[শেষের দিকে কৃষণ চন্দরের একটি সাক্ষাৎকার নেন মুম্বাইয়ের উর্দু পত্রিকা ‘সাব-রং’। কৃষণ চন্দরের মৃত্যু হয় ১৯৭৭ সালের ৭ মার্চ। পত্রিকাটি জানায় এটিই কৃষণ চন্দরের দেওয়া শেষ সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারটি ঈষৎ সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হলো। মূল উর্দু থেকে অনুবাদ করেছেন বিখ্যাত অনুবাদক জাফর আলম]

প্রশ্ন: আপনার প্রথম গল্পের নাম কি এবং তা কিভাবে সৃষ্টি হয়?

উত্তর: আমার প্রথম গল্পের নাম “ঝিলামের বুকে নৌকা বিহার”। গল্পের উৎস ঝিলাম নদীতে নৌকা বিহারের পটভূমি। তখন ঝিলাম নদী পারাপারের জন্য গায়ালিয়া থেকে নৌকা ছাড়তো। নৌকায় চড়ে ঝিলাম নদী পাড়ি দেয়ার সময় এই গল্পের প্লট আমার মনে দেখা দেয়।

প্রশ্ন: সমালোচকদের মতে, আপনি শুধু কমার্শিয়াল গল্প লিখে থাকেন।

উত্তর: আমি অথবা উর্দু-সাহিত্যের অন্য কোন লেখকই কমার্শিয়াল হতে পারে না। কারণ আমাদের দেশে একজন লেখক তাঁর গল্পের সম্মানী পান অতি সামান্য। একজন প্রথম সারির লেখক গল্পের জন্য সম্মানী বা দক্ষিণা দুশো টাকার বেশি পান না। যদি মাসে আপনি একটি গল্প লেখেন তা হলে এই টাকায় কয়জন লোকের অন্ন সংস্থান করবেন? এতো গেল খ্যাতনামা লেখকের কথা। অন্যান্য লেখকরা ২৫ টাকা থেকে ৫০ টাকার বেশি সম্মানী পায় না। এই টাকায় সামান্য একটি পাখির অন্নও জোগানো সম্ভব নয়। অথচ উন্নত দেশে লেখকদের কদর আছে। সেখানে একজন সাধারণ গল্পকারও তার রচনার জন্য কমপক্ষে এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা সম্মানী পেয়ে থাকেন। আমি লেখকদের শ্রম ও কষ্টের জন্য লেখার সম্মানী বৃদ্ধির পক্ষপাতী।

প্রশ্ন: গল্প রচনার ব্যাপারে আপনি কি কোনো শিহরণ অনুভব করেন? এই ব্যাপারে আপনার অবচেতন মনে কি ধরণের চেতনার উদ্রেক হয়?

উত্তর: যে-কোন সৃষ্টিশীল রচনা এক বিচিত্র অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার ফসল। ধরুন, একটি বিষয়বস্তু আজ আপনার মনে উদয় হলে। এবং তা দিনে দিনে মনের গহনে দানা বেঁধে চললো। হয়তো দীর্ঘ দশ বছর পর আপনার গল্প বা উপন্যাস পূর্ণ রূপ নিয়ে সৃষ্টি হলো। অনেক সময় গল্প বা উপন্যাসের প্লট কল্পনারাজ্যকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে যে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গল্পের সৃষ্টি হয় অথবা এক মাসেই উপন্যাসের রচনা শেষ হয়। উদাহরণ স্বরূপ আমার প্রথম উপন্যাস 'সিকান্ত' এর রচনা মাত্র ২৭ দিনে শেষ হয়েছিল। অন্যদিকে 'একটি গাধার আত্মকাহিনী' শীর্ষক জনপ্রিয় উপন্যাস মাত্র ৭ দিনে রচিত হয়েছে। আবার “পাঁচ লোফার" উপন্যাসটি লিখতে আমার দীর্ঘ সাত বছর সময় লাগে। সব গল্প ও উপন্যাস রচনার আগে ও পরে এক বিচিত্র অনুভূতি ও মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করি এবং রচনার কাজ শেষ হলে অদ্ভুত এক আনন্দ আমার হৃদয়-মনে দোলা দেয়।

প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন লেখকদের জন্য মদ্যপান একান্ত আবশ্যক?

উত্তর: সাহিত্য সৃষ্টির জন্য কোনো মাদকদ্রব্যে অভ্যাস বা মদ্য পানের মোটেই প্রয়োজন নেই। উদাহরণ স্বরূপ, আমি কোন কিছু লেখার আগে মদ তো দূরের কথা এমন কি কিছু আহার পর্যন্তও করি না। খালি পেটেই আমার শ্রেষ্ঠ রচনাগুলি লিখে শেষ করেছি। অবশ্য এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। অনেকে নাকি মদ পান না করে লিখতে পারেন না। রতন নাথ সরাসরি মদ পান করেই লিখতে বসেন এবং “ফসানায়ে আজাদ" নামক বিখ্যাত গ্রন্থ তিনি এভাবেই শেষ করেছেন।

প্রশ্ন: আপনি কিসে প্রভাবান্বিত হয়ে গল্প লেখার দিকে আকৃষ্ট হন?

উত্তর: প্রধানত মুন্সী প্রেমচান্দ ও সুদর্শনের গল্প পড়েই উর্দু গল্প লেখার প্রতি আকৃষ্ট হই। যদিও আমি প্রথমত, আলেফ লায়লার কাহিনী ও পরবর্তীকালে রবি ঠাকুরের গল্প পড়ে বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে পড়ি অবশ্য পর্যায়ক্রমে রুশ লেখক তলস্তয়, তুর্গেনিভ, চেখভ, গোর্কি এবং অনেক ক্ষেত্রে মোপাসাঁ, ও হেনরির গল্প ও উপন্যাস আমাকে প্রভাবান্বিত করেছে।

প্রশ্ন: আপনার দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকের মাপকাঠি কি?

উত্তর: যিনি বিষয়বস্তুর সূক্ষ্ম দিকগুলোর প্রতি বিশেষ সজাগ দৃষ্টি রেখে গল্পের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী ও পরিবেশের প্রতি যিনি যতই উপযুক্ত রূপে সজাগ এবং সুন্দরভাবে তার প্রতিচ্ছবি আকর্ষণীয় ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন, তিনিই সবচেয়ে ভালো লেখক বা সাহিত্যিক। শুধু বর্তমান যুগেই নয় সব যুগেই এই ধরনের লেখকের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় এবং তার আবেদন হয় চিরস্থায়ী। তাতে প্রেম, পুণ্য কর্ম, প্রভুত্ব, মানবতা ও জীবনের শিক্ষা অবশ্য থাকবে, তবে তা ছায়াছবির আকারে নয় বরং গল্পের বা উপন্যাসের আঙ্গিক চরিত্র ও ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে। নায়ক-নায়িকার কার্যাবলীতে এই শিক্ষার বাণী পরোক্ষভাবে প্রচারিত হবে।

প্রশ্ন: অনেক উর্দু লেখক যৌন বিষয়ক রচনায় নিজেদের শক্তিক্ষয় করে থাকেন, আবার তারা আধুনিক কালের প্রথম শ্রেণীর লেখক বলে দাবী করেন। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি?

উত্তর: 'সেক্স' মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি নিজেও আমার রচনায় অনেক ক্ষেত্রে যৌন-জীবনকে বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছি। সেক্স ছাড়া মানুষের জীবন থেকে অন্য অনেক কিছু বেছে নেয়ার বিষয়বস্তু রয়েছে। তাছাড়া এমন অনেক সমস্যা আছে যা আমার বা আপনার দৈনন্দিন জীবনে দিন দিন দুঃখ ও বেদনার বোঝা ভাবাক্রান্ত করছে। অবশ্য বৰ্তমান দুর্নীতি ও ভেজালের জমানায় কতিপয় শক্তিধর ও প্রভাবশালী শ্রেণীর কার্যাবলীর ফলশ্রুতি সামাজিক অনাচার ও অবিচার। যার ফলে সেক্সকে সাহিত্য থেকে অনেক ক্ষেত্রে বাদ দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। লেখক প্রথম শ্রেণীর হোন বা তৃতীয় শ্রেণীর হোন নিজের প্রতিভাকে শুধুমাত্র সেক্সের জন্য অপচয় করা অপব্যয় ছাড়া কিছু নয়।

প্রশ্ন: আপনার চলচ্চিত্র জগতে আগমন কিভাবে ঘটে?

উত্তর: ১৯৪৪ সালে পুনার সালিমার পিকচার্স এর মালিক ডাবলু জেড আহমদ আমাকে জোস ও সাগর সাহেবের সঙ্গে তার 'চিত্রনাট্য ও কাহিনী রচনা' বিভাগে একটি চাকরি দেন। তখন থেকে চিত্রজগতে সংলাপ রচয়িতা হিসেবে আমার নতুন জীবন শুরু হয়। আমার কাহিনী-ভিত্তিক নির্মিত 'মন কি জীত' ছবি সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করে।

প্রশ্ন: আপনি কি কোন ছবি তৈরি করেছেন?

উত্তর: জী হাঁ। 'সরায়ে কি বাহের' ও 'রাক' নামে দুটি ছবি নির্মাণ করেছিলাম। কিন্তু দুটো ছবিই আমার সব আশা-ভরসাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। তাই এখন শুধু ছবির কাহিনী ও সংলাপ রচনা করে থাকি। এ পর্যন্ত ত্রিশটি ছবির কাহিনী ও সংলাপ রচনা করেছি।

[এশিয়ার খ্যাতনামা লেখক কৃষণ চন্দরের এক সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য আমি তাঁর কাছে ফোনে নিবেদন করলাম। তিনি তক্ষুনি রাজী হয়ে গেলেন এবং সময় ও তারিখ নির্দিষ্ট করে দিলেন। আমি যথাসময়ে কৃষণ চন্দরের বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। সন্ধ্যা সমাগত। কলিং বেল টিপতেই সহাস্য মুখে দরজা খুলে তিনি বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। ঠোঁটে তার অমায়িক হাসি। তাঁর আন্তরিকতা দেখে আমি মুগ্ধ হই।—সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী]

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion