মহালক্ষ্মীর পুল
মহালক্ষ্মীর পুলের ওপাশে একটি রত্নমন্দির আছে, সাধারণের কাছে যার পরিচয় ঘোড়দৌড়ের মাঠ নামে। এই মন্দিরের পূজারীদের মনস্কামনা প্রায়ই পূরণ হয় না, তবে অনেকেই এখানে সর্বস্ব খুইয়ে ঘরে ফেরে। ঘোড়দৌড়-মাঠের পাশ দিয়েই গেছে সহরের ময়লাবাহী প্রশস্ত উন্মুক্ত নর্দমা। মনের ময়লা ধুয়ে মুছে দেয় রত্নমন্দির, আর দেহের ময়লা বয়ে নিয়ে যায় এই নর্দমা। এবং এই দুয়ের মাঝে রয়েছে আমাদের এই মহালক্ষ্মীর পুল।
পুলের বাঁ-পাশে লোহার রেলিংএর ওপরে ছয়টি সাড়ী বাতাসে পত পত ক’রে উড়ছে। ওই একই স্থানে প্রতিদিনই রোদে শুকোতে-দেওয়া এই ছয়টি ধোয়া সাড়ী দেখা যায়। সাড়ীগুলোর মালিকদের মতনই সাড়ীগুলোর দামও নিতান্তই কম। সহরতলীর ট্রেন থেকে প্রত্যেকদিনই পুলের ওপরে এই সাড়ী দেখা যায়। পরিশ্রান্ত যাত্রীদের চোখে মুহূর্তের জন্যে হলেও সাড়ীগুলোর কটা রং, ময়লা লালচে পিঙ্গল রং, নীল পাড়, লালের ছোপ, একটু নাড়া দেয়। ক্ষণিকের জন্যে হলেও নাড়া দেয়। পরমুহূর্তেই পুলের নীচ দিয়ে গাড়ী ছুটে চলে যায় লোয়ার প্যারেলের দিকে।
ধোয়া হলেও সাড়ীগুলোর রং কেমন যেন ড্যাবডেবে।
রংএর সেই চকচকে ভাবটি আর নেই। কেনার পরে নূতন অবস্থায় রং বোধহয় এরকম ভ্যাবডেবে ছিল না। আনন্দমুখর উজ্জ্বলতা ছিল তার গায়ে, ছিল হাসি সেই রং-এ। কিন্তু আজ আর তা নেই। বারে বারে ধোয়ার ফলে রং-এর সে-উজ্জ্বলতাও গেছে। ধুয়ে মুছে যাওয়া ফিকে রংএর অভ্যন্তর থেকে সস্তা কাপাস ফুটে বেরিয়ে পড়েছে। তাদের জীর্ণ দেহের বহু স্থান ছেঁড়া। এখানে ওখানে বড় বড় ফাড়গুলো কোনমতে কালো সুতো দিয়ে সেলাই করা। অনেক জায়গায় সেই সেলাইয়ের সুতোগুলো পর্যন্ত বেরিয়ে পড়েছে। কতকগুলো সাড়ীর সেলাইয়ের জোড়ে যে মলিনতা জমে উঠেছে, বারে বারে ধোওয়ায়ও তা আর পরিষ্কার হয় না। জোড়ের ময়লার জন্যে সাড়ীগুলোকে আরও কুৎসিত লাগে, আরও বেশী নোংরা মনে হয়।
আমি এই সাড়ীগুলোর জীবনেতিহাস জানি, কারণ এদের ব্যবহারকারীদেরও আমি চিনি। মহালক্ষ্মীর পুলের পাশের আট নম্বর মজুর বস্তিতে তাদের বাস। ঐ যে সামনের বস্তি দেখছেন, ঐখানে। আমিও ওখানে থাকি কিনা, সেই জন্যে আমি তাদের ভাল ক’রে জানি। ওদের সম্বন্ধে কিছু জানবার বাসনাও কি হয় না আপনার? প্রধান মন্ত্রীর স্পেশাল ট্রেনের জন্যই আপনি আমাদের এখানে অপেক্ষা করছেন, আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু তার তো এখনও কিছু দেরী আছে। আপনার এই প্রতীক্ষার সময় টুকুর মধ্যে সাড়ীর ইতিবৃত্তের কিছুটা যদি জেনে যান তো মন্দ কি!
একেবারে শেষ-প্রান্তের সাড়ীটা দেখছেন? হাঁ, তার পাশেরটাও ধূসর পিঙলে রংএর। তবে শেষেরটা আরও একটু বেশী কটা। আপনি বোধ হয় এদের রংএর তফাৎটা ঠিক ধরতে পারছেন না, আমিও যে সব সময় এদের জীবনের তফাৎটা ঠিক ধরতে পারি, তা নয়। সকলেই প্রায় একরকম, অদ্ভুত সাদৃশ্য・・・! তবে হ্যাঁ, একেবারের বাম প্রান্তের সাড়ীটা একটু বেশী পাণ্ডুর, আরেকটু বেশী পিঙ্গল বর্ণের। এই সাড়ীটা শান্তা বাইয়ের। তার পরেরটা জীবন বাইয়ের।
শান্তা বাইয়ের জীবনটাও তার জীর্ণ সাড়ীটার মত কেমন ফ্যাকাশে মেরে গেছে। বড়লোকের বাড়ীর বাসন মেজে তার জীবিকা অর্জন করতে হয়। তিনটি সন্তানের মা সে। একটি মেয়ে, দুটি ছেলে। মেয়েটি বড়, বয়স ছয়। ছোট ছেলেটির বয়স মাত্র দুই। স্বামী সেগুন কাপড়-কলের মজুর। ঊষাবসানে তাকে ছুটতে হয় কলে। ভোরে উঠে রান্না বসালে শান্তা বাইয়ের চলে না, তাকে আগের রাতেই পরের দিনের রান্না সেরে রাখতে হয়। কারণ, তাকেও তো আবার পরের বাড়ীর বাসন মাজতে ছুটতে হয় সেই সাত-সকালে। আর, স্বামীর আগেই শান্তাকে বেরোতে হয় সঙ্গে নিয়ে যায় মেয়েকে। কারণ, এখন থেকেই তো তাকে কাজকম্ম শিখতে হবে। শিখতে হবে বাসন-মাজার সমৃদ্ধিপূর্ণ কলাবিদ্যা! সেই সাত-সকালে বেরিয়ে মায়ে-ঝিয়ে বস্তির গৃহে ফিরে আসে বেলা দুটোয়। তখন পড়ে তাদের উনুনে আঁচ, সুরু হয় রান্না-বান্না। সব বাড়ীর উনুন যখন নেভে, শান্তার ঘরে উনুন তখন জ্বলে। বেলা দু’টোর পরে আর রাত দশটার পরে। এর আগে তাকে তো পরের সেবায় ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে মেয়ে তো এখন বড় হয়েছে, ছ’ বছর বয়স তার, মাকে সে সাহায্য করে। মা বাসন মাজে, আর ছ’ বছরের বড় মেয়ে ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে বাসন ধোয়। ধুতে ধুতে হয়তো কখনও কখনও দু’একটা ডিস্ ভেঙে যায়। যেদিন দেখি ছোট্ট মেয়েটির কচি গাল বেশী লাল, চোখদুটো ফোলা, তক্ষুণি আমি বুঝতে পারি, কোন বড়লোকের বাড়ীতে ডিস্ ভাঙ্গা গেছে। সেদিন আর শান্তা বাইও হেসে কথা কয় না। তার বস্তির ঘরে সে প্রবেশ করে গালমন্দ অভিসম্পাত করতে করতে। রাগে গজ গজ করতে করতে ধরায় উনুন। তখন তার উনুনে আঁচ থেকে হয় বেশী ধোঁয়া। আর ঐ ঘুটের ধোঁয়া নীরবে সহ্য করতে পারে না দু’ বছরের কচি ছেলেটি। সুরু হয় তার পরিত্রাহি ক্রন্দন। ক্রোধান্বিত শান্তা বাইয়ের গলা রাগে বিরক্তিতে আরও সপ্তমে ওঠে, তারপর ছুটে এসে ধ্রুম ধ্রাম বসিয়ে দেয় কিল-চাপড় দু’বছরের শিশুর গালে-পিঠে। মুহূর্তে শিশুর কচি-গাল ভাঙ্গা মাটির বাসনের মত লাল রং-এর ছিটেতে যায় ভরে। আরও জোরে কাঁদে শিশু, আরও বেশী চিৎকার করে মা..। সব সময়ে দেখি ছেলেটি কেবল কাঁদে, প্যান প্যান করে; শিশুর সেই দিলখোলা হাসি নেই, ঠোঁটেও নেই স্মিত হাসি, এমন কি মৃদু দাঁত-দেখানো কষ্ট-হাসিও ফোটে না তার মুখে। কেন পারে না হাসতে আমাদের এই ছোট্ট মানুষটি? সব সময়ে কেবল কাঁদবে আর খাওয়ার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করবে। পাজিটার খিদে যেন সব সময়ে লেগেই আছে। দু’ বছর বয়স, কিন্তু ছিটে ফোঁটা দুধও কোন দিন পড়েনি ওর মুখে। দুধের দাম তো নাগালের বাইরে। সুতরাং আমাদের এই বস্তির সমবয়স্ক সব শিশুদের মতনই ও-ও খায় মাইলোর মোটা রুটি। আমাদের বস্তির বাচ্চাদের মায়ের বুকের দুধ জোটে প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত; কারণ মায়েদের বস্তি ছেড়ে যেতে হয় মজুরী খাটতে মিলে, আর আমাদের দেশের মিল-প্রাঙ্গণে শিশু-রক্ষণাগারের তো কোন বালাই-ই নেই। সুতরাং এই সব হতভাগ্য বস্তি শিশুদের বেড়ে উঠতে হয় মোটা মাইলো খেয়ে। মোটা মাইলো আর ঠাণ্ডা জল। উলঙ্গ শিশুরা রোদে ঘোরে। রাত্রে ছেঁড়া চটের উপরে পড়ে ঘুমোয়। পেটে খিদে নিয়ে শোয়, আর নিশাবসানে জেগে ওঠে আরও বুভুক্ষা নিয়ে। বুভুক্ষা-প্রপীড়িত দেহ-মনের ক্ষুন্নিবৃত্তির পূরক হয় মোটা মাইলোর শুকনো রুটি আর ঠাণ্ডা জল। তাদের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে এই বুভুক্ষাও। শিশু বয়স থেকে শেষ বয়স পর্যন্ত তাদের পেটে, মনে, মাথায়, সর্বসময়ে হাতুড়ীর মত কি যেন কেবল ঠুকছে: ঠুক্, ঠুক্, ঠুক্! সব সময় এই ঠোকা চলেছে… হাঁটছে, খাটছে, হাসছে কিংবা ঘুমোচ্ছে—কোন সময়েই এই হাতুড়ী ঠোকার যেন আর বিরাম নেই...ঠুক-ঠুকানী চলেইছে। শুধু হপ্তা-দিনে পকেটে যখন গোটা কয়েক টাকা পড়ে, তখন যেন ঠুক-ঠুকানীটা ঠিক বোঝা যায় না। গরম পকেটে সোজা তাড়ির দোকানে গিয়ে ঢক্ ঢক্ ক’রে গলায় কিছু তাড়ি ঢেলে তারা এই বুভুক্ষার কঠিন ভারী ঠুক-ঠুকানী ভুলতে চায়। তাড়ি গেলে আর ঘণ্টা কয়েকের জন্য শিরা উপশিরার দেয়ালে ও মগজের স্নায়ুতে সে-ঠুক-ঠুকানী যেন আর বোধহয় না চেতনা-হারা হয়ে নিদ্রাবস্থায় থাকে পড়ে-বিস্মৃতির গহ্বরে ঠেলে ফেলে দেয় নিজেকে, ভুলে থাকে আশেপাশের কঠিন বাস্তবতা। কিন্তু এই তাড়ি পান তো সম্ভব শুধু ঐ মাইনের দিনে। মাইনের পর দু’ একদিন পর্যন্ত টেনেটুনে হয়তো চলতে পারে জন কয়েকের। কিন্তু তারপরে তো আর সম্ভব নয়। ঘর ভাড়া দিতেই হবে, র্যাসনের দামের ব্যবস্থাও রাখতেই হবে। তারপর আছে তেল নুন লঙ্কা কেনা।
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment