১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম বিদ্রোহ ও অস্ত্রাগার দখলের সংগ্রামের মহানায়ক শহীদ সূর্য সেনের (মাষ্টারদা ) সংস্পর্শে আসার সুযোগ যাদের হয়েছিল তারা কেউ কেউ তাঁর স্মৃতিচারণ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু মাষ্টারদার শিষ্য ও অনুগামী হয়েও নিরন্তর তাঁর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সুযোগ আমার খুব কমই ছিল। একমাত্র আমাদের দলের উচ্চতম নেতৃত্ব এবং পরবর্তীকালে মাষ্টারদা কর্তৃক আত্মগোপন অবস্থায় সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালনার সময়ে যে- সব কর্মী তদানীন্তন কাজের স্বার্থে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাদের পক্ষেই মাষ্টারদাকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করে মানুষ ও বিপ্লবী হিসাবে মাষ্টারদার চরিত্রের প্রকৃত মূল্যায়ন বিশদভাবে করা সম্ভবপর। তা সত্ত্বেও অতি স্বল্প সময়ের জন্য তাঁর সংস্পর্শে আসার যে সুযোগ আমি পেয়েছি এবং তাকে আমি যেরূপ দেখেছি ও বুঝেছি তাতে মানুষ ও বিপ্লবী হিসাবে মাষ্টারদার প্রতি শ্রদ্ধায় মন ভরে গিয়েছে। সেজন্য চট্টগ্রাম বিদ্রোহের সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ধে স্বল্প পরিসরে হলেও তাঁর চরিত্রের কয়েকটি নিক সম্পর্কে আলোচনা করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

১৯২৭ সালের শেষদিকে পদস্থ সরকারী অফিসার হিসাবে আমার কাকা চট্টগ্রাম বিভাগে বদলি হলে আমিও লেখাপড়ার স্বার্থে আমার বাসস্থান রানাঘাট ছেড়ে তাঁর সঙ্গে সেখানে চলে যাই। সেখানে দু-তিন মাস কাজেম আলি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম নবম শ্রেণীতে। মাষ্টারদা যে একজন খ্যাতনামা বিপ্লবী ও রাজনৈতিক নেতা সেখানে যাবার পর এরূপ কোন কথা প্রথমে আমার জানা ছিল না। পরে ঐ স্কুলেই আমার এক সহপাঠী, আমাদের প্রয়াত নেতা লোকনাথ বলের এক ভাই, শহীদ প্রভাস বলের নিকট প্রথম শুনি যে, সূর্য সেন বা মাষ্টারদা ওখানকার একটি স্কুলের শিক্ষক এবং জেলা কংগ্রেসের সেক্রেটারী ও একজন ব্যক্তিনামা বিপ্লবী নেতা। পরে যখন মাষ্টারদাকে জানলাম তখন অবাক হয়ে গেলাম। দলের সভ্য হওয়ার পূর্বে বা পরে তাঁকে প্রায় রোজই আমার বাসার সম্মুখের রাস্তা দিয়ে তাঁর স্কুলে যেতে দেখেছি। ছোটোখাট বেঁটে মানুষ, অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির, অতি সাধারণ শ্যামবর্ণ চেহারা, স্বল্পভাষী, রাস্তা দিয়ে চলবার সময় নিঃশব্দে একেবারে প্রাক্ত দেশ দিয়া চলেন, নিজেকে জাহির করার গুণ যার বিন্দুমাত্র চেষ্টাই নেই— তিনি কিরূপে একজন বিরাট বিপ্লবী নেতা ও জেলা কংগ্রেসের সেক্রেটারী হতে পারেন তা ভেবেই পেলাম না! কিন্তু দলের সভ্য হওয়ার পর আমার সেই ভুল ভাঙল মাষ্টারদার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎকারের সময়। সেই অবিস্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ সাক্ষাৎকারের কথা সর্বশেষে লিখব।

মাস্টারদার নাম বা খ্যাতি পূর্বে না শোনার কারণ হল যে, তিনি বর্তমান যুগের বহু নেতার মত নাম কিনবার জন্য আদৌ ব্যগ্র ছিলেন না - আত্মপ্রচারও হামবড়া ভাব তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র ছিল না। আমি দলের সভা হবার পূর্বে বা পরে আমাদের বাসার নিকট যাত্রামোহন সেন হলে কংগ্রেস আহূত অনেক সভায় গিয়ে দেখেছি যে মাষ্টারদা সাধারণত কোন বক্তৃতাই দিতেন না, নিজেকে জাহির করার বিন্দু মাত্র চেষ্টাও দেখিনি, সর্বসমক্ষে সর্বাগ্রে এসে দাঁড়াতেন না, পিছনে থেকে প্রয়াত নেতা অম্বিকা চক্রবর্তী বা অন্যদের বক্তৃতা প্রভৃতি দিতে এগিয়ে নিতেন—অথচ গুরুত্বপূর্ণ সকল প্রশ্নেই তিনি সকলের কাছে অত্যাবশ্যক ছিলেন। ক্ষমতালিপ্সাহীন ও নিরহংকারী এক নিরলস ও নীরব কর্মী হিসাবে মাষ্টারদাকে তখন দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি। বাংলাদেশে তদানীন্তন বিপ্লবী দলের মধ্যে বিপ্লবী কর্মী বা নেতার গুণাগুণ সম্পর্কে একটা অত্যন্ত অবাস্তব ও বিমূর্ত (abstract) ধারণা প্রচলিত ছিল যা ১৯২৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক যুব সম্মেলনের সভাপতি রূপে একজন প্রখ্যাত বিপ্লবী নেতা তাঁর অভিভাষণে প্রকাশ করেন। এর মূল কথা হল : একজন বিপ্লবীর যুক্তি, দয়া-মায়া, স্নেহ-মমতা, ভালবাসা, সৌন্দর্যবোধ প্রভৃতি কিছুই থাকবে না—তা তাঁর কাছে বিচার-বিবেচনার বিষয়ই নয়। তার একমাত্র গুণ চিন্তাও হবে বিপ্লবের পথে নির্মমভাবে এগিয়ে যাওয়া। রুশিয়ায়ও বৈপ্লবিক আন্দোলনের এক পর্যায়ে

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion