[সাহিত্যিকের জবানবন্দি]

রাজনীতি আমার জীবনে কখনো আলোচ্য বিষয় ছিলো না। বাল্যকাল থেকে জেনেছি আমি কবি, আমি সাহিত্যিক, আমার মধ্যে যা-কিছু ভালো যা-কিছু খাঁটি তা রচনাচর্চাতেই একান্তে প্রয়োগ করেছি। এ-ব্যাপারে যেমন প্রবল আন্তরিক উৎসাহ অনুভব করেছি এবং আজ পর্যন্ত করি, তেমন আর কিছুতেই করি না এ-কথা স্বীকার করতে আমার বাধা নেই। ভালো লিখবো, আরো ভালো লিখবো আমার সমস্ত জীবনের মূল প্রেরণাশক্তি এই ইচ্ছার মধ্যে নিহিত। এই রসের রাজ্যে অধিষ্ঠিত হয়ে রাজনীতির কোলাহল কখনো ভালো করে আমার কানে পৌঁছয়নি। তারপরে আমার অন্তরের অবজ্ঞাই অনুভব করেছি। তার কারণ রাজনীতি বলতে বুঝেছি কপটাচরণ, ক্রুরতা, ধূর্ততা, ক্ষণিকের স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য ধ্রুব আদর্শের অবমাননা। শিল্পী মনের পক্ষে ও বস্তু বিশেষ লোভনীয় হতে পারে না।

রাজনীতির যে একটা বড়োরকমের সংজ্ঞা আছে তার প্রত্যক্ষ পরিচয় পরাধীন দেশে পাওয়া সহজ নয়। আমাদের অ্যাসেমব্লি সভার বিতর্ক, আমাদের মন্ত্রীদের বক্তৃতা সবই যেন একটি অনুষ্ঠান মাত্র, তার পিছনে যথার্থ শক্তি নেই আর তাই এর অবাস্তবিকতা এক-এক সময় দুঃসহ হয়ে ওঠে। যার সঙ্গে বাস্তব জীবনের যোগ এত ক্ষীণ তার সম্বন্ধে সাধারণ লোকের উদাসীন হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তবু এই পরাধীন দেশেই কখনো কখনো এমন একটি বিরাট আন্দোলন আবর্তিত হয়ে ওঠে যা সমগ্র দেশবাসীকে বিদ্যুৎস্পর্শে সচকিত করে তোলে, এবং জাতির জীবনে স্থায়ীভাবে তার চিহ্নও রেখে যায়। এমন একটি আন্দোলনের দিন এসেছিলো বঙ্গভঙ্গের সময়, তখন আমাদের জন্ম কাল। সে সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার কিছু নেই; কিন্তু বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গানে ও প্রবন্ধে যে ফসল তা ফলিয়েছিলো তা থেকে তার তীব্র উদ্দীপনাটি হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করতে পারি। তার পরের বড়ো আন্দোলন গান্ধিজির অসহযোগ, তখন আমি নিতান্ত বালক। সে-হুজুগে মেতেছিলাম, চটের মতো মোটা খদ্দর পরেছিলাম, যে সব যুবকেরা সাত দিন, এক মাস কি তিন মাসের জন্য জেলে গিয়েছিলেন তাঁদের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধায় ও ঈর্ষায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে ছিল, এক বছরের মধ্যে স্বরাজ আসবে না এমন অসম্ভব কথা যে বলে তাকে মনে মনে মূঢ় বলতে প্রস্তুত ছিলাম—কিন্তু আজ পিছনে তাকিয়ে দেখছি বালক বয়সের অন্যান্য অনেক উত্তেজনার মতোই সে হুজুগ আমার মন থেকে নিঃশেষে মরে গেছে, কোনো চিহ্ন রাখেনি। আমার গঠনে অসহযোগ আন্দোলনের কোনো হাত নেই।

তারপর মহাত্মার দ্বিতীয় আন্দোলন, তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বছর। আর সেই সঙ্গে পূর্ববঙ্গে সন্ত্রাসীদের রক্তাক্ত অভ্যুদয়। ছিলেম ঢাকায়; একদিকে ভারতব্যাপী সত্যাগ্রহের তুমুল বিপর্যয়, অন্যদিকে স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ হত্যার উন্মত্ততা—চাটগাঁর অস্ত্রাগার লুঠ, খবরের কাগজ ও সিগারেট বন্ধ, গাঁজাখুরি গুজবে সমস্ত দেশের মাথা খারাপ হবার দশা—সব মিলিয়ে ১৯৩১-এর সেই গ্রীষ্মকাল আমার মনে নিদারুণ একটি স্মৃতি হয়ে আছে। লজ্জার বিষয় হলেও স্বীকার করবো দেশব্যাপী এই দুমুখো আন্দোলনে আমি অবিচলিত ছিলেম, আমার প্রাণে কোনো সাড়া জাগেনি। আমি তখনো বসে বসে একান্তচিত্তে সাহিত্যচর্চা করেছি, হয়তো সেটা খুবই লজ্জার কথা, কিন্তু সত্য গোপন করবো না। মহাত্মাজি আমাদের সকলেরই প্রণম্য, কিন্তু তাঁর আন্দোলনে কোনো উদ্দীপনা অনুভব করেনি এমন লোক আমি ছাড়াও দেশে হয়তো আছে। এদিকে সন্ত্রাসবাদের একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে যেটাকে বলা যেতে পারে রোম্যান্টিক, শিল্পী মন তা থেকে যে সহজে অব্যাহতি পায় না তার প্রমাণ রবীন্দ্রনাথও ‘চার অধ্যায়’ না লিখে পারেননি। সন্ত্রাসবাদ জিনিসটাই রোম্যান্টিক রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি হিসাবে তা যতই ভ্রান্ত হোক, নৈতিক বিচারে যতই দুষ্য হোক, এর মধ্যে একটা প্রচণ্ড নাটকীয়তা আছে যা সাহিত্যিকের পক্ষে লোভনীয়। সাহিত্যের উপাদান হিসেবে এর অভিনবত্ব আছে এবং এ নিয়ে যে অসংখ্য গল্প উপন্যাস বাংলা ভাষায় লেখা হয়নি তার কারণ অবশ্য বাইরের বাধা।

এখানে একটা

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion