প্রেমচন্দের এই প্রবন্ধটি প্রেমচন্দের শেষ রচনা, মৃত্যুর দু'মাস আগে লেখা। তাঁর মৃত্যুর পরে ১৯৩৬ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যা “হংস” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। নিবন্ধগুলির মধ্যে এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এটি পড়লে বোঝা যায়, প্রেমচন্দ, কত দ্রুত ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের স্বরূপ বুঝতে পেরেছিলেন ও সোভিয়েট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল্য বিচার করে তাকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সেজন্য এই নিবন্ধটি প্রেমচন্দের টেস্টামেন্ট ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর বিরোধিতার বলিষ্ঠ সাক্ষ্য।

“মজুদ এ দিল মসীহা নফ্‌সে মী আয়দ;

কি জ অনফাস খুশশ বুএ একসে মী আয়দ। "

[“হৃদয়, তুই প্রসন্ন হ—মুক্তিদাতা তোর দিকে এগিয়ে আসেন সশরীরে, দেখিস্ নাকি জনতার নিঃশ্বাসে কার সুগন্ধ ভেসে আসে।”]

সামন্ততান্ত্রিক সভ্যতায় মজবুত শরীর আর বলিষ্ঠ বাহু জীবনের অত্যাবশ্যক বস্তুর মধ্যে পরিগণিত হত—আর রাজতন্ত্রে সেখানে বুদ্ধি, বাকনৈপুণ্যে আর অবনতশিরে আজ্ঞাপালনই ছিল আবশ্যকীয় উপকরণ। এ-দুয়ের ভিতরেই অবশ্য দোষের সঙ্গে সঙ্গে গুণের অংশও বিদ্যমান ছিল। মানুষের শুভ ইচ্ছা ও সুন্দর অনুভূতিগুলি তখন একেবারে বিলুপ্ত হয়নি।

সামন্তবাদী প্রভু শত্রুর রক্তে নিজের পিপাসা মেটালেও, অনেক সময়ই বন্ধু বা উপকারীর জন্য নিজের প্রাণবিসর্জনেও পরাঙ্মুখ হননি। নিজের আদেশকে আইন মনে করতেন সম্রাট, বাদশাহ। তাঁর হকুম তামিল না করাটা কোনোমতেই বরদাস্ত করতে পারতেন না তিনি। এ সত্ত্বেও তিনি প্রজাপালন করতেন এবং ন্যায়নিষ্ঠ ছিলেন। পররাজ্য আক্রমণের পিছনে থাকত হয় প্রতিশোধ-আকাঙ্ক্ষা নয়তো আত্ম-গৌরব ও প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করবার ইচ্ছা কিংবা দেশবিজয় আর রাজ্যবিস্তারের বীরোচিত প্রেরণা। প্রজার রক্তশোষণ কোনো সময়েই তাঁর দেশবিজয়ের উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ রাজা এবং সম্রাট কোনো দিনই জনসাধারণকে তাঁর স্বার্থসাধন ও ধনসঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত যুদ্ধের ইন্ধন বলে মনে করেননি। তাদের সুখে-দুঃখে অংশভাগী হতেন তাঁরা, সমাদর করতেন তাদের গুণাবলীর।

কিন্তু পুঁজিবাদী সভ্যতার গোড়ার কথাই হল অর্থ—সমস্ত কাজের মূলে এক দুর্বার অর্থ পিপাসা। কোনো দেশে রাজ্যশাসন জমানোর মূলেও আছে মহাজন, পুঁজিপতিদের ক্রমবর্ধমান মুনাফা অন্বেষণ। এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে মনে হয় যেন আজ পুঁজিপতিদেরই রাজত্ব।

মনুষ্যসমাজ আজ দু'ভাগে বিভক্ত। বড় অংশটায় আছে তারা, যাদের মৃত্যুই বিধিলিপি আর ছোট, খুবই ছোট অংশের মালিক তারা, যারা নিজেদের শক্তি আর প্রভাবে বড় অংশটাকে নিজেদের তাঁবে রেখেছে। জনগোষ্ঠীর এই বিরাট অংশটার জন্যে তাদের বিন্দুমাত্রও সহানুভূতি নেই, নেই কোনোরকম সুযোগ-সুবিধা দেবার ক্ষীণতম সদিচ্ছা। তাদের অস্তিত্বের প্রয়োজন কেবল এই জন্য যে, তারা মালিকের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলবে, বুকের রক্ত জল করবে আর একদিন নিঃশব্দে বিদায় নেবে পৃথিবীর বুক থেকে। সবচেয়ে দুঃখের কথা এই যে, শাসকশ্রেণীর এই চিন্তাধারা তাদের ভিতরেই সীমাবদ্ধ নেই—অনুপ্রবেশ করেছে শোষিত-শ্রেণীর ভিতরেও। ফলে প্রত্যেকেই নিজেকে মনে করছে শিকারী আর তাদের শিকারের লক্ষ্য হয়েছে সমাজ। সে যেন সমাজনিরপেক্ষ—সমাজ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। সমাজের সঙ্গে যদি কোনো সম্বন্ধ একান্তই থেকে থাকে সে শুধু তাকে ধোঁকা দিয়ে ছলে, বলে, কৌশলে যতটা সম্ভব মুনাফা দোহন করে নেওয়া।

মানুষের চিন্তা জুড়ে বসে আছে অর্থলোভ—পুরোপরি গ্রাস করেছে সে তার চিন্তার জগৎকে। কৌলিন্য, শিষ্টতা, গুণ এবং যোগ্যতার একমাত্র নির্ধারিত নিরিখ হয়েছে—অর্থ। অর্থের মালিক দেবতুল্য ব্যক্তি—যত কলুষিতই হোক না কেন তার অন্তঃকরণ। সাহিত্য, সংগীতকলা অর্থের বেদীতে সকলেই আনতশির। এ বায়ু এত বিষাক্ত যে, এর ভিতর প্রাণধারণ করা ক্রমশই কঠিন হয়ে উঠছে। যদি ডাক্তার কিংবা হেকিম হন, তাহলে লম্বা ফি ছাড়া কথাই বলেন না। উকিল কিংবা ব্যারিস্টার হন তো মিনিট মাপবেন মোহরের হিসাবে। গুণ আর যোগ্যতার সাফল্য পরীক্ষা হয় তার আর্থিক মূল্য দিয়ে। মৌলবী কিংবা পণ্ডিতমশাই পর্যন্ত তাদের বিনি পয়সার গোলাম। খবরের কাগজ তারই সুরে বাঁধা। অর্থ মানুষের চিন্তা-শক্তিকে এমন করে দখল করে নিয়েছে যে, তার রাজ্যকে কোনো দিক দিয়েই আক্রমণ করা একান্ত

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion