মোগলের বলবান অশ্ব কিংবা তীক্ষ্ণধার তরবারির রাজনীতি না এলেও এদেশে এসে যেত হাফেজ-ওমর খৈয়াম-আরব্য রজনী-গজল গান-মোল্লা নাসিরুদ্দিন। কেননা কলমের ডগা দ্রুততম অশ্বের চেয়েও চিরকাল দ্রুতগামী, কেননা তীক্ষ্ণ তরবারির চেয়ে গল্প অনেক অনায়াসে দেশ জয়ে সক্ষম। কাজেই সেই সব গল্প কাহিনী বাতাসের বেগে উড়ে এল এবং জুড়ে বসল আমাদের সাহিত্যিক সাধ আহ্লাদের অন্নব্যঞ্জনে। মরু প্রান্তরের বেদুইন জীবনের গভির এই ঠিকানা পেয়ে উল্লসিত হল আমাদের লেখক ও পাঠক। খেত খামার ফল ফসল গৃহসুখ নিয়ে তৃপ্ত সীমাবদ্ধ আমাদের লোকজীবন কখনো বা নিজেকে ছড়িয়ে দেবার জন্য রূপকথা লোককথা বনিযেছে। শব্দকে তালে লয়ে বেঁধে কখনো বা বানিযেছে ছড়া। সমাজের একতলাব সাহিত্য এরকমই ছিল।

সাহিত্যের দোতলায় রাজারাজড়াদের সভা। সেখানে পণ্ডিত ওস্তাদদের কাব্য চর্চা, সঙ্গীত সাধনার রাজকীয় আয়োজন। প্রধানত সংস্কৃত ভাষার চর্চিত সাহিত্য-ব্যাকরণ-দর্শন-কাব্য-মহাকাব্য। সাহিত্য চর্চা শাস্ত্রচর্চার সামিল। সমাজের উলুখাগড়াদের জীবনে তার স্পর্শ লাগে না। এ বাজা যায, ও রাজা আসে। দোতলায় কিছু এদিক ওদিক হলেও একতলায় বদল হয় না ৷

মোগল আমল যখন এল, সমাজে ও সংস্কৃতিতে অনেক ঢেউও এল। মানুষের মনলোক নিজের নিয়মেই নিজেকে যখন ভাঙতে ও গড়তে থাকল তখন তার প্রতিবিম্বও চিত্রিত হতে থাকল রূপে রসে। উপমা রূপকে সব সাহিত্য নিজের সঙ্গে মিল খুঁজে বেড়ায়। এই প্রক্রিয়াব এক সময় রূপকথার বন্দিনী রাজকন্যা উদ্ধারের সঙ্গে সমান রোমাঞ্চকর মনে হতে থাকে আলাদিনের দৈত্য, আলিবাবার ডাকাত হত্যা, আলিফ লায়লার দুঃসাহস।

আমরা এরকম প্রত্যেকটি কল্পকাহিনীর গোড়ায় সমাজবাস্তবতার অনেক শেকড় বাকড়ের সন্ধান পাবো। নির্যাতিত নারীর অন্তর্বেদনা, পুরুষের প্রভূত্ববিলাস, বিত্ত ও বিত্তহীনতার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক উপাদান দিয়ে নির্মিত বলেই বাংলার গ্রাম ও আরবের মহল্লার মধ্যে সেতুবন্ধনের সময় লাগেনি। আমরা তার সবিস্তার বিশ্লেষণে যাবো না। আমরা কেবল বুঝতে চাই যে ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যের বীজ এদেশে সযত্নে অঙ্কুরিত ও সাগ্রহে পল্লবিত হবার অবকাশ পেয়েছিল। গজল গানের ব্যাকুল আর্তি ভারতীয় সঙ্গীতকে অনন্য আবেগে শুধু প্লাবিত করল তা নয়, উর্দু ভাষা এদেশের সাহিত্যে ফোটাল জীবনের রক্তগোলাপ। কাঁটায় আহত কিন্তু জীবনাবেগে দীপ্ত যে মানুষ তার শিল্পরূপকে সম্ভব করে তুললেন পারঙ্গম সাহিত্যিকবৃন্দ। দেখা গেল সাদাৎ হোসেন মিন্টো, খাজা আহমদ আব্বাস, প্রেমচন্দ, সর্দার জাফরি ভারতীয় সাহিত্যে নতুন আলো হাওয়া নিয়ে এলেন। অনড় ঐতিহ্য ও সংস্কারের গোড়ায় ঘা বসালেন। সাহিত্যকে দাঁড় করিয়ে দিলেন কান্না ঘাম রক্তে ভেজা ভারতবর্ষের মুখোমুখি। সমাজে সুখ দুঃখের যে চাপা দোলাচল থাকে তার জায়গায় এঁরা এনে দিলেন সরাসরি রাজনৈতিক দর্শন ও সমাজ বাস্তবতা। এবং সারা দুনিয়ার যে অবিসংবাদী মানবিক শক্তি সমাজতন্ত্র, তার আলোয় উদ্ভাসিত করলেন মানুষ ও তার সমাজকে। উর্দু সাহিত্যকে সহস্র ধন্যবাদ, সাহিত্যকে সে রণসজ্জায় সজ্জিত করে দিল। সজ্জাদ জহীর, মলীহ, আবাদী, সাগির নিজামী, হাফেড় জলন্ধরী, আহমদ আলী, রশিদ জাহান প্রমুখ সাহিত্যিকবৃন্দ বুঝিয়ে দিলেন কেন পরাধীন দেশের মানুষের মতো পরাধীন দেশের সাহিত্যকেও সশস্ত্র সংগ্রামে নামতে হয়। প্রতারণা ও বঞ্চনার বেশে, বদমায়েসি ও দাসত্বের বেশে যে শত্রুরা সামনের ও পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, তাদের চিনতে যেমন চোখ লাগে, তাদের মোকাবেলা করতেও লাগে শব্দের বল্লম, অভ্রান্ত লক্ষ্য এবং মরিয়া তাগিদ। আমরা উর্দু সাহিত্যের (এবং হিন্দি সাহিত্যেরও) মহান কলাকার প্রেমচন্দের মুখে শুনি—

(১) যে নিপীড়িত, বঞ্চিত, পদদলিত- সে ব্যক্তিই হোক বা সমষ্টিই হোক— তার পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলা তাঁর দায়িত্ব।

(২) এটা অবশ্য অবধারিত যে মহাজনী সভ্যতা আর তার স্তাবকেরা নিজেদের সমস্ত শক্তি দিয়ে এই নবান সমাজ ব্যবস্থার বিরোধিতা করবে, এর সম্বন্ধে নানা মিথ্যা প্রচার চালিয়ে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করবে, তাদের চোখে ধুলো দেবে, কিন্তু যা সত্য একদিন তার জয় হবেই।

আল্লাম ইকবালকে বলতে শুনি—

জীবন রহস্য যদি তুমি খোঁজ

পাবে না তা সংগ্রাম ছাড়া কোনোখানে।

একি লজ্জা! নদী বিশ্রাম নেয় সাগরের কোলে।

প্রেমচন্দ ১৯৩৬ সালে প্রগতিশীল লেখক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছেন। তখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধেনি ফ্যাসিবাদের নখদণ্ডের হিংস্র আঁচড় তিনি দেখেননি। কিন্তু এই কলমকা সিপাহী বুঝে নিয়েছেন মানুষের মৌলিক দুটি ভাগ। বুঝে নিয়েছেন প্রভুত্বের পদাঘাতকে প্রতিহত করার জন্য চাই যথেষ্ট প্রস্তুতি। নয়ত তিনি বলতে পারতেন না—

'যারা অর্থলোভী, সাহিত্যের মন্দিরে তাদের স্থান নেই। এখানে শুধুমাত্র সেই সব ভক্তের ঠাঁই হবে যাঁরা জনসেবাকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বলে বিশ্বাস করেন, যাঁরা হৃদয়ে গভীর বেদনা অনুভব করার ক্ষমতা রাখেন আর প্রকৃত ভালোবাসার শক্তিতে শক্তিমান হয়ে উঠতে পারেন।

আমরাই অগ্রনী সৈনিক; আমরাই সমাজের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরি।' তিনি যতটা এগোলেন, উত্তরসূরী কৃষণ চন্দের উপর পড়ল আরও হাজার কদম এগিয়ে যাবার ভার। কৃষণ চন্দর তাঁর অকম্পিত পা বাড়ালেন তাঁর জীবনের পথে ও সাহিত্যের পথে।

ঠিক জায়গাটি খুঁজে নিতে দেরি হল না তাঁর। তাঁর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে নানা বিষয় জানার জন্য যোগাজনের নিবন্ধাবলী আছে। আমরা কেবল সেইটুকু উল্লেখ করব যেটুকু আমাদের আলোচনার পরিপুষ্টির জন্য দরকার।

পরাধীন ভারতে এই সাহিত্যিরে জন্ম। মৃত্যু কিন্তু স্বাধীন ভারতে। জীবনের প্রথম পঁচিশ বছর বৃটিশ শাসনের বিষাদে ভরা, পরের পঁচিশ বছরেও মৌলিক তফাৎ কিছু পান নি স্বাধীনতার স্বাদে। এ বিষয়ে বারো আনা ভারতবাসীর অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিল আছে। বাকি 'ভাংশ 'ভাবশা পেয়েছেন স্বাধীনতাব সার অংশ। একেবারে লাট বড়লাট থেকে মিনিস্টার ডিরেকটার ইস্তক ছোট বড় মাঝারিরা হানলে পড়েছিলেন বৃটিশ পরিতাক্ত ভারতের উপর, ভাগাড়ে শকুন লেমন পড়ে। গান্ধী টুপি পরা, তেরঙ্গা ঝাণ্ডা ওড়ানো, জনগণমন গাওয়ার উম্মাদনা থিতিয়ে গেলে দেখা গেল ভারত সত্যিই একটি অর্থনৈতিক ভাগাড়। হাতের হুঁকোটি নিয়ে সার পড়েছে ইংরেজ। এখন ধোয়া শোঁকাতেই মনোনিবেশ করতে হচ্ছে। সাক্ষর শতকরা সতোরো, দারিদ্র্যসীমা লজ্জাজনক রেখায়। খিদে মেটাবার খাবারে টান। মাথা গোঁজার ঠাই এমনিতেই কম। তার উপর স্বাধীনতার খোঁজে উচ্চাদের নিজের দেশ ছেড়ে আসতে হল। একী স্বাধীনতা? ঘর থেকে উপড়ে এনে মানুষকে জড়ো করল রেলের প্ল্যাটফরমে, পথে ঘাটে, কবরে গোরস্তানে। নারীর ইজ্জত পুরুষের সম্ভ্রম নিয়ে শেয়াল শকুনে কাড়াকাড়ি। সদ্য স্বাধীন দেশ কোথায় খুশিতে ডগমগ হবে, তা না, মানব সভ্যতা সেদিন ভারতবাসীকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল। (বস্তুত মানুষের সেই লাঞ্ছনা অপমানের নতুন নতুন উদাত্ত অধ্যায় আকীর্ণ হয়ে উঠছে এশিয়া ও ইউরোপে আজও। কে সভ্য, কারা উন্নত? যারা মারছে তারা? নাকি যারা মরছে তারা? 'বিশ্বব্যাপী সাদা কালো সাকার নিরাকার কত ঈশ্বর ভগবানের ছড়াছড়ি। কেউ কিন্তু ঠেকাতে পারছে না গুণ্ডাব ছুরি কিংবা বৈজ্ঞানিকের রোমা)। ফাঁদে পড়া বগার মতো দশা ভারতমাতার। উঠগো ভারতলক্ষ্মী আদি জগজ্জনপুজ্যা—বলে দলা কাটিয়ে গান গেয়েও দাড় করানো যাচ্ছে না কোমর ভাঙা রুক্ষকেশী ভারতমাতাকে।

ভারতসভ্যতার এই সংকটকে কাছ থেকে দেখতে হয়েছে কৃষণ চন্দরকে। হাড়ে হাড়ে টের পেতে হয়েছে স্বাধীন ভারতের ত্রিমাত্রিক সমস্যাকে। এক, ধনীর শোষণ। দেখা যাচ্ছে ভারতের ধনীদের শোষণ প্রক্রিয়ায় মাথায় গান্ধী টুপি ও পরনে খদ্দর ছাড়া নতুন কিছু চোখে পড়ে না। দেশপ্রেমের পতাকা গলায় জড়িয়ে গরীব মারার রণকৌশল আরও আধুনিক হয়েছে মাত্র। দুই, ভারতকে মাতা টাতা বলে যতই ভক্তি গদগদ হোক, ভারতের গড়পড়তা নারী গোমাতার সম্মানটুকুও পাচ্ছে না। ভারত যেন ধনীর ও সবলের সহজলভ্য হারেম। নারীর শিক্ষা কম, খাবার কম, অধিকার কম, মজুরি কম। দু-একজন ইন্দিরা গান্ধী, সরোজিনী নাইডু, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত বাদ দিলে বাদবাকি নারীরা শরৎচন্দ্রের রাজলক্ষ্মী, অভাগী অথবা রবীন্দ্রনাথের নিরুপমা। লক্ষ্মীবাঈ

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion