সবচেয়ে কঠিন এবং সহজ কাজ
কাজটার নাম লেখাপড়া। শিশুকাল, বাল্যকাল, কিশোরকাল থেকে শুরু করে একেবারে অন্তিমকাল পর্যন্ত সব সময়েই এ-কাজটা মনের খুশীতে চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। কঠিন যে তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। মানতে হবে, কাজটা ব্যয়সাপেক্ষ। অবশ্যই ডিগ্রির টাকশালের ছাপ নিতে হলে। শুধু অনুরাগবশত পড়তে এ ছাপের প্রয়োজন হয় না। ব্যয়টাও একেকজনের কাছে এক এক ওজনের চাপের ব্যাপার। দারিদ্র্যতম এবং দুর্নীতিগ্রস্ততম এই বাংলাদেশে সবরকমের উদাহরণই আছে। মুখে কথাই ফোটেনি এমন সন্তানের লেখাপড়ার জন্য অথবা লেখাপড়ার প্রথম ধাপ প্লে-গ্রুপে খেলার জন্য মাসে লক্ষ টাকা খরচ করার বাবা-মা যেমন আছে, তেমনি এই বাংলাদেশেই আরজ আলী মাতুব্বর পড়া শুরু করেছিলেন একখানা ভিক্ষায় পাওয়া ‘আদর্শ লিপি’ এবং ভাঙা শ্লেট দিয়ে। সারা জীবনই তিনি পড়েছেন। নিজেরই ভাষায়, ‘ভিক্ষায় পাওয়া’ বা ‘চুরি করা’ বই। এই দারিদ্র্যতম দেশেই তো সবচেয়ে দামী গাড়ি, গাত্রাবরণ ও অন্যান্য পণ্যপূজার উপকরণ বিক্রি হয়। যারা এসব কিনতে পারেন তাদের পক্ষেও বই কেনা যে কঠিন তা তাদের সাথে দু’মিনিট আলাপ করলেই বোঝা যায়। আরো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের ড্রইংরুমে শুধু একবার তাকালেই। অস্বীকার করার উপায় নেই, লেখাপড়ার কাজটা কঠিন বলেই সবাই স্কুল-কলেজে যায় না। যারা যায় তাদের সকলেই শেষপর্যন্ত টিকে না। যারা টিকে যায়, শুধু যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে, তারাও সবাই পরীক্ষায় পাস করে না। যারা পাস করে তারা অধিকাংশই আর পড়ার ধারে কাছেও ঘেঁষে না। পড়ার চেয়ে লেখাটা তো আরো কঠিন। ভাগ্যিস নিয়ম আছে ব্যাঙ্কের, চেকটাতে নিজে স্বাক্ষর করতে হয়। নইলে শিক্ষিতা মহিলাদের বিশ্বস্ত স্বামীদের আরো একটা দায় বাড়তো। যত লোকের ডিগ্রি আছে, পদের ভার আছে, এমন কি পড়াশোনাও ভাল আছে, তাদের ক’জনই বা লেখে? অনেকেই বলেন, লেখাপড়ার সময় পাওয়া যায় না। ভাগ্যিস তারা সময় পান না। নইলে আমরা যারা লেখা-লেখা খেলা করি তাদের আর উপায় ছিল না।
যারা পড়েন, আগ্রহের বিষ ভেঙে তারাও অনেক শ্রেণীর। নিজের বিশ্বাস ও রুচির অনুকূলের বিষয়টি সাধারণত পাঠকরা খোঁজেন। পণ্যবাজারের যুগে লেখকরাও পাঠকের নাড়ির খবর রাখেন । উঠতি যুব-সমাজের বাজার দখল করতে হলে কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে এমন সব দৃশ্য তুলে ধরতে হবে যা মানুষ খোলাহাটে সামাজিকভাবে দেখায় না—এই তথ্য জানেন অনেক লেখক। অনেক মোহময়ী বিভাসমৃদ্ধ বক্তাও জানেন এ তথ্য এবং সুধী সমাবেশের বক্তৃতাতেও এ কৌশল তারা প্রয়োগ করেন। সিনেমায় যৌনতার ভেজাল দিলে লোকে ‘খায় ভাল’। প্রতিবাদ করবে যে, তেমন রাবণের মাথা কার আছে এ দেশে?
অনেকেই আবার মনে করেন জ্ঞান বিতরণের জন্য লেখাপড়ার কোনো প্রয়োজনও নেই। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। ভদ্রলোক পড়া এবং পড়ানোর চাকরিই করতেন। সরকারি কলেজ থেকে অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নিয়েছেন প্রায় দুই দশক হলো। সময় কাটান বেশিরভাগ গল্প-আড্ডা দিয়ে। একদিন কথা প্রসঙ্গে বললেন, “আমি তো দশ বছর ধরে খবরের কাগজটাও চোখ রাখলেই পড়তে পারি না। পাঁচ মিনিট ছাপার হরফের উপর চোখ রাখলেই আবার মাথা ধরে।”—ভাল কথা। এমন তো হতেই পারে। কিন্তু অসুবিধাটা হলো অন্য এক জায়গায়। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক হেন বিষয় নেই বা জ্ঞানেরও হেন বিষয় নেই যার সম্পর্কে উনি শেষকথা না বলতে পারেন। যেন গত দশ বছরে দুনিয়াটায় এমন কিছু ঘটেনি যা জানার প্রয়োজন আছে। ভদ্রলোক এখনো বহাল তবিয়তে সকল বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ। নিজের সম্পর্কে বক্তব্যটি দিয়েছিলেন এখন থেকে আরো দশ বছর আগে।
আরেক দিক থেকে হিসাব করলে পড়ার কাজটা সহজও বটে। ঘরে বসে বইয়ের উপর চোখ আবদ্ধ রাখলে কারো বাড়া ভাতে ছাই দেয়া হবে না। তাই মাথায় কেউ লাঠিও মারবে না। বিবাহিত, এমন কি নব্যবিবাহিত লোকের পক্ষেও দৈনিক কুড়ি পৃষ্ঠা পড়া সম্ভব। যুদ্ধক্ষেত্রেও ঈশ্বরভক্তরা উপাসনার সময় বের করে নিতে পারেন। পড়া বা জ্ঞান সাধনাও তো এবাদতই বটে। তাহলে এই হিসাবে সারা বছরে অনেক পড়া হতে পারে। আর, পড়ার জন্য খবর কি খুব বেশি? ধরা যাক, ভাল একটা চিকিৎসা শাস্ত্রের বই আপনার ঘরে আছে যা আপনাকে অনেক বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। এর অর্থ হলো খুব সীমিত টাকায় আপনি ঘরে একজন ডাক্তারকে সার্বক্ষণিকভাবে ধরে রেখেছেন। এই ডাক্তার আপনার পকেট কাটবে না।
তবে লেখাপড়ার সবচেয়ে বড় অসুবিধা একটা আছে। পড়তে পড়তে আপনার জীবনবোধ ও দর্শন এমন এক পর্যায়ে চলে যাবে যেখানে সমাজের ব্যাপক অংশ (যেহেতু তারা পড়ে না) একেবারে আপনার ধারেকাছেও ভিড়তে পারবে না। এভাবে আপনি যতই পড়বেন ততই হয়ে যাবেন সমাজবিচ্ছিন্ন। এমন কি এভাবে চলতে থাকলে এক সময়ে হয়ে যাবেন সিজোফ্রেনিক। আপনার বাড়বে জ্ঞান, ডাক্তারের বাড়বে পয়সা, ঘরে বাড়বে অশান্তি। পড়ার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানের কথা বলতে গেলে দেশছাড়া হবেন। মাথার মূল্যও ঘোষিত হতে পারে। এমন একটা অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার যে উপায়টা হতে পারে তার দায় নিতে পারে সরকার ও গোটা সমাজ। স্বাক্ষর হবার ও পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করার একটা ব্যাপক আন্দোলন হতে পারে। এটি হলে মানুষ অন্তত রোগ হলে ডাক্তারের কাছে যাবে। ছুটবে না পানিপড়া ও ঝাড়ফুঁক নিতে। পড়ায় অভ্যস্থ হলে মানুষ বুঝবে দুনিয়াটা অনেক বড়। যাতে আছে নানা মত ও পথের লোক। সকলকেই একসঙ্গে গলায় গলায় না হলেও হাত ধরাধরি করে বাস করতে হবে মহাশূন্যে ভাসমান এই নূহের নৌকায়।
মোজাফফর হোসেন
বিজ্ঞান কর্মশালা, ৩১ জানুয়ারি—১ ফেব্রুয়ারি ২০০৩
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment