পয়লা মে-র ভোর।

জেলখানার গম্বুজের ঘড়িতে বাজল তিনটে। এই প্রথম আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। এখন আমি পূর্ণ সচেতন। খোলা জানলা দিয়ে বিশুদ্ধ-হাওয়া আসছে, মেঝেয় পাতা গদির চারদিকে খেলে বেড়াচ্ছে, হাঁ, অনুভব করতে পারছি খড়গুলো লাগছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, আমার দেহের-প্রতি জায়গায় যেন হাজার বেদনা জড়িয়ে আছে। হঠাৎ জানালা খুলে দিলে যেমন সব স্পষ্ট দেখা যায়, তেমনি স্পষ্ট বুঝলাম আমার অন্তিমকাল এসেছে। আমি মরছি।

অনেক দেরি করে এলে মরণ। একসময়ে আশা ছিল, বহু বহুদিন পরে তোমার সঙ্গে হবে আমার পরিচয়। স্বাধীন মানুষ হয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কত কাজ করতেও তো চেয়েছিলাম, চেয়েছিলাম ভালোবাসতে। ভেবেছিলাম ঘুরে বেড়াব পৃথিবীতে, আনন্দে গান গাইব। তখন আমি পূর্ণ বয়স্ক, দেহে ছিল অমিত শক্তি। আর তো শক্তি নেই। উবে যাচ্ছে।

জীবনকে আমি ভালবেসেছিলাম, তারই সৌন্দর্যের সন্ধানে আমি নেমেছিলাম সংগ্রামে। তোমাদের ভালবেসেছি, হে জনগণ। যখন তোমরা ভালবাসার প্রতিদান দিয়েছ, খুশী হয়েছি। যখন আমাকে ভুল বুঝেছ, দুঃখও পেয়েছি। যদি কারো ক্ষতি করে থাকি, ক্ষমা করো। কাউকে যদি আনন্দ দিয়ে থাকি, ভুলে যেও। আমার নামের সঙ্গে যেন বিষণ্নতা না জড়িয়ে থাকে। তোমাদের কাছে এই আমার শেষ অনুরোধ। বাবা, মা, বোন, আমার গাস্তা আর কমরেডরা—যাদের আমি ভালোবাসি তাদের কাছে আমার এই অনুরোধ। যদি মনে করো চোখের জল বিষাদের ম্লান ধুলো ধুয়ে দিতে পারবে, তবে ক্ষণেকের জন্য কেঁদো, কিন্তু দুঃখ করো না। আমি আনন্দের জন্যই বেঁচে ছিলাম আজ আনন্দের জন্য, মানুষের সুখের জন্য মরছি। আমার কবরের উপর আজ বিষাদের দূতকে ডেকে আনলে তো অবিচারই হবে।

পয়লা মে! এমনি ভোররাত্রে আমরা শহরতলীতে জেগে উঠে তৈরি হতাম। এই মুহূর্তে মস্কোর পথে পথে প্রথম দলটি প্যারেডের জন্য তাদের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। ঠিক এই মুহূর্তে লাখো লাখো মানুষ আজাদীর জন্য লড়ছে শেষ লড়াই, হাজার হাজার প্রাণ দিচ্ছে সংঘর্ষে। তাদের একজন হতে পারায় সুখ আছে, হাঁ শেষ লড়াইয়ের একজন সৈনিক।

কিন্তু মরণে তো আনন্দ নেই। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ছাড়তে পারছি না নিঃশ্বাস। গলায় ঘড়ঘড় শব্দ শুনতে পাচ্ছি, আমার আশেপাশের কয়েদীদের হয়তো জাগিয়ে দেবো। একটু জল খেলে বোধহয় আরাম পাব...কিন্তু পাত্রে তো জল নেই। আমার থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে কুঠরির ঠিক কোণে শৌচের জল রাখবার পাত্র, ওতে প্রচুর জল আছে। সে জল গড়িয়ে খাবার মতো শক্তি হবে কি?

বুকে ভর করে, আস্তে আস্তে চলেছি—যেন কাউকে না জাগানোর ভিতরেই রয়েছে মৃত্যুর সমস্ত মহিমা। শেষে পৌঁছালাম এসে। লোভীর মতো শৌচের জল পান করছি।

কতক্ষণ লাগল জানি না, বুকে ভর দিয়ে ফিরে যেতেই বা কত দেরি হল তাও জানি না। আবার চেতনা লোপ পাচ্ছে। কব্জি চেপে ধরে নাড়ি খুঁজছি, কিন্তু পাচ্ছি না। প্রাণ যেন গলায় এসে ঠেকেছে, লাফাচ্ছে। আবার নিস্তেজ হয়ে পড়ল। আমিও পড়লাম অবশ হয়ে, কতক্ষণ পড়ে রইলাম কে জানে।...

মৃত্যুর সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়া হয়েই ছিল। আমরা জানতাম, গেস্টাপোর হাতে পড়া মানেই সমাপ্তি। তাই ধরা পড়বার পরে আমাদের নিজেদের মধ্যে এবং অন্যদের সম্পর্কেও যথাবিহিত কাজ করে যেতাম।

আমার জীবননাট্য এখানে উপসংহারের দিকে চলেছে। সে তো লিখতে পারব না, সে কেমন হবে তা জানি না। না, এ আর নাটক নয়। এই তো-জীবন।

সত্যিকারের জীবনরঙ্গে তো দর্শক নেই : সবাইকেই ভূমিকা গ্রহণ করতে হয়।

শেষ অঙ্কের যবনিকা উঠেছে।

বন্ধুগণ, তোমাদের আমি ভালোবাসতাম। হুঁশিয়ার থেকো।

৯ জুন ১৯৪৩

জুলিয়াস ফুচিক
অনুবাদ: অশোক গুহ

[রাভেনসব্রুকের বন্দীশালায় আমারই এক বন্দী সাথীর কাছ থেকে শুনেছিলাম, আমার স্বামী জুলিয়াস ফুচিক বার্লিনের এক নাৎসি আদালতে ১৯৪৩ সালের ২৫শে অগাস্ট প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন।
তাঁর অদৃষ্টে

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion