দেনা
সময়টা তখন অগ্রহায়ণের শেষ। শীত পড়েছে বেশ। উত্তরে হাওয়া বইছে। গা-কাঁপিয়ে, রক্ত জমিয়ে আনে বুঝি। আকাশে মেঘের দেখা নেই। গাঢ় নীল রঙের আকাশটা ঝক্ ঝক্ করছে রঙের দীপ্তিতে।
রাস্তার দুপাশে বিস্তৃত ধানের খেত। সোনালী ফসলের চোখ-জুড়ানো সমারোহ। ধানের শীষের উপর রাতের শিশির টল টল করছে আর সকাল বেলার সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছে রূপোলি বিন্দুর মতো।
একছিলিম তামাক টানবার জন্য কাস্তেটা পাশে রেখে বসল প্রাণকেষ্ট। মালসার ঘুঁটের আগুনটা উসকে দিল হাত দিয়ে। অন্ধকার থাকতেই ধান কাটতে বেরিয়েছে সে। কড়া শীতে হাত দুটো অবশ হয়ে এসেছে। একটু গরম হয়ে নেবে সে তামাক টানতে টানতে। গায়ে জড়ানো পাতলা কাঁথাটা কাজে ব্যাঘাত ঘটালেও ছাড়তে পারছে না।
পায়ের নিচে কাদা কাদা নরম মাটি বরফের মতো ঠাণ্ডা। বড়ো আরাম লাগছে স্তুপীকৃত ঘাসের পরে আরাম করে তামাক টানতে আর আগুনে হাত গরম করতে। কিন্তু আরাম করবার সময় নয় এটা। মাথার উপর পর্বতপ্রমাণ কাজের ভার। ধান কাটতে হবে, আঁটি বাঁধতে হবে। বাড়িতে ধানের আঁটি নিয়ে গিয়ে আছড়িয়ে ধান ঝাড়াই করতে হবে। তারপর খড় আলাদা করে রাখতে হবে টাল মেরে। অর্ধেক ধান আর খড় বুঝিয়ে দিতে হবে জমির মালিক যদু পরামানিককে। বাকি অর্ধেক থেকে বিক্রি করে শোধ করতে হবে দেনার টাকা।...চার বিঘের এই ছোট জমিটা চাষ করতে তার খরচ হয়েছে একশ কুড়ি টাকা। তার মধ্যে একশ টাকাই দেনা করেছে প্রাণকেষ্ট। কাটতে-ছিঁড়তেও কি কম টাকা লাগবে? সবশুদ্ধ প্রায় পয়তাল্লিশ টাকার মতো পড়েছে বিঘে প্রতি। কিন্তু কতই বা ধান হবে মোটমাট। তামাক টানতে টানতে ধানের দিকে শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকাল প্রাণকেষ্ট।
‘এক টান হবে নাকি গো দাসের পো?’ পাশের জমিতে ধান কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করল বুড়ো তমিজুদ্দিন। পুরো এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে প্রাণকেষ্ট বলে—‘এসো না চাচা, তামাক আছে এখনো।’ কলকেটা খুলে সে এগিয়ে ধরে তমিজুদ্দিনের দিকে।
বাঁ হাতের তালুতে কলকেটা চেপে ধরে হাতে মুখ রেখে টানতে থাকে তমিজুদ্দিন।
‘বিঘে ভুঁই কত করে ফলন হবে এবার চাচা?’
‘ফলন? তা বেশ ভালোই ফলন হবে এ বছর। কুড়ি ছয়েক আন্দাজ ধান পাওয়া যাবে। তা বাদে, ন' পোনটাক খড় পাওয়া যাবে বিঘে পড়তায়।’ কলকেটা হুঁকোর মাথায় বসাতে বসাতে জবাব দেয় তমিজুদ্দিন।
ছ’ কুড়ি মানে পাঁচ মণ ধান! আড়াই মণ পাবে ফল, পরামানিক বাকিটা সে নিজে। কাস্তে ধরে ধান কাটতে কাটতে ভাবে প্রাণকেষ্ট। কিন্তু কত আর দাম পাবে! বারো টাকা যদি দর পায়, তবে আড়াই মণেরই দাম হবে তিরিশ টাকা। খড়ের দাম টাকা তিনেক। অর্থাৎ টাকা তেত্রিশ পাবে সবশুদ্ধ। ভালো ফসল পেয়েও কি লোকসান গুনতে হবে? ভেবে শঙ্কিত হয়ে ওঠে প্রাণকেষ্ট। প্রতি বছরই মোটা লোকসান গুণতে হচ্ছে আজকাল। চাষ করে খরচের টাকাও ওঠে না। আস্তে আস্তে দেনদার হয়ে পড়ছে সে। গত বছর দেনার দায়ে শেষ সম্বল দু বিঘে জোতের জমিটাও ডিক্রি দিয়ে নিয়েছে মহাজন হরিধন সা। কথায় বলে, আশায় মরে চাষা; তা তারও হয়েছে তাই। এ বছরও একশ টাকা দেনা করেছে স্বরূপ নস্করের কাছে। ‘খাই না খাই, ওটুক আগেই শোধ করে দেব। নইলে টান পড়বে শেষে ভিটে ভদ্রাসনে। ওটুক যদি যায়, মাথা গোঁজার ঠাঁইও থাকবে না শেষকালে।’—ভাবতে ভাবতে শিউরে উঠল প্রাণকেষ্ট। ভাঁটা পড়ল কাজের উৎসাহে। দেনা, দেনা, দেনা! এত দেনা হয় কেন তার? সারা বছরই তো খেটে চলেছে অশ্রান্ত। খাটতে সে গররাজিও নয়। কিন্তু দুঃখ তবু বাড়ে বৈ কমে না কেন?... এলোমেলো চিন্তার জট মাথায় নিয়ে সে কাস্তে চালাতে থাকে নিচু হয়ে।
‘বাবা, পান্তা।’
ম্যালেরিয়াগ্রস্ত দশ বছরের হাড্ডিসার ছেলেটা খাবার নিয়ে এসেছে।
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment