চাকরির প্রথম দিন
কোনো একটা অফিসে কাজ করা তার পক্ষে খুব সুখকর যে হবে না, মিস হুয়াং এটা অনুমানই করেছিল, কিন্তু সেখানে তার জীবন বিষময় করে তোলার বস্তুগুলো সে কল্পনাও করতে পারেনি।
সকাল সাড়ে আটটায় মিস হুয়াং কোম্পানির প্রধান অফিসে গিয়ে ঢুকলো। চাকরিজীবী হিসাবে তার জীবনের প্রথম পাতার প্রথম পংক্তি শুরু হলো নিচুগলায় আলোচনারত কিছু লোকের চাপা হাসি দিয়ে। প্রধান অফিসে আলো খুবই কম। পূবমুখী ও উত্তরমুখী জানালাগুলো বেশ বড় হলেও সামনের আকাশছোঁয়া বড় বড় বাড়িগুলো দৃষ্টিপথ অবরোধ করেছে। জানালার কাঁচের শার্সিগুলোর মধ্য দিয়ে সূর্যের আলোর পরিবর্তে এসে পড়ছে উলটোদিকের অফিসগুলোর বৈদ্যুতিক বাতির আভা। ছাত থেকে ঝুলছিল ফুলের আকারের হাতমুখ ধোবার গামলার মত বড় একটা ঝাড়বাতি, তার মধ্যেকার পাঁচটা বাল্বই জ্বালা ছিল। কিন্তু সদ্য সদ্য মে মাসের ঝলমলে রৌদ্রালোক ছেড়ে এসে মিস হুয়াং-এর মনে হলো যেন সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেল। বড় ঘরের মধ্যে যে সব নতুন নতুন, অদ্ভুত জিনিস তার জন্য প্রতীক্ষা করছিল—সেগুলো সে আর সেই মুহূর্তে দেখতে পেলো না।
চাপা হাসির শব্দ সে অবশ্য বেশ পরিষ্কারভাবেই শুনতে পাচ্ছিল। এর মধ্য থেকে একটা কথা বেরিয়ে এসে কানে লাগলো, কথাটা শুনে মনে হলো বক্তা যেন নাকটা টিপে কথা বললো: “ঐ যে আসছে!” খুব একটা স্পর্শকাতর না হলেও মিস হুয়াং-এর মনে হলো ঐ চাপা হাসি যেন তাকেই উপলক্ষ্য করে। বুকটা দমে গেলো তার, আপনা থেকেই তার দৃষ্টি চলে গেল যে দিক থেকে হাসির শব্দ আসছিল সেই দিকে। অভদ্র ঐ লোকগুলির চেহারা কেমন সেটাই দেখতে চাইছিল সে।
দরজা থেকে দু’ফিটেরও কম দূরে, আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মিস হুয়াং। তারপর কে একজন তার কাছে এগিয়ে এলো। “হুয়াং, তোমার জায়গা ঐখানে।”
পরিচিত ঐ কণ্ঠস্বর তার স্কুলের পুরনো বন্ধু মিস চ্যাং-এর। অফিসে একমাত্র চ্যাংকেই সে চিনতো। কিন্তু এখন, কেন তা সে ভগবানই জানেন, চ্যাংকে হঠাৎ কেমন যেন অপরিচিত বলে মনে হলো। মাত্র আগের দিন সন্ধ্যাতেই মিস হুয়াং তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, তখন তো চ্যাং তার চিরাচরিত সাধাসিধা সাজ পোশাক পরে সেই চিরাচরিত চ্যাং-ই ছিল। অথচ এখন ঝাড়বাতির আলোয় যে মেয়েটি তার দিকে এগিয়ে আসছে তার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঝলমলে লাল সবুজ রঙের পোশাক।
এত সেজেছে কেন সে? মিস হুয়াং-এর আশ্চর্য লাগছিল। এত অবাক হয়ে গিয়েছিল সে, যে তাকে সাদর সম্ভাষণ জানাতেই ভুলে গেলো। “ও”, যান্ত্রিকভাবে সে উত্তর দিলো আর যান্ত্রিকভাবেই মিস চ্যাংকে অনুসরণ করে সারি সারি শূন্য ডেস্ক পার হযে ঘরের পশ্চিম দিকের একটা জানালাবিহীন কোণায় গিয়ে পৌঁছালো। এখানে অবশেষে মিস হুয়াং দেখতে পেলো জানালাগুলোর পাশে ডজনখানেক লোক দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে মেয়ে-পুরুষ দুই-ই ছিল, দূর থেকে তারা এমনভাবে ওর দিকে তাকিয়েছিল যেন কোনো এক আজব ধরনের প্রাণী ও।
দারুণ অসোয়াস্তি সত্ত্বেও মিস হুয়াং জোর করে নিজের ডেস্ক খোঁজার দিকে মন দিলো। এখানের ডেস্কগুলো সব দরজার দিকে মুখ করে রাখা। দেওয়ালের গায়ের ডেস্ক অন্যদের থেকে এক ব্যাপারে একটু স্বতন্ত্র—এটার ওপর রাখা ছিল মাত্র তিনটি জিনিস—এক শিশি কালি, একটি কলম ও এক টুকরো আনকোরা নতুন ব্লটিং পেপার। মিস হুয়াং বুঝলো এটাই তার ডেস্ক।
“আমি ডানদিকে, তোমার থেকে দু’সারি আগে আছি।” মিস চ্যাং কথাটা বলার সময় দিকটা নির্দেশ করলো, তারপর চকিতে একবার জানালার ধারের দলটার দিকে তাকিয়ে একটা কৃত্রিম হাসি হাসলো।
মিস হুয়াং তার বন্ধুর দৃষ্টি অনুসরণ করার ইচ্ছা সংবরণ করতে পারলো না। দেখলো দুটি লোক বেশ খোলাখুলিই মিস চ্যাং-এর দিকে লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, ওদিকে দুটি মেয়ে আর একটি লোকের সঙ্গে ফিস ফিস করে কত কথা বলে চলেছে। ইউরোপীয় কায়দায় কলারের উপর লোকটির তৈল মসৃণ আঁচড়ানো মাথার সঙ্গে, মেয়ে দুটির কৃত্রিম উপায়ে কুঞ্চিত কেশ বিন্যস্ত মাথাগুলি মিশে বেশ একটা অন্তরঙ্গ ত্রিভুজের সৃষ্টি করেছে।
“ও”, মিস হুয়াং উদাসভাবে উত্তর দিয়ে, তার নিজের ডেস্কে বসে পড়লো, নিজেকে তার খুবই একা মনে হচ্ছিল। না, শুধুমাত্র নিজেকে একা মনে হলেও অতটা ক্ষতি হতো না। সব থেকে বিশ্রী ব্যাপার হলো তার কেমন গা গোলাতে লাগলো—কাঁচা মাছের এক ঝলক গন্ধ যেন তার নাকে এসে লেগেছে। অবসন্নভাবে সে তার ডেস্কের উপরের নতুন ব্লটিং পেপারের টুকরোটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে সে ভাবছিল এটাতো শাংহাইয়ের নামকরা কোম্পানিগুলোর একটা। এখানে ঐ কেরানির দল একপাল নিকৃষ্টমানের অভিনেতা-অভিনেত্রীর মতো ব্যবহার করছে কেন?
“না, মোটেই না, মোটেই নয়।” জানালার ধারের হট্টগোল ছাপিয়ে পরিষ্কার পুরুষ কন্ঠর স্বরে তার চিন্তার স্রোতে বিরতি পড়লো। মিস হুয়াং চোখ তুলে দেখে মিস চ্যাং স্মিত মুখে দল ছেড়ে সুমোহন ভঙ্গিতে দুলতে দুলতে ডেস্কের সারিগুলোর মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসছে।
“হুয়াং এখানের সকলের সঙ্গে আমি তোমার পরিচয় করিয়ে দিতে চাই”, সৌজন্য দেখিয়ে মিস চ্যাং বললো। একদিকে মাথা হেলিয়ে, কোমর বেঁকিয়ে, জানালার ধারের দলটির দিকে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে তাদের দিকে দেখালো।
উঠে দাঁড়াবার জন্য মিস হুয়াং-এর নিজেকে প্রায় জোর করে ঠেলে তুলতে হলো। মনে হচ্ছিল নিজের শরীরের ভার যেন তার এক টন, বিশেষ করে ভারী লাগছিল নিজের পাগুলো। জানালার কাছ থেকে তার ডেস্কের দূরত্ব মাত্র বিশ ফিট মতো হবে, কিন্তু মিস হুয়াং-এর মনে হচ্ছিল যেন তাকে বহু মাইল পথ অতিক্রম করে যেতে হচ্ছে। অফিসময় চতুর্দিকে ডেস্ক ছড়ানো, আরেকটু হলেই সে কার সুন্দর একটা ছাতায় হোঁচট লেগে পড়ে যাচ্ছিল।
“এই হচ্ছে মিস লি…। মিস চৌ…। মি. চাও…। মি. ওয়াঙ—” মিস চ্যাং সশব্দে হেসে উঠলো। প্রত্যেকটি নাম বলার সাথে সাথে মিস হুয়াং অস্ফুট স্বরে বলছিল “আহ”, আর বেশ নিচু হয়ে অভিবাদন করছিল, তার উত্তরে অন্যরা শরীর প্রায় নব্বই ডিগ্রি বেঁকিয়ে খুব ঘটা করে প্রত্যাভিবাদন করছিল।
“আর আমার নাম হচ্ছে শাও”, বছর তিরিশের একজন নিজের পরিচয় দিলে। চীন দেশীয় রেশমের গাউন পরে বেশ কায়দাদুরস্ত ভাবে সাজ করেছিল সে।
“আহ, আহ।” এইসব জীবদের বলার মতো প্রথাগত বাঁধা গৎ মিস হুয়াং-এর মনে এলো না। ওদের যেন অন্য কোন এক জগতের জীব বলে মনে হচ্ছিল তার। “আহ, আহ” বলা আর নিচু হয়ে অভিবাদন জানানোই যেন যথেষ্ট বলে মনে হলো তার।
মি. ৎসাও বলে ওদের সর্বশেষ লোকটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার পর মিস হুয়াং যখন “আহ, আহ”, বলে ঝুঁকে নব্বুই ডিগ্রি বেঁকে অভিবাদন করছে তখন ঐ দলের মধ্যে থেকে কে একজন মৃদুস্বরে বলে উঠলো—“আহ, আহ।”
তিন চার সেকেন্ডের জন্য ঘর একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর সকলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। নিজেকে বেশ শক্ত হাতে সামলে রাখলেও মিস হুয়াং-এর মুখ লাল হয়ে গেল, তারপরই আবার ফ্যাকাশে হয়ে গেল রাগের চোটে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আদবকায়দা-দুরস্ত মি. শাও ব্যাপারটা চাপা দেবার জন্য তাড়াতাড়ি অন্য কথায় চলে গেল।
“এখন আবহাওয়াটা বেশ ভালোই পাচ্ছি, আমরা,” সে বলে চললো। “আপনারও কি তাই মনে হচ্ছে না, মিস হুয়াং?”
তিক্ত হাসি হেসে সে ঘাড় নাড়লো তারপর তার নিজের ডেস্কে পালিয়ে গেল। ডেস্কের সামনে প্রথম যখন বসে তখন ডেস্কটা তার ভালো লাগেনি, কিন্তু এখন ওটাই যেন তার একমাত্র আশ্রয় স্থল বলে মনে হচ্ছিল। নিজের অজ্ঞাতসারে, কলমটা তুলে নিয়ে নিজের আঙুলের ওপর কলমের নিবটা পরীক্ষা
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment