কিছুকাল ধ’রে বাংলা সাহিত্য-সমালোচনায় সাহিত্য ও রাজনীতির সম্বন্ধ নিয়ে একটি বাদ-বিসম্বাদের ধারা চলে আসছে যার তীব্রতার বহু মাত্রাভেদ দেখা গেলেও সমগ্রভাবে কোনো মীমাংসা সর্বজনগ্রাহ্য হ’চ্ছে না ৷

গোড়ায় যখন “প্রচার”-সাহিত্যের আবেদন এসেছিল তখনকার পরিমাপে আজকের প্রচারবাদী সাহিত্যিকের সংখ্যা অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছে, এবং কেবল যে নিরপেক্ষ ও বিরুদ্ধবাদী বহু সাহিত্যিককে আকৃষ্ট করে এনেছে তাই নয়, নতুন প্রগতিশীল ও সম্ভাবনাপূর্ণ সাহিত্য ও সাহিত্যিকের সৃষ্টি করেছে। এমন কি, দেখা যাচ্ছে যে, বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাও এখানেই অনেকাংশে কেন্দ্রীভূত। নতুন সাহিত্যের অন্য কোনো পথ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।

এই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন সাহিত্য নিজের অন্তরের কথাটিকে আরো স্পষ্ট করে, সম্পূর্ণ ক’রে দেখতে পাচ্ছে। পূর্বে যেখানে কেবল একটি তাগিদ অসহিষ্ণু অর্ধ-উচ্চারণে প্রকাশ হয়েছিল আজ তা সমগ্র জীবন ও সাহিত্যের চেহারার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আরো সত্যভাবে উপলব্ধ হ’চ্ছে। এর ফল হয়েছে বাংলা সাহিত্য-সমালোচনায় একটি নতুন ধারার আত্মপ্রকাশ।

বিরুদ্ধবাদী খাঁটি “বিশুদ্ধ” সাহিত্যিক যাঁরা, তাঁরা এই বিস্তৃতি ও বিবর্তনের মর্মার্থকে হয় বোঝেন নি, নয় অবহেলা করেছেন। তাঁদের ভ্রান্তি এইখানে যে, তাঁরা সাহিত্যে সমাজচেতনার আন্দোলনকে একটি জ্যামিতিক, অনড় কাঠামোর মধ্যে এঁটে ফেলে পূর্ণ আত্মপ্রসাদে সেই ভিত্তিতেই এর বিচারাসনে বসেছেন। এই কাঠামো দুটি কথায় বিবৃত—’রাজনৈতিক প্রচার’। তাঁরা রায় দিয়ে থাকেন যে এই শ্লোগানের প্রয়োগার্থ সাহিত্যের মৃত্যু।

সম্প্রতি এই অনগ্রসর, যান্ত্রিক (mechanical) সমালোচনার একদফা প্রকাশ দেখতে পাওয়া গেছে অধুনা-প্রকাশিত বার্ষিকপত্র ‘দিগন্ত’-এ, খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের ধারণার মধ্যে।

তাই আজ প্রচারবাদী সাহিত্যদর্শনের ভিত্তিটি নতুন করে দেখার প্রয়োজন এর আবেদন তাঁদের কাছে—যারা রাজনৈতিক দলাদলির কুয়াশা ভেদ করে সাহিত্যকে দেখতে ও যাচাই করতে চান।

আজকের প্রচারবাদী সাহিত্য কেবল একটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। কেবল রাজনৈতিক মতামতও এর বিশেষত্ব নয়। এর ভিত্তি একটি সম্পূর্ণ নতুন জীবন-দর্শন—কমিউনিজম্।

আজকের ইতিহাসে মানুষ এমন একটি স্তরে এসে পৌঁছেছে যে স্তরে রাজনীতি ও অর্থনীতি জীবনের প্রায় কেন্দ্রস্বরূপ; তার কারণ এই যে, আজকের সভ্যতার সংকটের মূলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট রয়েছে। এই কথাটি বৈজ্ঞানিক সভ্যতার সঙ্গে ইতিহাসের মধ্য থেকে উদ্ধার করেছে কমিউনিজম। তাই আমাদের কালে কমিউনিস্টদের তীব্রতম আক্রমণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর। কিন্তু রাজনৈতিক বিপ্লবের খাতিরেই কমিউনিজমের কদর নয়, এঙ্গেলসের ভাষায় কমিউনিজমের উদ্দেশ্য মানুষকে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ঐতিহাসিকে নিয়ে যাওয়া “Pre-history ends and history begins.” মানুষকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে নতুন সভ্যতার বনিয়াদ রচনা করাই কমিউনিজমের ঐতিহাসিক ভূমিকা ৷ তাই মার্কস, এঙ্গেলস্ বা লেনিন কেবল কী করে বিপ্লবের দ্বারা শোষিতশ্রেণী শোষণ থেকে আপনাকে মুক্ত করবে তা-ই বলেননি; প্রকৃতি, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ললিতকলা নিয়ে মানুষের যে সমগ্র জীবন—তার মূলেই একটি সমগ্র বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছেন। তাঁদের মতবাদ যে নতুন সোভিয়েট সমাজ সৃষ্টি করেছে সেই সমাজ দর্শনের সত্যতার সাক্ষ্য। ঊনত্রিশ বৎসরের অক্লান্ত অবসরহীন যোদ্ধা সোভিয়েট পৃথিবীর সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে শুধু আত্মরক্ষা করে নতুন সমাজ-ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণ করেছে তা-ই নয়, এই অবিরত আক্রমণের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেও একটি অপূর্ব নতুন সংস্কৃতির সৌধ নির্মাণ করেছে,—লেনিনগ্রাদ অবরোধের মধ্যে দাঁড়িয়ে রচনা করেছে Leningrad Diary-র মত কাব্য। আইজেনস্টাইন, মাইএরহোল্ড, গোর্কী, শোলোকভ, টিখোনভ, মায়াকোভস্কি, শোস্তাকোভিচ, পপভ—এঁরা কেবল ব্যক্তিগত প্রতিভাকেই প্রকাশ করেননি, প্রকাশ করেছেন সোভিয়েট মানবের প্রতিভাকে; সূচনা করেছেন সভ্যতার এক নতুন অধ্যায়ের।

তাই কমিউনিস্ট কবিতা কেবল “রাজনৈতিক প্রচারের” কবিতা নয়, নতুন পৃথিবীর কবিতা। অতীতে খ্রীস্টধর্ম যেমন খ্রীস্টীয় সভ্যতাকে সৃষ্টি করেছে, বৌদ্ধধর্ম বৌদ্ধ-সংস্কৃতিকে সৃষ্টি করেছে, তেমনি আজ কমিউনিজম্ জন্ম দিচ্ছে কমিউনিস্ট সভ্যতার। সাধারণ সাময়িক রাজনীতির প্রচারের মানদণ্ডে এর সম্পূর্ণ রূপ দেখতে পাওয়া যাবে না। ‘কংগ্রেসী কবিতা’ বলে কোনো পদার্থ সৃষ্টি আজ সম্ভবপর নয়, কারণ, জাতীয় আন্দোলনকারীর কাছে কংগ্রেসী হওয়াটা কেবল সাময়িক রাজনীতির ব্যাপার। তাতে স্বাধীনতালাভের পরবর্তী ভবিষত্যের কোনো রূপায়ণ করে না, জীবনের সর্বমুখীন চেতনাকে স্পর্শ করে না। ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সমাজজীবন কী সভ্যতা সম্পর্কে কংগ্রেসের কোনো কল্পনা নেই (ব্যক্তিবিশেষের থাকতে পারে), কারণ কংগ্রেসী আন্দোলন একটি বিশেষ দেশের ও সময়ের মধ্যে গণ্ডীভূত। তার অনুভূতিক্ষেত্র অপ্রশস্ত রয়ে যায়, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার বাইরে প্রসারিত হবার কোনো ফাঁক পায় না। কাজেই তা কাব্য-সৃষ্টির অনুকূল কোনো বিশেষ ক্ষেত্র রচনা করে না। একথা মানতেই হবে যে, পঁচিশ বৎসরের কংগ্রেসের রাজনীতি বাংলার জনগণের জন্য কোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে জাগাতে পারেনি; কারণ, সেটা ছিল নিছক রাজনীতি। অপরপক্ষে মাত্র কয়েক বৎসরের কমিউনিস্ট আন্দোলন শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যেও একটি নতুন সাংস্কৃতিক ধারাকে ক্রমশই জাগ্রত করতে সক্ষম হ’চ্ছে, নতুন নাটক, গান, নৃত্য জনসাধারণের মধ্যে শিকড় খুঁজে পেয়ে জনসাধারণের হয়ে উঠছে। নতুন গ্রাম্য কবিতারও উত্থান হ’চ্ছে।

সেদিক থেকে বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক-গৌরব গ্রাম্য-কবি নিবারণ পণ্ডিতের ‘রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে’ কবিতাটি (‘পরিচয়’, ১৩৫২)। তবুতো বাংলার এই ধারার সবে সূত্রপাত মাত্র। অন্যান্য দেশেও কমিউনিস্ট আন্দোলন একটি নতুন সাংস্কৃতিক ধারার প্রবর্তন করছে যার দিকে ভবিষ্যতের সমস্ত সম্ভাবনা একত্র সংহত। প্রগতিকামী শিল্পী সর্বত্রই এই আন্দোলনের মধ্যে ক্রমশ এগিয়ে আছেন। প্রবীণ, পরিণত বয়সে রম্যাঁ রল, থিয়োডোর ড্রেইজার, জোশ মালিহাবাদী এই পথে পা বাড়িয়েছেন। কারণ, তাঁরা এখানে দেখেছেন জীবনের স্পন্দন, আগামী দিনের ইঙ্গিত। অন্যান্য দেশে কমিউনিস্ট-বিরোধীরা এই পরিস্থিতির অর্থও উপলব্ধি করছেন। হয়ত শঙ্কিত হচ্ছেন, কিন্তু বালুতে মুখ গুঁজছেন না। ড্রেইজারের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের সম্পর্কে জেমস্ ক্যারেল (কমিউনিস্ট-বিরোধী) Saturday Review, ১২ই জানুয়ারী সংখ্যায় লিখছেন: “Still seeking to know, to learn, to be free, Dreiser joined the Communist Party of the United States last summer. The major significance of this act is that it was the way he took to repudiate the values of bourgeois America. As such it was a militant action, and it casts a meaning on all of his past writing. It shows us that the novelist who most truly, most thoroughly, most broadly pictured in the meaning of life in America its most hopeful period of growth, came at the end of his days, to repudiate the values of that same society, in this sense, Dreiser, as an old man, moved towards the ideas of Socialism...For this one honors him for his courage and his integrity...The statement he issued when joining the Communist Party is-like recent statements of Picasso-unmistakably sincere...a rejection of Capitalism and a deep concern because of the impasse into which modern man has now come to find himself. Dreiser was not a man who trifled in these matter. He declared that he was joining the Communist Party as this was the logical consequence of his life-work and life-experience.There is here a note of warning. For this was one of the final conclusions reached by America's greatest writer" (ইতালিক প্রয়োগ আমার), ড্রাইজার নিজে তাঁর আবেদনপত্রে বলেছিলেন—“Belief in the greatness and dignity of man has been the guiding principle of my life and work. The logic of my life and work (ইতালিক প্রয়োগ আমার) leads me, therefore, to apply for membership in the Communist Party.”-—People's War, September 30, 1945.

এই নতুন সাহিত্য গায়ের জোরের উপর

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion