১৪৫৬ সালে জার্মানির গুটেনবার্গ কর্তৃক মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের অল্পদিনের মধ্যে তা সারা ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। এর ঠিক একশ বছর পর অর্থাৎ ১৫৫৬ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম মুদ্রণযন্ত্র আমদানি করেন পর্তুগিজরা। সুতরাং এ উপমহাদেশে ছাপাখানার প্রবর্তক—পর্তুগিজরা।

১৫৫৭ সালে ছাপাখানাটি থেকে প্রথম বই ছাপা হয়। ধারণা করা হয় ১৫৫৬ সাল থেকে ১৫৬১ সাল পর্যন্ত গোয়ায় পাঁচটি বই ছাপা হয়েছিল। যদিও এখন পর্যন্ত কারো চোখে একটি বইও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। প্রথম নিদর্শন হিসেবে যে বইটি এখনো আছে সেটা হলোCompendio Spirtiual Da Vida Christa। নিউইয়র্কের পাবলিক লাইব্রেরিতে রাখা আছে বইটি। গোয়ার পর ছাপাখানার কেন্দ্র হয় কুইলনে। সেখান থেকে ১৫৭৮ সালে তামিল মলায়লম হরফে ছাপা হয় প্রথম স্বদেশি বইDourtrina Christa। পর্তুগিজ মিশনারিদের প্রচেষ্টায় দক্ষিণ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় বেশ কয়েকটি বই মুদ্রিত হয়েছিল ছাপাখানাটি হতে। খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করাই ছিল এসব বই মুদ্রণ ও প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য। কারণ তখনকার রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় ভারতবর্ষে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করা তেমন সুবিধাজনক ছিল না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সে সময় খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের অনুষঙ্গী হিসেবেই প্রধানত মুদ্রণযন্ত্রের বিস্তার ঘটেছিল। কুইলন থেকে ছাপাখানা যায় কোচিন। এরপর পুডিকাইল, ভিপিকোট্টা, আমবালাকাট্টা, ট্যাংকুইবার বা ত্রিবাঙ্কুর, মাদ্রাজ, হুগলি। ছাপাখানা আনাগোনার মানচিত্রটি অস্পষ্ট, যদিও এর অগ্রগতি উপকূল ধরে হয়েছে বলে মনে করা হয়। দক্ষিণী ভাষায় প্রথম বই ছাপা হয় ১৫৭৮ সালে। অথচ বাংলায় প্রথম ছাপা বই ১৭৭৮ সালে। কুইলন থেকে হুগলি-ঠিক দুশো বছরের দূরত্ব। অবিশ্বাস্য হলেও ঘটনাটি সত্য।

হুগলিতে ছাপাখানা

গোয়ায় মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠার ২২২ বছর পর হুগলিতে প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানাটির কোনো নাম এবং প্রতিষ্ঠাকাল পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খ্রিস্টান মিশনারির ফাদার এন্ড্রুজ। এই ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত প্রথম বইটিকেই মুদ্রণযন্ত্রের প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে ধরে নেয়া হয়। ১৭৭৮ সালে এন্ড্রুজের ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয় ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হলহেডের Grammar of the Bengal Language। বইটি ছিল ইংরেজিতে। কিন্তু কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কালীদাসের মহাভারত আর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল বিদ্যাসুন্দর থেকে উদ্ধৃতি ছিল প্রচুর, যেগুলো ছাপা হয়েছিল বাংলা হরফে। সুতরাং ছাপার দিক হতে সেই প্রথম বাংলা হরফের দেখা। মুদ্রাকর ছিলেন চার্লস উইলকিনস এবং সহায়তায় ছিলেন পঞ্চানন কর্মকার।

চার্লস উইলকিনস

চার্লস উইলকিনস ছিলেন একজন ইংরেজ মুদ্রাকর, প্রাচ্য ভাষাবিদ এবং কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। ১৭৭০ সালে তিনি ভারতে এসে মুদ্রক ও লেখক হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দেন। মালদহে কর্মরত থাকাকালীন তিনি বাংলা, সংস্কৃত এবং ফরাসি ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। ১৭৭৮ সালে বাংলা মুদ্রণের প্রথম ছাঁচ-নকশা তৈরি করেছিলেন তিনি। ভারতে প্রথম অক্ষরস্থাপক বই প্রকাশ এবং বাংলা হরফের ছাঁচ তৈরির কারণে তাকে ‘বাংলার ক্যাক্সটন’ নামে আখ্যা দেয়া হয়।

পঞ্চানন কর্মকার

পঞ্চানন কর্মকার লিপিকরের কাজ করতেন। চার্লস উইলকিনস যখন বাংলা হরফের ছাঁচ-কাটা ও ঢালাই কাজ করার জন্যে দেশীয় সহকারী খুঁজছিলেন, পঞ্চাননের সঙ্গে তখনই তার পরিচয় হয়। উইলকিনসের তত্ত্বাবধানে পঞ্চানন তার ব্যবহারিক প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে ধাতব হরফ তৈরি করে বাংলা মুদ্রাক্ষরের প্রচলন ঘটান। তখন শব্দের আগে, মধ্যে ও শেষে ব্যবহৃত স্বর ও ব্যঞ্জনের চিহ্নগুলো আলাদা করে কাটা হতো। এর ফলে অক্ষরগুলোর মধ্যে অনেক ফাঁকা জায়গা থেকে যেত। পঞ্চানন তার নিপুণ কর্তনের সাহায্যে এ ব্যবধান কমিয়ে আনেন। শেষ বয়সে তিনি জামাতা মনোহর কর্মকারকে এ বিদ্যায় প্রশিক্ষণ দেন। দীর্ঘ ১৮ বছর মেধা ও নিষ্ঠা দ্বারা বাংলাসহ আরো ১৪টি ভাষার বর্ণমালার হরফ তৈরি করে এ শিল্পকে সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারিত করেন তিনি।

কলকাতায় ছাপাখানা

১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকি বাংলায় প্রথম সংবাদপত্রBengal Gazetteছেপেছিলেন। অনেকের মতে সেটিই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম ছাপাখানা। ১৭৮০ সাল থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত আনুমানিক বারোটি ছাপাখানা চালু ছিল। ১৭৭৯ সালে তদানীন্তন গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের উৎসাহ এবং উইলকিনসের পরিচালনায় কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়।

জেমস অগস্টাস হিকি

কলকাতার প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক জেমস অগস্টাস হিকি জাহাজে চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কলকাতায় পৌঁছান ১৭৭২ সালের ডিসেম্বরে। ১৭৭৬ সালের অক্টোবরে ব্যবসায়িক দেনার দায়ে জেলে যেতে হয় হিকিকে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর হাতে থাকা হাজার দুয়েক টাকা দিয়ে তিনি কিছু টাইপ সংগ্রহ করেন এবং একটি কাঠের ছাপাখানা তৈরি করিয়ে ছাপার কাজ শুরু করেন ১৭৭৭ সালে। পরবর্তী তিন বছরে শহরের একচেটিয়া মুদ্রাকর ছিলেন তিনি।

শ্রীরামপুরের ছাপাখানা

কলকাতার পাশাপাশি শ্রীরামপুরও মুদ্রণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। উইলিয়াম কেরি ১৮০০ সালে শ্রীরামপুরে প্রতিষ্ঠা করেন ব্যাপটিস্ট মিশন এবং সঙ্গে সঙ্গে ছাপাখানাও। একই সময়ে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। ১৮০০ সালে শ্রীরামপুর থেকে প্রথম বই বের হওয়ার পর বাংলায় মুদ্রিত গ্রন্থের চাহিদা আসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে। কালক্রমে ছাপাখানাটি এশিয়ার বৃহত্তম অক্ষর নির্মাণ কারখানার মর্যাদা লাভ করে।

উইলিয়াম কেরি

উইলিয়াম কেরি একাধারে ধর্ম প্রচারক, শিক্ষক ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন। ১৭৯৩ সালে খ্রিস্টান মিশনারির সাথে কলকাতায় আসেন। উইলিয়াম কেরি বাইবেলকে প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেছেন তা নয়; বরং ভারতীয় রামায়ণকে ইংরেজিতে অনুবাদও করেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান ছিলেন তিনি।

বটতলার বইহাট

উনিশ শতক থেকে বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনার কেন্দ্র হয়ে ওঠে কলকাতা। কলকাতা থেকে পরবর্তী কয়েক দশকে ছাপাখানা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। মফস্বল থেকেও প্রকাশিত হতে থাকে বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা। সে সময় কাগজের সরবরাহ দুভাবে হতো-ব্রিটেন থেকে আমদানি এবং এদেশে হাতে তৈরি কাগজ। অষ্টাদশ শতকে কলকাতায় দুইটি কাগজের কল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথা জানা যায়। বই ছাপার আগে সে সময়েই কাগজে বিজ্ঞাপন বের হতো সম্ভাব্য ক্রেতাদের সজাগ করতে। কিছু কিছু বইয়ের জন্য অগ্রিম গ্রাহকও সংগ্রহ করা হতো। বই লেনদেনের জন্য অষ্টাদশ শতকে একাধিক সার্কুলেটিং লাইব্রেরি চালু হয়েছিল। ইউরোপ, বিলেত থেকেও বই আমদানি করা হতো। ১৮১৮-২০ সালের মধ্যে কলকাতার বটতলায় স্থাপিত হয় ছাপার যন্ত্র। উনিশ শতকের প্রথম দশকেই চার-পাঁচটি ছাপাখানা ছিল সেখানে। দেখতে দেখতে জমজমাট কলকাতার বটতলা।

পূর্ববঙ্গে ছাপাখানা

কলকাতা থেকে পূর্ববঙ্গে মুদ্রণ যন্ত্র পৌঁছতে সময় লেগেছিল ষাট বছরের বেশি। কলকাতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকাসত্ত্বেও কেন এমনটি ঘটেছিল এর সঠিক উত্তর দেয়া কঠিন। পূর্ববঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশে প্রথম কোথায় মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হয়েছিল নির্দিষ্টভাবে তা জানা যায়নি। তবে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে বলা যায়, বাংলাদেশে প্রথম মুদ্রণ যন্ত্রটি স্থাপিত হয়েছিল রংপুরে। ১৮৪৭-৪৮ সালে রংপুরে প্রথম ছাপাখানা ‘বার্তাবহ যন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সত্তর-আশির দশকে ঢাকায় স্থাপিত প্রথম ছাপাখানাটির নাম ছিল Dacca Press। এখান থেকেDacca Newsনামে ইংরেজি সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। ১৮৬০ সালে বাংলা প্রেস বা বাংলা যন্ত্র নামে ঢাকায় দ্বিতীয় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এবার এক নজরে দেখে নেয়া যাক সে সময় পূর্ববঙ্গের কোন কোন অঞ্চলে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হয়েছিল:[১]

বাংলা মুদ্রণের প্রথম যুগে যেমন পঞ্চানন ও মনোহরের অবদান স্মরণীয় তেমনি এর আধুনিকীকরণে উল্লেখযোগ্য দুই ব্যক্তি হলেন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ও আনন্দবাজার পত্রিকার সুরেশচন্দ্র মজুমদার।

উপেন্দ্রকিশোর রায়

উপেন্দ্রকিশোর রায় তার প্রথম বইছোটদের রামায়ণর চিত্রমুদ্রণের মান দেখে অসন্তুষ্ট হয়ে ১৮৯৫ সালে বিলেত থেকে আধুনিকতম যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে নিজেই একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৬ সালের দিকে স্টুডিও, ডার্করুম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে নানা রঙের হাফটোন মুদ্রণ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। গণিতে গভীর ব্যুৎপত্তি এবং সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির সাহায্যে উপেন্দ্রকিশোর

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion