ক্রিকেটের ইন্দ্রজাল
আজকের পরিস্থিতি-কণ্টকিত আর বিবৃতি-বিড়ম্বিত এই যুগে ক্রিকেট সম্বন্ধে লিখতে বেশ একটু যেন স্বস্তি বোধ হচ্ছে। লিখতে যে মন চাইছে, তার প্রধান কারণ হল দুটো। এই কদিন আগে কানপুরে অস্ট্রেলিয়ান দলের সঙ্গে দ্বিতীয় ‘টেস্টে’ আমাদের খেলোয়াড়রা জয়ী হয়ে ভারতের মলিন মুখচন্দ্রমাকে উদ্ভাসিত করেছে, ক্রিকেটের ক্ষেত্রে সম্প্রতি ক্রমাগত যে লাঞ্ছনা আমাদের সহ্য করতে হয়েছে তাকে দূর করার সম্ভাবনা দেখিয়েছে। আর দ্বিতীয় কারণ এই যে দলীপসিংজীর মৃত্যু উপলক্ষে লেখা নেভিল কার্ডস্-এর প্রবন্ধ পড়ে মনে হল : বাংলাভাষায় এমন লেখা আমরা কবে দেখব!
ক্রিকেট-লেখক হিসাবে নেভিল কার্ডস্ হলেন একেবারে অনন্য; আর কারও লেখায় ক্রিকেটের ইন্দ্রজাল এমন শোভা নিয়ে দেখা দিয়েছে বলে জানি না। দুটি বিষয়ে তাঁর লেখার খ্যাতি; এক হল ক্রিকেট, আর দ্বিতীয় হল সঙ্গীত ৷ তাল, মান, লয়ের কারবার যা শোনা যায় শুধু তাই নিয়ে নয়, যা শোনা যায় না, তা নিয়েও। সঙ্গীত আর ক্রিকেটের যে নৈকট্য, তা হয়তো একটু মন দিয়ে ভাবলে খুঁজে পাওয়া শক্ত নয় ৷
জবরদস্ত বন্ধুবান্ধব এ সব কথায় পলায়নী মনোবৃত্তি লক্ষ্য করে রুষ্ট হবেন। কিন্তু লৌকিক শাস্ত্রেই তো বলে যে অনেক সময় পালিয়ে বাঁচা যায় ৷ সঙ্গীতেরই মতো ক্রিকেটের মধ্যে হয়তো এই পলায়নী ভাব কতকটা আছে; প্রচুর অবসর নিয়ে সেই অবসরের চর্চা উভয় ব্যাপারেই একান্ত প্রয়োজন ৷ এই কারণে ক্রিকেটের উপর আমাদের অনেকে খড়্গহস্ত ছিলেন। “ছিলেন” বলছি এজন্য যে রাজনীতিকের। কানপুরে ভারতীয় দলের জয় নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন—আশ্বাস হচ্ছে যে ক্রিকেটের নামে যাঁরা নাসিকা কুঞ্চন করতেন, হয়তো একটু ভোল বদলানো দরকার মনে করছেন।
নিজেই যখন রাজনীতি ব্যাপারে লিপ্ত রয়েছি, তখন আমার পক্ষে রাজনীতিকদের সম্বন্ধে এই কটাক্ষ অবান্তর ও অসঙ্গত মনে হতে পারে।
কিন্তু বড় দুঃখেই এভাবে লিখতে হয়েছে। হয়তো অনেকেরই স্মরণ হবে যে বছর চারেক আগে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান রায় কয়েকজন পার্শ্বচরের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করেছিলেন যে কলকাতার ঈড্ন্ গার্ড্ন্সে ফুটবল, ক্রিকেট প্রভৃতি সর্বৈব খেলার জন্য একটা স্টেডিয়ম বানানো হবে ৷ যে অকর্মণ্যেরা রঞ্জি স্টেডিয়কে অসম্পূর্ণ করে রেখেছে, তাদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া এবং কলকাতার মানুষের বহুদিনের কামনা স্টেডিয়ম তৈরি করে সুখ্যাতি পাওয়া, এই দুই পাখি একঢিলে মারার মতলব তখন বেশ এগিয়েছিল। আমার বেশ মনে আছে যে ১৯২৫ সালের ১৫ই আগস্ট পশ্চিম বাংলা কংগ্রেসের বড় কর্তা শ্রীযুক্ত অতুল্য ঘোষ ফতোয়া দিলেন যে শীঘ্রই ঈড্ন্ গার্ড্ন্সে হরেক রকম খেলাধুলার জন্য “composite stadium” তৈরি করা হচ্ছে। কলকাতার লোক ফুটবল পাগল, সুতরাং স্টেডিয়মের দরকার যখন খুবই বেশী, তখন যেখানে হোক, যেমন করে হোক, স্টেডিয়ম বানানো হোক, এই হিসাব করে এবং কংগ্রেসদল একাই যাতে স্টেডিয়ম তৈরির জন্য বাহবা না পায়, সেজন্য তখন ডাইনে এবং বাঁয়ে যত পার্টি আছে, তারা কেউই “composite” স্টেডিয়মের বিরোধিতা করল না। তারা সবাই ভুলে গেল যে আমাদের এই নরম মাটির দেশে একই ‘পিচ’-এ ছ’মাস ফুটবল খেলার পর ক্রিকেটের দফা রফা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, ভুলে গেল যে কলকাতায় ভালো জিনিস যখন প্রায়ই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে তখন ক্রিকেটের পক্ষে সব চেয়ে সরেশ যে পিচ এখানে রয়েছে তাকে নষ্ট করা একটা রীতি মতো অপরাধ ৷ যাই হোক্, সুযোগ বুঝে বিধানবাবু এগিয়ে চললেন, ঈডন্ গার্ডনস্ কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পত্তি বলে দিল্লীতে তদ্বির করলেন, দুনিয়ার মধ্যে সেরা এই ক্রিকেট ‘পিচ’-এর দিন ফুরিয়ে এসেছে বুঝে ক্রিকেটের প্রতি যাদের প্রকৃত দরদ তারা অসহায় বোধ করলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে তখনকার ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সভাপতি, কেন্দ্রের একজন ডেপুটি মন্ত্রী (যিনি পূর্বে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে নেমেছিলেন) আমায় বললেন যে কংগ্রেস দলে বিধানবাবু এমনই হোমরাচোমরা ব্যক্তি যে তাঁর জেদকে ঠেকানো বিশেষ মুশকিল আর প্রধান মন্ত্রীর কানে কথাটা ভালো করে না তুললে উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত প্রধান মন্ত্রীকে দিয়েই হস্তক্ষেপ করানো হয়েছিল। ঈড্ন্ গার্ড্ন্সের ‘পিচ’ বাঁচল এইভাবে, কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এ-ব্যাপারে সাহায্য মেলেনি, বরঞ্চ সে তরফ থেকে এসেছিল বাধা।
যাই হোক, এ সব কথা লিখতে বসিনি, একটু অপ্রাসঙ্গিকভাবেই এসে গেল। কানপুর টেস্ট ম্যাচে জাসু পাটেলের বোলিং আর আমাদের ভারতীয় দলের জীবস্মৃত অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার সুলক্ষণ দেখে এমন কথাই লিখতে মন যায় যাতে অপ্রসন্নতা কেটে গিয়ে ক্রিকেটের জাদুকরীর ছোঁওয়া একটু মেলে ৷
ছেলেবেলায় আমাদের বইয়ে ঠাসা বাড়িতে একখণ্ড “The Jubilee Book of Cricket” খুঁজে পেয়েছিলাম; লেখক স্বয়ং রঞ্জিৎ সিংজী। বাড়ির উঠোনে এবং সামনে গলিতে জায়গা সংকুলান হলেও শীতকালে পরিত্যক্ত টেনিস বল নিয়ে ক্ৰিকেট চলত; তাকে ‘বেলে-খেলা’ বলাই উচিত, কিন্তু নাওয়া-খাওয়া ভুলে তাতেই প্রায় মেতে থাকা যেত। আর মাঝে মাঝে শনি-রবিবার বাবার সঙ্গে ঈড্ন্ গার্ড্ন্সেও যাওয়া হত; খেলা বিশেষ না বুঝলেও ক্রিকেট মাঠের তখনকার আবহাওয়ার সঙ্গে ছেলেবেলাতেই পরিচয় হয়েছিল।
ফুটবলের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনই ক্রিকেটের বেলায় বলা চলে যে আমাদের স্বাদেশিকতাকে স্ফূরণ ও বর্ধন করতে এ-সব খেলার অবদান কম ছিল না। ইংরেজদের নিছক নিজস্ব খেলাতে আমাদের দেশের লোকের কৃতিত্ব দেখে বা তার গল্প শুনে তখন বুক দশহাত হত। এখনও মনে আছে, ঈড্ন্ গার্ড্ন্সে খেলা দেখতে দেখতে কিংবা অবসরের সময় চারদিকে গল্প হচ্ছে বোম্বাইয়ের Quadrangular সম্বন্ধে—তখন হিন্দু, মুসলিম, পার্শী আর ইয়োরোপীয় এই চার ‘জিম্খানায়’ খেলা হত, দেশের সেরা খেলোয়াড়রা চারদিক থেকে বোম্বাইয়ে জড়ো হতেন। কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে কিংবা ঝালচানা চিবোবার ফাঁকে গল্প হচ্ছে—ভিঠল আর নাইডুর ব্যাটিং কিংবা ওয়ার্ডেন আর বালুর বোলিং বিষয়ে। পুরানো কালের সমঝদাররা হয়তো বলছেন সে সব দিনের কথা যখন বোম্বাইয়ের গভর্নর লর্ড হ্যারিস কলকাতায় ক্রিকেট টীম নিয়ে এসেছেন, কিংবা স্বয়ং রঞ্জি কলকাতায় খেলেছেন, কিংবা নাটোর আর কুচবিহারের মহারাজা ফ্ল্যান্ট টারান্ট আর বিধু মুখার্জি আর মণি দাস প্রভৃতি মহারথীদের ক্রিকেট মাঠে নামবার সুবিধা করে দিচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়ান টারান্ট (Tarrant) বিলাতে মিডলসেক্সের হয়ে খেলেছিলেন; সেকালে তিনি ক্রিকেটে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চৌকস্ খেলোয়ারদের মধ্যে একজন ছিলেন। আবছা মনে হচ্ছে যেন টারান্টকে বল দিতে দেখেছি; বিধু মুখার্জির ব্যাটিং সম্বন্ধে গল্পই শুনেছি, চোখে কিছু দেখা যায় নি; আর মণি দাস তো সেদিন পর্যন্ত ছিলেন, ক্রিকেট এবং ফুটবলে তাঁকে অনেকবারই দেখেছি—বেশ মনে পড়ে ১৯২৭ সালে এম, সি, সি দল যখন প্রথম এদেশে আসে, তখন বিশ্ববিখ্যাত বোলার মারিস টেট্ এক বলে মণি দাসের উইকেট উপড়ে ফেলায় আমাদের কত কষ্ট হয়েছিল।
আজকাল দেশবিদেশের টীম এখানে আসে, টেস্ট ম্যাচের পুরো রেওয়াজ চলেছে। কিন্তু তখন আমাদের অল্পে তুষ্ট থাকতে হত; ‘বেঙ্গলি স্কুল্স’, ‘ব্রিটিশ স্কুল্স’, ‘অ্যাংলোইণ্ডিয়ান স্কুল্স’, এদের খেলা ছিল তখনকার সবচেয়ে বড় ব্যাপার—রঞ্জি ট্রোফির মারফত প্রদেশে প্রদেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যবস্থা তো সম্প্রতি প্রবর্তিত হয়েছে। বোম্বাইয়ের ‘কোয়াড্রাঙ্গুলার’ ছিল ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ঘটনা—তবে আমরা যখন স্কুলের উপরকার ক্লাসে পড়ি তখন বুঝি নাগপুরে হয়েছিল ‘ট্রায়াঙ্গুলার’ খেলা, সেখানে নাম করেন বাংলার হেমাঙ্গবাবু, বোধ হয় বিধু মুখার্জির পর সবচেয়ে খ্যাতিমান বাঙালী ক্রিকেটার ইনি। হেমাঙ্গবাবুকে খেলতে আমরা দেখেছি (ফুটবলেও ইনি রীতিমতে৷ কৃতী), ব্যাটিং, বোলিং এবং ফীল্ডিং-এ এঁর সমকক্ষ ছিল খুব কম। মনে পড়ে একদিন হেমাঙ্গবাবুকে ঈড্ন্ গার্ড্ন্সে দেখি তাঁর পুরানো কলেজ বিদ্যাসাগরের হয়ে খেলতে। সে খেলায় নেমেছিলেন বিদ্যাসাগর কলেজের স্বনামধন্য অধ্যক্ষ সারদারঞ্জন রায়, যিনি একদিকে ছিলেন রঘুবংশ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের টীকাকার আর অন্যদিকে
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment