ভারতীয় দর্শনের বস্তুবাদী ঐতিহ্য
হোয়াট ইজ লিভিং এ্যাণ্ড হোয়াট ইজ ডেড ইন ইণ্ডিয়ান ফিলসফি
লেখক: দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশক: পিপলস পাবলিসিং হাউস, নতুন দিল্লী
প্রকাশকাল: ১৯৭৬
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৬৫৫
ভারতীয় দর্শনের বস্তুবাদী গোষ্ঠীর কথা বাইরের দুনিয়ায় বিশেষ কিছু জানা নেই । কিন্তু আপাত-বিরোধী মনে হলেও একটা ঘটনা হল, ঊনিশ শতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মুখপাত্রগণ এবং ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির পশ্চিমী গুণগ্রাহীরা ভারতীয় দর্শনকে অতীন্দ্রিয়বাদ ও অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে একাত্ম করে দেখেছিলেন। এর মধ্যে প্রথমোক্ত গোষ্ঠী এটা “প্রতিপন্ন” করেছিলেন যে অন্য জগতের প্রতি আসক্তি ভারতীয়দের বৈষয়িক লক্ষ্য অনুসরণে ও স্বশাসনের ক্ষমতা বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর শেষোক্ত গোষ্ঠীর বিশ্বাস ছিল যে, “পশ্চিমী সভ্যতার” নোংরা বিষয়-লিপ্সার সত্যিকার প্রতিষেধক হলো ভারতীয় দর্শন ।
এর সঙ্গে একটা মানানসই ঘটনা হল, তিলক, গান্ধী ও আমাদের মুক্তি আন্দোলনের অন্যান্য নেতারাও “পশ্চিমী বস্তুবাদের উপর ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন” করে গিয়েছেন। তাঁরা এই বিষয়টির মধ্যে ভারতবাসীর আত্মমর্যাদায় ও রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করার এবং এই দেশের সভ্যতা যে অন্ততপক্ষে আমাদের দেশের বিজয়ী শাসক ইংরাজদের সমকক্ষ, সেটা প্রমাণের হাতিয়ার খুঁজে পেয়েছিলেন। এর ফলে এই আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল যে, ভারত নিশ্চয়ই স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে ।
নানারকম পরিস্থিতির জন্যে ভারতীয় দর্শন ও ভাববাদ (ভারতে একে সাধারণভাবে অধ্যাত্মবাদ বলা হয়) বহু মানুষের মনে অচ্ছেদ্য বলে প্রতীত হয় । ভারত ও ভারতের বাইরে এই ধারণাটি বেশ শক্তভাবে বহাল রয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মার্ক্সবাদী পণ্ডিত অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ভুল প্রমাণ করেছেন।
এই আলোচ্য গ্রন্থটি ছাড়াও তাঁর অন্যান্য রচনাবলীতে এটা দেখানো হয়েছে যে, বহু নামজাদা ভারতীয় দার্শনিক বস্তুবাদের প্রতি অনুগত ছিলেন, যদিও তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রধান সামাজিক দর্শন হয়ে উঠতে পারেনি। এটা নিঃসন্দেহে সত্যি যে, অত্যন্ত কল্পনাপ্রবণ, অন্তর্মুখী ভাববাদী চিন্তাধারার দর্শন হিসেবে বেদান্ত প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে ভারতের প্রধান দর্শনের স্থান অধিকার করে আছে। যুগ যুগ ধরে এই দর্শন ক্রমশই জটিলতর হয়ে উঠেছে। বেদান্তের এই প্রাধান্যের কারণ হল, সমাজে যেসব ভাবধারা প্রাধান্য বিস্তার করে, সেগুলো শাসক শ্রেণীরই স্বীকৃত ভাবধারা । ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা একত্রে ভারতীয় সমাজে আধ্যাত্মিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে রূপ দিয়েছিল, তারাই সবসময় তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে বেদান্তকে তুলে ধরে । এই বেদান্তই অত্যাচার ও নিপীড়ন এবং বর্ণ-ব্যবস্থার কাঠামো পোক্ত করার পক্ষে দার্শনিক যুক্তি যুগিয়েছিল। আর এই বর্ণ-ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল শূদ্রেরা—ভারতীয় সমাজের মেহনতী মানুষ। সমস্ত খ্যাত-নামা ভারতীয় শাস্ত্রকারও বেদান্তকে উচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। আমাদের দেওয়ানী ও ফৌজদারি বিধিতে এরই প্রতিফলন ঘটেছিল ।
এখানে এটা উল্লেখ করা দরকার যে বেদান্ত হিন্দু ধর্মের ব্রহ্মতত্ত্ব। প্রতিটি হিন্দুর মুক্তির পথ এতে দেখানো হয়েছে । বেদ-বিরোধিতা ক্ষমাহীন স্বধর্মত্যাগের শামিল, কঠোর বর্ণাশ্রম-ভিত্তিক সমাজ থেকে বহিষ্কারের যোগ্য । এর থেকেই বোঝা যায় ভারতীয় মানসে বেদান্তের শক্তি কতখানি ।
অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, এর অর্থ এই নয় যে ভারতীয় বস্তুবাদী দার্শনিকরা ও সম্প্রদায়গুলো সাহসের সঙ্গে অনবরত বেদান্তকে চ্যালেঞ্জ করেননি।
আমরা এখানে ভারতীয় দর্শনের সমস্ত বস্তুবাদী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যসূচক চিন্তাধারাগুলোকে বিস্তারিতভাবে বলতে চাই না । এখানে আমরা শুধু সেইসব বিষয়ের উপরই গুরুত্ব দেব যেগুলো ভাববাদের বিরুদ্ধে অভিন্ন আকারে তাদের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিল। অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থে এগুলো আলোচনা করেছেন।
সমস্ত ভাববাদী বা অজ্ঞাবাদী (agnostic ) দার্শনিকদের মতো বেদান্তও ঘোষণা৷ করেছিল যে, পরম সত্ত্বার প্রকৃতি যুক্তি, ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ ও বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। এটা ঠিক যে, কিছু বৈদান্তিকও পঞ্চভূতের সীমাবদ্ধ ও আংশিক সত্তা এবং ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণের অভিজ্ঞতার যাথার্থ্য মেনে নিয়েছিলেন কিন্তু প্রায় কান্টের মতোই তাঁরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে এই অভিজ্ঞতা থেকে এটা প্রমাণিত হয় না যে পরম সত্তাকে উপলব্ধি করা গিয়েছে। অন্যেরা এই মর্মে বার্কলির যুক্তি হাজির করে বলেছিলেন, সমস্ত ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষই মনের প্রতিবিম্ব, এগুলো বিমূর্ত, বাস্তব নয় ।
বিভিন্ন ভারতীয় বস্তুবাদী সম্প্রদায়, বিশেষ করে লোকায়তপন্থীদের কৃতিত্বজনক দিক হল, বস্তুবাদীদের মধ্যে তাঁরাই ছিলেন সবচেয়ে অনমনীয় ও সংগ্রামী। তাঁদের মধ্যে নানারকম পার্থক্য সত্ত্বেও তাঁরা এই কথার উপর জোর দিয়েছিলেন যে, বাস্তব ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা এবং এই অভিজ্ঞতাজাত সিদ্ধান্ত যথার্থ জ্ঞানকে পরখ করার নির্ভরযোগ্য ভিত্তি।
বস্তু বা ভৌত পদার্থের “আদি” রূপ সম্পর্কেও বস্তুবাদীরা ভিন্নমত পোষণ করতেন । লোকায়তদের মত ছিল, ক্ষিতি, অপ, মরুৎ ও ভেক্ত-ই (অগ্নি) ভৌতপদার্থের আদিতম রূপ । অপর একটি দার্শনিক সম্প্রদায় সাংখ্যের মতে আদিতম বস্তু হল একটা অব্যক্ত পিণ্ডবৎ অবস্থা ৷ ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের মতে আদি বস্তু পরমাণু দ্বারা গঠিত, যদিও তাঁদের পরমাণু সংক্রান্ত ধারণা ছিল সাদা-মাটা ও ব্যবহারিক প্রকৃতির । কিন্তু এই তিনটি সম্প্রদায় ও অন্যান্য বস্তু-বাদী গোষ্ঠী এই সম্পর্কে একমত ছিলেন যে, চৈতন্য, আত্মা ইত্যাদি ভৌত পদার্থজাত, তাই এরা অপ্রধান, এর বিপরীত নয়। এঙ্গেলস উল্লেখ করে গিয়েছেন, বিশ্বের দর্শনের ইতিহাসে বস্তুবাদী ও ভাববাদীদের মধ্যে এটাই বিভাজন রেখা ।
জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, চিকিৎসা বিজ্ঞান, বিশেষকরে শারীরবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান ও শল্যশাস্ত্র, সর্বোপরি এর মধ্যে প্রথম দুটি বিজ্ঞান অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মতো প্রাচীন ভারতেও অত্যন্ত উন্নত স্তরে পৌঁছেছিল, এটা এখন প্রকাশ পেয়েছে। আর একটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল মোটামুটিভাবে আমাদের বিজ্ঞানীরা বস্তুবাদী সাংখ্য সম্প্রদায়ের অনুগামী ছিলেন, বেদান্তের নয়। প্রকৃতপক্ষে সাংখ্য অভিজ্ঞতাভিত্তিক, প্রয়োগমূলক জ্ঞান চর্চার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিল ও তাতে উৎসাহ যুগিয়েছিল, আর বেদান্ত কার্যত এগুলোর নিন্দাই করেছিল।
বুদ্ধ ও তাঁর প্রথম দিকের অনুগামীরাই প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদকে ভাষা দিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ্যবাদ আদিম গোষ্ঠী সম্পর্ক ভেঙে পড়ার ও শ্রেণী-ভিত্তিক রাষ্ট্রের উদ্ভবের সময় বর্ণভেদকে একটা পবিত্র বস্তু করে তুলেছিল। মানুষের দুঃখ-কষ্টের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বুদ্ধ বেদ, ব্রাহ্মণ ও আত্মাকে এবং শেষ পর্যন্ত বস্তুবাদী বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গির কতকগুলো উপাদানও বর্জন করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্ম একটা ভিন্নরূপ নেয় ৷ এই সঙ্গে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অগ্রগতি যথেষ্ট না হওয়ায় এবং হিন্দুদের সামাজিক কাঠামোর জন্যে লোকায়ত ছাড়া ভারতের অন্যান্য বস্তুবাদী সম্প্রদায় ভাববাদের সঙ্গে বহুরকম আপস করে। তাই অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় আধুনিক, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশের ক্ষেত্রে ভারতীয় বস্তুবাদের অবদানকে উচ্চস্থান দিয়েও তাদের ত্রুটিবিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতার সুস্পষ্ট উল্লেখ করেছেন । ভারতীয় বস্তুবাদের জন্ম-দুর্বলতাকে তিনি এইভাবে প্রকাশ করেছেন : বস্তুকে কে প্রথম “ধাক্ক৷” দিয়েছিল এটা প্রমাণ করতে অথবা কোনো অদৃশ্য, অতীন্দ্রিয় শক্তির কাছ থেকে এই ধাক্কা এসেছিল—এই বৈদান্তিক বক্তব্যকে খণ্ডন করতে তারা ব্যর্থ হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাদের বিরোধীদের সঙ্গে গুরুতর আপস করেছিল।
যে-বিষয়ের উপর লোকায়ত ছাড়া অন্যান্য বস্তুবাদীরা আত্ম-সমর্পণ করেছিলেন তা ছিল প্রধানত ধর্মভিত্তিক, দর্শন ভিত্তিক নয়, তাঁরা মৃত্যুর পর যুক্তি লাভকে (সংস্কৃতে একে মোক্ষ বলা হয় ) মেনে নিয়েছিলেন ।
আলোচ্য গ্রন্থটিতে ভারতীয় বস্তুবাদের সমস্ত ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলোকে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। লেখক ভাববাদী ও বস্তুবাদী দার্শনিকদের মূল রচনা থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ভারতীয় দর্শনের ভাববাদী ও বস্তুবাদী ঐতিহ্যের মধ্যেকার বিতর্কের সঙ্গে বর্তমান ভারতীয় সমাজের ভাবাদর্শগত চাহিদার সম্পর্ককে তিনি দেখিয়েছেন ৷ লেখক গুরুত্বের সঙ্গে বলেছেন, বর্তমানকালের সর্বাত্মক অগ্রগতির ফলে আজ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে জীবন ও তার সমস্যা সম্পর্কে একটা যুক্তিসঙ্গত, বস্তুবাদী ও সমাজতন্ত্রমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের। অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় খুব যোগ্যতার সঙ্গে এটা প্রকাশ করতে পেরেছেন যে, আমাদের দর্শনের বস্তুবাদী ঐতিহ্যের, সমস্ত সীমাবদ্ধতা ও আপসপ্রবণতা সত্ত্বেও এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশের ক্ষেত্রে এই ঐতিহ্যই পথ প্রদর্শকের
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment