মিস্টার আজহার কলকাতার নাম-করা তরুণ ব্যারিস্টার।

বাটলার, খানসামা, বয়, দারোয়ান, মালি, চাকর-চাকরানিতে বাড়ি তার হরদম সরগরম।

কিন্তু বাড়ির আসল শোভাই নাই। মিস্টার আজহার অবিবাহিত।

নাম-করা ব্যারিস্টার হলেও আজহার সহজে বেশি কেস নিতে চায় না। হাজার পীড়াপীড়িতেও না। লোকে বলে, পসার জমাবার এও একরকম চাল।

কিন্তু কলকাতার দাবাড়েরা জানে যে, মিস্টার আজহারের চাল যদি থাকে— তা সে দাবার চাল।

দাবা-খেলায় তাকে আজও কেউ হারাতে পারেনি। তার দাবার আড্ডার বন্ধুরা জানে, এই দাবাতে মিস্টার আজহারকে বড়ো ব্যারিস্টার হতে দেয়নি, কিন্তু বড়ো মানুষ করে রেখেছে।

বড়ো ব্যারিস্টার যখন ‘উইকলি নোটস’ পড়েন আজহার তখন অ্যালেখিন, ক্যাপাব্লাঙ্কা কিংবা রুবিনস্টাইন, রেটি, মরফির খেলা নিয়ে ভাবে, কিংবা চেস-ম্যাগাজিন নিয়ে পড়ে, আর চোখ বুজে তাদের চালের কথা ভাবে।

সকালে তার হয় না, বিকেলের দিকে রোজ দাবার আড্ডা বসে। কলকাতার অধিকাংশ বিখ্যাত দাবাড়েই সেখানে এসে আড্ডা দেয়, খেলে, খেলা নিয়ে আলোচনা করে।

আজহারের সবচেয়ে দুঃখ, ক্যাপাব্লাঙ্কার মতো খেলোয়াড় কিনা অ্যালেখিনের কাছে হেরে গেল। অথচ অ্যালেখিনই বোগোল-জুবোর মতো খেলোয়াড়ের কাছে অন্তত পাঁচ পাঁচবার হেরে যায়!

মিস্টার মুখার্জি অ্যালেখিনের একরোখা ভক্ত। আজও মিস্টার আজহার নিত্যকার মতো একবার ওই কথা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলে, মিস্টার মুখার্জি বলে উঠল— ‘কিন্তু তুমি যাই বল আজহার, অ্যালেখিনের ডিফেন্স— ওর বুঝি জগতে তুলনা নেই। আর বোগোল-জুবো? ও যে অ্যালেখিনের কাছ তিন-পাঁচে পনেরোবার হেরে ভূত হয়ে গেছে! ওয়ার্লড-চ্যাম্পিয়ানশিপের খেলায় অমন দু চার বাজি সমস্ত ওয়ার্লড-চ্যাম্পিয়ানই হেরে থাকেন। চব্বিশ দান খেলায় পাঁচ দান জিতেছে। তা ছাড়া, বোগোল-জুবোও তো যে সে খেলোয়াড় নয়!’

আজহার হেসে বলে উঠল, ‘আরে রাখো তোমার অ্যালেখিন। এইবার ক্যাপাব্লাঙ্কার সাথে আবার খেলা হচ্ছে তার, তখন দেখো একবার অ্যালেখিনের দুর্দশা! আর বোগোল-জুবোকে তো সেদিনও ইটালিয়ান মন্টেসেলি বগলা-দাবা করে নিলে! হাঁ, খেলে বটে গ্রানফেল্‌ড।’

বন্ধুদের মধ্যে একজন চটে গিয়ে বললে, ‘তোমাদের কি ছাই আর কোনো কম্ম নেই? কোথাকার বগলঝুপো না ছাইমুণ্ডু, অ্যালেখিন না ঘোড়ার ডিম— জ্বালালে বাবা।’

মুখার্জি হেসে বলল, ‘তুমি তো বেশ গ্রাবু খেলতে পার অজিত, এমন মাহ ভাদর, চলে যাওনা স্ত্রীর বোনেদের বাড়িতে! এ দাবার চাল তোমার মাথায় ঢুকবে না!’

তরুণ উকিল নাজিম হাই তুলে তুড়ি দিয়ে বলে উঠলে, ‘ও জিনিস মাথায় না ঢোকাতে বেঁচে গেছি বাবা! তার চেয়ে আজহার সাহেব দুটো গান শোনান, আমরা শুনে যে যার ঘরে চলে যাই। তার পর তোমরা রাজা মন্ত্রী নিয়ে বোসো।’

দাবাড়ে দলের আপত্তি টিকল না। আজহারকে গাইতে হল। আজহার চমৎকার ঠুংরি গায়। বিশুদ্ধ লখনউ ঢং-এর ঠুংরি গান তার জানা ছিল। এবং তা এমন দরদ দিয়ে গাইত সে, যে শুনত সেই মুগ্ধ হয়ে যেত। আজ কিন্তু সে কেবলই গজল গাইতে লাগল।

আজহার অন্য সময় সহজে গজল গাইতে চাইত না।

মুখার্জি হেসে বলে উঠল,– ‘আজ তোমার প্রাণে বিরহ উথলে উঠল নাকি হে? কেবলই গজল গাচ্ছ, মানে কী? রংটং ধরেছে নাকি কোথাও!’

আজহারও হেসে বলল, ‘বাইরের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো।’

এতক্ষণে যেন সকলের বাইরের দিকে নজর পড়ল। একটু আগের বর্ষা-ধোয়া ছলছলে আকাশ। যেন একটি বিরাট নীল পদ্ম। তারই মাঝে শরতের চাঁদ যেন পদ্মমণি। চারপাশে তারা যেন আলোক-ভ্রমর।

লেক-রোডের পাশে ছবির মতো বাড়িটি।

শিউলির সাথে রজনিগন্ধার গন্ধ-মেশা হাওয়া মাঝে মাঝে হলঘরটাকে উদাস-মদির করে তুলছিল!

সকলেরই চোখ মন দু-ই যেন জুড়িয়ে গেল!

নাজিম সোজা হয়ে বসে বলল, ‘ওই দাবার গুটি নিয়ে বসলে কি আর এসব চোখে পড়ত?’

আজহার দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যমনস্কভাবে বলে উঠল, ‘সত্যিই তাই।’

মুখার্জি বলে উঠল, ‘না; এ শালার শিউলির ফুল আজ দাবা খেলতে দেবে না দেখছি!’

আজহার বিস্মিত হয়ে বলে উঠল, ‘তোমারও শিউলি! ফুলের সঙ্গে কোনো কিছু জড়িত আছে নাকি হে?’

তারা কিছু বলবার আগেই অজিত বলে উঠল, ‘আরে ছোঃ! দাবাড়ের আবার রোমান্স! বেচারার জীবনে একমাত্র লাভ-অ্যাফেয়ার স্ত্রীর সঙ্গে! নিজের স্ত্রীর প্রেমে পড়া! রাম বলো! তাও— সে স্ত্রী চলে গেছেন বাপের বাড়ি— ওই দাবার জ্বালায়! ওর আবার শিউলি ফুল!’

সকলে হো হো করে হেসে উঠল। মুখার্জি চটে গিয়ে বলে উঠল, ‘তুই থাম অজিত! পাগলের মতো যা তা বকলেই তাকে রসিকতা বলে না!’

অজিত মুখ চুন করার ভান করে বলে উঠল, ‘আমি তো রসিকতা করিনি দাদা। তুমি সত্যসত্যই তোমার স্ত্রীর প্রেমে পড়েছ— দশ জনে বদনাম দেয়, তাই আমিও বললাম। ওঁরা যদি তা শুনে হাসেন তাতে আমার কী দোষ হল?’

আজহার হেসে বলে উঠল, ‘এ কী তোমার অন্যায় অপবাদ অজিত? স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়া আর কারুর সঙ্গে দাবাড়ের কোনো কিছু দুর্ঘটনা ঘটতে পারে না, এ তুমি কী করে জানলে?’

অজিত বললে, ‘প্রথম মিস্টার মুখার্জি, তার পর তোমাকে দেখে!’

আজহার বলে উঠল, ‘আরে, আমি যে বিয়েই করিনি।’

অজিত বলে উঠল, ‘তার মানে, তোমার অবস্থা আরও শোচনীয়! ও বেচারা তবু অন্তত স্ত্রীর সঙ্গে লভে পড়ল, তোমার আবার স্ত্রীই জুটল না!’

নাজিম টেবিল চাপড়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘ব্রাভো! বেঁচে থাকুন অজিতবাবু। এইবার জোর বলেছেন!’

এমন সময় মালি শিউলিফুলের একজোড়া চমৎকার গোড়ে মালা টেবিলের উপর রেখে চলে গেল। অজিত গম্ভীরভাবে মালা দুটি ব্র্যাকেটে ঝুলিয়ে রাখতেই সকলে হেসে উঠল। অজিত অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে অভিনয় করার সুরে বলে উঠল, ‘হে ব্র্যাকেট-সুন্দরী! আজি এই শুক্লা শারদীয়া নিশীথে এই সেঁউতি মালার–’

আজহার ম্লান হাসি হেসে বাধা দিয়ে বলল, ‘দোহাই অজিত। ও-মালা নিয়ে বিদ্রুপ করিসনে ভাই! ও-মালা আমার নয়!’

অজিত নাছোড়বান্দা! তার বিস্ময়কে চাপা দিয়ে বলে উঠল, ‘ তবে এ-মালা কার বন্ধু? থুড়ি— কার উদ্দেশে বন্ধু?’

নাজিম বলে উঠল, ‘দেখো, দাবাড়ের নাকি রোমান্স নেই?’

আজহার বলে উঠল, ‘আমি প্রতি বছর এমনি পয়লা আশ্বিন শিউলিফুলের মালা জলে ভাসিয়ে দেই। এ-মালা জলের–অন্য কারুর নয়।’ মুখে বিষাদমাখা হাসি।

মায় দাবাড়ের দল পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠে বসল। অজিত বয়কে হাঁক দিয়ে চা আনতে বলে ভালো করে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে বসে আজহারের দিকে চেয়ারটা ফিরিয়ে বলে উঠল, ‘তারপর বলো তো বন্ধু ব্যাপারটা কী! সঙিন নিশ্চয়ই! পয়লা আশ্বিন— প্রতি বছর শিউলিমালা জলে ভাসিয়ে দেওয়া! চমৎকার গল্প হবে! বলে ফেলো। নইলে, এইখানে সকলে মিলে সত্যাগ্রহ আরম্ভ করে দেব!’

সকলে হেসে উঠল, কিন্তু সায় দিল সকলে অজিতের প্রস্তাবে।

অনেক পীড়াপীড়ির পর আজহার হেসে বলে উঠল, ‘কিন্তু তারও আরম্ভ যে দাবা খেলা দিয়ে!’

অজিত লাফিয়ে বলে উঠল, ‘তা হোক! ও পলতার সুক্তো খেয়ে ফেলা যাবে কোনো রকমে, শেষের দিকে দই-সন্দেশ পাব।’

মুখার্জি বলে উঠল, ‘এ দাবা খেলায় নৌকোর কিস্তিই বেশি থাকবে হে! গজ ঘোড়া কাটাকাটি হয়ে যাবে ! ভয় নেই!’

সকলের আর এক প্রস্থ চা খাওয়া হলে পর সিগার ধরিয়ে মিনিটখানিক ধূম্র উদ্‌গীরণ করে আজহার বলতে লাগল–

তখন সবেমাত্র ব্যারিস্টারি পাশ করে এসেই শিলং বেড়াতে গেছি। ভাদ্র মাস। তখনও পূজার ছুটিওয়ালার দল এসে ভিড় জমায়নি। তবে আগে থেকেই দু-একজন করে আসতে শুরু করেছেন। ছেলেবেলা থেকেই আমার দাবাখেলার ওপর বড্ডো বেশি ঝোঁক ছিল। ও ঝোঁক বিলেতে গিয়ে আরও বেশি করে চাপল। সেখানে ইয়েটস্‌, মিচেল, উইন্টার, টমাস প্রভৃতি সকল নাম-করা খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলেছি এবং কেম্ব্রিজের হয়ে অনেকগুলো খেলা জিতেওছি। শিলং গিয়ে

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion