মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের উপর সাহিত্যের প্রভাব যে অসামান্য, তাহা বোধ হয় কেহই অস্বীকার করিবেন না। সুতরাং সাহিত্যের স্বরূপ কিরূপ হওয়া আবশ্যক সে সম্বন্ধে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। সুসাহিত্য মানবজীবনকে পূর্ণতার অভিমুখে লইয়া যায়, অন্যদিকে অসৎ সাহিত্য, মানবজীবনকে অধোগামী করে। সুতরাং সমাজের নিকট সাহিত্যিকের গুরু দায়িত্ব আছে। যাঁহারা বলেন যে রস সৃষ্টি করাই সাহিত্যিকের প্রধান কাজ তাঁহারা সাহিত্যের প্রকৃত আদর্শ যে কি তাহা ভুলিয়া যান। যে-রস সাহিত্যের সৃষ্টি তাহা উচ্চস্তরের অথবা নিম্নস্তরের হইতে পারে। যদি সাহিত্য রসসৃষ্টি করিয়া মানুষের নীচ প্রবৃত্তিকে জাগ্রত করিয়া তোলে এবং তাহার ফলে মানব সমাজে উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দেয়, তাহা হইলে সেরূপ সাহিত্য সমাজের অসীম ক্ষতি করিয়া থাকে। কোন শক্তিমান লেখক যদি সাহিত্যের আদর্শ কি তাহা ভুলিয়া যান এবং শব্দের ও বাক্যের মায়াজালে বিভ্রান্ত মানবমনে অলীক ভোগলালসার প্রবৃত্তি জাগ্রত করেন, তাহা হইলে তিনি মানবের অসীম অকল্যাণ সাধন করিবেন। আবার, যিনি সুসাহিত্যিক তিনি রস সৃষ্টি করিয়া মানবচিত্তকে উচ্চ আদর্শে উদ্বুদ্ধ করিয়া সমাজজীবনকে সুষ্ঠু, সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করিয়া তুলিতে পারেন। সাহিত্যিকের হাতে যে-অস্ত্র আছে তাহা শাণিত ও সবল; এই অস্ত্র প্রয়োগ করিয়া তিনি একদিকে সমাজব্যাধির নিরাময় করিতে পারেন, অন্যদিকে তিনি ঐ অস্ত্র প্রয়োগ করিয়া সমাজজীবনকে পঙ্গু ও অসার করিয়া ফেলিতে পারেন।

সুসাহিত্যের প্রধান লক্ষণ হইল এই যে, তাহা হইবে সরস, বাস্তব ও যুক্তিযুক্ত। রস সৃষ্টি করা সাহিত্যিকের একটি প্রধান কাজ। এই রস সৃষ্টি করিয়া, সাহিত্য মানুষের মনে, হর্ষ, বিষাদ, ঘৃণা, লজ্জা, ভয়, হিংসা প্রবৃত্তি, লোক সেবার স্পৃহা প্রভৃতি জাগ্রত করিতে পারে। সুতরাং সমাজের গতিবিধি, ঐতিহাসিক পরিস্থিতি, সমাজের প্রয়োজন প্রভৃতি সম্যক উপলব্ধি করিয়া সাহিত্যিককে সতর্কতার সহিত অগ্রসর হইতে হইবে। তিনি সাহিত্যের দ্বারা যে-ভাব সৃষ্টি করিবেন তাহার দ্বারা সমাজের কল্যাণ, সাধিত হইবে কি না সর্ব্বদাই সে সম্বন্ধে তাঁহাকে জাগ্রত থাকিতে হইবে। রসলিপ্সা মানুষের মনের স্বাভাবিক বৃত্তি। মানবের অনুভূতি উদ্বুদ্ধ হইলে তাহা কৰ্ম্মে প্রকাশিত হয়। সুতরাং সাহিত্য বহুল পরিমাণে মানুষের কর্মজীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। যে-অনুভূতি কর্ম্মের পশ্চাতে থাকে, তাহার দ্বারাই কর্মের স্বরূপ নির্দ্ধারিত হয়। সুতরাং সাহিত্যিককে সর্ব্বদাই সতর্কতা অবলম্বন করিয়া চলিতে হইবে, যাহাতে তিনি রসসৃষ্টি করিয়া মানুষের মনে উচ্চস্তরের অনুভূতি জাগ্রত করিতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, সাহিত্য হইতে পারে ভাববাদী অথবা বস্তুবাদী। বহুদিন পর্য্যন্ত সমানে ভাববাদী সাহিত্যের প্রাধান্য চলিয়াছে। ভাববাদী সাহিত্য ভাবের ফানুস তুলিয়া মানব মনকে অবাস্তব, অপ্রাকৃতিক উর্দ্ধলোকে লইয়া যাইতে প্রয়াস পায়। কল্পনা সাহিত্যের একটি প্রধান অঙ্গ। কিন্তু সেইজন্য সাহিত্যিককে কাল্পনিক হইতে হইবে, এমন নহে। যদি মানুষ কেবল অবাস্তব স্বপ্নে বিভোর হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার দ্বারা জগতের কোনো কল্যাণ সাধিত হইতে পারে না। এই ভাববাদী সাহিত্য প্রেমের শাশ্বত রূপ, পরকাল, মায়াবাদ প্রভৃতির কাল্পনিক রূপ সৃষ্টি করিয়া মানব-মনকে বিভ্রান্ত করিতেছে। এই ব্যাধি হইতে, সাহিত্যকে মুক্ত করা আবশ্যক। কল্পনা যদি বাস্তবের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া প্রসারিত হয়, তাহা হইলে উহা সমাজে যে-শক্তি সৃষ্টি করিতে পারে তাহার দ্বারা অসাধ্য সাধিত হইতে পারে। সাহিত্যের সম্মুখে আছে বাস্তব প্রকৃতি ও বাস্তব মানব-জীবন; ইহা হইতে উপাদান সংগ্রহ করিয়া সাহিত্য যে-রস সৃষ্টি করিতে পারে তাহা হইতে মানব-মন যথেষ্ট চিন্তা ও কল্পনার বিষয়বস্তু লাভ করিতে পারে। বাস্তববাদী সাহিত্য যে-রস সৃষ্টি করে তাহার দ্বারা মানবের কর্মজীবন প্রসার লাভ করে, এবং মানুষ এই সাহিত্যের প্রভাবে প্রকৃতি ও মানবসমাজের সঙ্গে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হইতে পারে। এইরূপ সাহিত্য মানুষকে করে বাস্তবিক কর্মী ও সামাজিক জীব। ইহা মনে করিলে ভুল হইবে যে, ভাববাদী সাহিত্য আদর্শবাদী এবং বস্তুবাদী সাহিত্য তদ্রূপ নহে। এই উভয় সাহিত্যই আদর্শবাদী হইতে পারে, কিন্তু ভাববাদের আদর্শ অবাস্তব ও অতিপ্রাকৃতিক, অন্যদিকে বস্তুবাদের আদর্শ প্রাকৃতিক ও বস্তুকেন্দ্রিক। ভাববাদী সাহিত্য স্বপ্নবিলাসী, কিন্তু বস্তুবাদী সাহিত্য এই মাটির জগতের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া মানব-জীবনকে সুসঙ্গত পথে চালিত করে। অনেকে মনে করেন যে বাস্তববাদী সাহিত্য কুৎসিতের উপাসক এবং ভাববাদী সাহিত্য সৌন্দর্য্যের উপাসক। এইরূপ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এই জগতে সুন্দর ও কুৎসিৎ উভয়েরই স্থান আছে। বাস্তববাদ্রী সাহিত্য সামাজিক সত্যকে মানবের সম্মুখে যথাযথভাবে স্থাপন করিয়া মানবকে বাস্তব সত্যের পথে চালিত করে। বাস্তববাদী সুসাহিত্যের ইহাই আদর্শ। যে ভাববাদী অথবা বাস্তববাদী সাহিত্য মানবমনকে অধঃপাতের পথে লইয়া যায় তাহা সর্ব্বদাই বর্জনীয়।

মানব বিচারশক্তিসম্পন্ন জীব। সুতরাং সুসাহিত্যের একটি প্রধান কাজ হইল মানবের চিন্তাশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করা। কেবলমাত্র ফেনিল ও চাকচিক্যপূর্ণ ভাব সৃষ্টি করিয়া মানব-মনকে আন্দোলিত করা সুসাহিত্যের কাজ নহে। মানবের চিন্তাশক্তি, ও বিচারবুদ্ধিকে 'সাহিত্য উদ্বুদ্ধ করিবে, এবং এই সঙ্গে রসউপবেশন করিয়া সাহিত্য মানবের বিচারবুদ্ধির সঙ্গে ভাবকে। সুসঙ্গত করিবে। মানব-মনের যে-সব প্রেরণা অথবা অনুভূতি যুক্তিসহ নহে তাহা সর্ব্বদাই বর্জনীয়। যদি কোনো জাতি বা সমাজ নৈয়ায়িক বিচারবুদ্ধি হারাইয়া ফেলে, তাহা হইলে উহা অধঃপতিত হয়; সুতরাং সাহিত্যিককে সর্ব্বদাই মনে রাখিতে হইবে যে মানবের বিচারবুদ্ধিকে জাগ্রত ও সুপরিচালিত করা তাঁহার এক প্রধান কার্য্য।

আর একটি কথা সাহিত্যিকের মনে রাখা আবশ্যক। সাহিত্য হইতে পারে ব্যক্তিকেন্দ্রিক অথবা সমাজকেন্দ্রিক। অনেক সময় সাহিত্যিক ভুলিয়া যান যে ব্যক্তি সমাজশরীরের একটি অংশ মাত্র। সমাজের বাহিরে ব্যক্তির কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নাই। রবিনসন ক্রুসো অথবা রুশোর প্রাকৃতিক সমাজবোধহীন মানুষ কাল্পনিক, বাস্তব নহে। ব্যক্তিবাদের যুগে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাহিত্যের প্রভাব বৃদ্ধি পাইয়াছে। ধনিক-সমাজের সাহিত্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এই সাহিত্যের উদ্দেশ্য হইল সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া ব্যক্তির আশা আকাঙ্ক্ষা সুখ দুঃখ প্রভৃতির আলোচনা করা। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রতিবাদে এইরূপ ভাবধারার প্রচলন ও বিকাশ এক সময়ে সামাজিক প্রগতির অপরিহার্য্য অঙ্গ ছিল। কিন্তু এইরূপ সাহিত্য মানুষকে করিয়া তোলে স্বার্থপর ও অসামাজিক জীব। ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধনিক-সমাজ উচ্চ কণ্ঠে মানুষের নিকট ঘোষণা করে যে সমাজের অস্তিত্ব ব্যক্তির জন্য, ব্যক্তির অস্তিত্ব সমাজের জন্য নহে। এই চিন্তাধারার প্রতিপাদ্য বিষয় হইল এই যে, সমাজ ব্যক্তির যান্ত্রিক সমষ্টি মাত্র। সমাজ-শরীরের অন্তর্গত ব্যক্তিদের মধ্যে কোনরূপ আন্তরিক যোগ নাই, কিন্তু এই ব্যক্তি-কেন্দ্রিক ভাবধারা যে কেবলমাত্র অবাস্তব তাহা নহে, ইহার ফলে মানুষ অবৈজ্ঞানিক সামাজিক মত পোষণ করিতে শিখিয়াছে। ফলে জগতে দেখা দিয়াছে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সংঘর্ষ, জাতির সঙ্গে জাতির সংঘর্ষ এবং শ্রেণীসংঘাত। এইরূপ মনোভাব হইতে সমাজকে মুক্ত করা অধুনা সাহিত্যিকের একটি প্রধান কাজ। প্রত্যেক সাহিত্যিককে উচ্চ কণ্ঠে বলিতে হইবে যে, ব্যক্তি সমাজের একটি অঙ্গ মাত্র এবং যখন সমাজের মঙ্গলের সঙ্গে ব্যক্তির স্বার্থের সংঘাত ঘটে 'তখন ব্যক্তিকে সমাজের মঙ্গলের জন্য আত্মস্বার্থ বিসর্জন দিতে হইবে। আমরা আধুনিক যুগে ভুলিয়া গিয়াছি যে সামাজিক জীব হিসাবে সমাজের মঙ্গল সাধন করাই আমাদের প্রধান কর্তব্য ও আদর্শ। আমি ভাববাদের সাহায্যে সমাজতান্ত্রিক মতের সমর্থন করিতেছি না। এই মত যুক্তিযুক্ত ও বিজ্ঞানসম্মত বলিয়াই আমি এই মতের সমর্থন করিতেছি। প্রত্যেক চিন্তাশীল ব্যক্তি এই মত সমর্থন করিবেন, ইহা আমার বিশ্বাস। সুতরাং সাহিত্যিকের আধুনিক যুগে একটি প্রধান কর্তব্য হইল ব্যক্তিকে সামাজিক জীবে পরিণত করা।

আর একটি বিষয়ে সাহিত্যিকদের মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া আমি এই প্রবন্ধের উপসংহার করিতে ইচ্ছা করি। আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজের পণ্যোৎপাদনের ব্যবস্থার ফলে সামাজিক সম্বন্ধ একটি বিশেষ রূপ গ্রহণ করিয়াছে। সমাজের এক শ্রেণীর লোকের হাতে মূলধন থাকায় তাহারাই পণ্যোৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে এবং পণ্য বিক্রয় করিয়া যাহা লাভ হয় তাহার অধিকারী তাহারাই। পণ্যোৎপাদনের ব্যবস্থা সামাজিক। কিন্তু সম্পত্তির ও মূলধনের অধিকারী ধনিকগণ। এই ধনতান্ত্রিক সমাজে ধনতন্ত্রবাদের প্রচলন হওয়াতে জগতে দেখা

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion