবে লিপিবদ্ধ করেছিল। তবে ধূমকেতুর আবির্ভাব যেহেতু বিরল ঘটনা তাই সেটি বারবার দেখার সুযোগ তাদের হয়নি। কোনো একবার ধূমকেতু আকাশে থাকাকালীন সময় ঘটনাক্রমে রাজ্যজুড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এজন্য তারা ধরে নিয়েছিল ধূমকেতু মানেই খারাপ কিছু। অনুরূপভাবে, সূর্যগ্রহণ প্রভৃতি তুলনামূলক বিরল জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনাগুলোকে অমঙ্গলসূচক হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। সামঞ্জস্য গড়ে ওঠার মতো যথেষ্টসংখ্যক পর্যবেক্ষণ ছাড়াই তারা এসব সিদ্ধান্তে এসেছিল। ক্রমে এগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে পৌরাণিক কাহিনি। অনেক সময় গণমাধ্যমে দেখা যায়, ক্যান্সার, এইডস বা কোনো দুরারোগ্য ব্যাধির আরোগ্য আবিষ্কৃত হয়েছে—এরকম কোনো সংবাদ বেশ চটকদার উপায়ে পরিবেশিত হয়। আবার কিছুদিন পরই জানা যায়, সেই আরোগ্য অকার্যকর! সমস্যাটা হল, চিকিৎসাশাস্ত্রের এক একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা অত্যন্ত সীমিত ক্ষেত্রে কিছু কার্যকারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে অথচ পাঠকপ্রিয়তার স্বার্থে পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয় সাধারণ বা বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হিসেবে। যেমন: একটি বিশেষ ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত কিছু ইঁদুরকে দুটি দলে ভাগ করে একটি দলকে দেয়া হল একটি নতুন ওষুধ আর অপর দলটিকে দেয়া হল প্রচলিত ওষুধ বা স্রেফ আটার দলা। যদি প্রথমোক্ত দলটির আরোগ্য লাভের হার দ্বিতীয়োক্ত দলের চেয়ে বেশি হয় তাহলে সেই গবেষণা থেকে এটুকু জানা গেল যে নতুন ওষুধটি পুরোনো ওষুধের তুলনায় [ বা কোনো ওষুধ না দেয়া হলে তার তুলনায়। ঐ বিশেষ ধরনের ক্যান্সারের জন্য ইঁদুরে তুলনামূলকভাবে অধিকতর কার্যকর। কিনিক্যাল ট্রায়ালে মানুষের উপরে ওষুধ প্রয়োগের পূর্বে প্রস্তুতিমূলক ধাপ হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ তবে তা ক্যান্সারে সার্বিক আরোগ্য কখনোই নয়। বৈজ্ঞানিক জার্নালে গবেষণার ফলাফল এভাবেই প্রকাশিত হবে, কোনো প্রকার অতিরঞ্জন ছাড়া। এই খবরটি যখন গণমাধ্যমে আসবে তখন তা অনেকটা এরকম রূপ নেবে ক্যান্সারের আরোগ্য আবিষ্কৃত! এখানে তা যে স্রেফ বিশেষ এক প্রকারের ক্যান্সারের জন্য কেবল ইঁদুরের উপর করা পরীক্ষণের ভিত্তিতে একটি বিশেষ ওষুধের বিশেষ ফল তার ব্যাখ্যা সেখানে অনুপস্থিত। আর তাই কার্যকারণ সম্পর্কের সামঞ্জস্যতার প্রসঙ্গটি দারুণভাবে উপেক্ষিত।

তৃতীয় নীতি: সুনির্দিষ্টতা (specificity)

কৃষিকাজ প্রভৃতির সাথে জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর গতি-প্রকৃতির অনুষঙ্গ শুধু প্রাচীন মিশরীয়রা ব্যবহার করত, তা নয়। প্রাচীন ভারতীয়, চৈনিক ও গ্রিক সভ্যতায়ও অনুরূপ অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হত। সেখান থেকে তারা ধারণা করেছিল, হয়ত ব্যক্তিবিশেষের ভাগ্যও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে আকাশের ঐ গ্রহ-নক্ষত্র। এভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক জ্যোতিষশাস্ত্রের উদ্ভব। অযথার্থ কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এই শাস্ত্র যে এখনও জনমানস থেকে হারিয়ে যায়নি তার নিদর্শন পাওয়া যায় পত্রিকার পাতায়। কিন্তু সমস্যা হল, আপনি যে রাশির জাতক বা জাতিকা হোন না কেন যেকোনো রাশির রাশিফল আপনার সাথে বেশিরভাগ সময় মিলে যাবে। [জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসীরা সাধারণত শুধু নিজের রাশিফলটুকু জেনে সন্তুষ্ট থাকেন এবং তার মধ্যে যেটুকু মেলে না সেটুকু ভুলে যান; এরকম আচরণের পেছনে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় আপাতত যাচ্ছি না।] অর্থাৎ কোনো একটি রাশির জন্য নির্ধারিত রাশিফল শুধু সেই রাশির জন্য সুনির্দিষ্ট নয়। অথচ কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে হলে দুটি অনুষঙ্গিত ঘটনার মধ্যে সুনির্দিষ্টতা থাকতে হয়। যেমন: আপনার ঘরে আলো জ্বালানোর সুইচ চাপলে আলোই জ্বলে, পাখা ঘোরে না। পাখা ঘোরাতে হলে ভিন্ন সুইচ চাপতে হয়।

এমন অনেক রোগ আছে যার জন্য দায়ী কারণ বেশ