কমিউনিস্ট শিল্পীর বাস্তবতার সন্ধান : সেকেরাস
অগ্রগমনের স্তরে, নিজেকে ক্রমশ বদল করতে করতে, এক ব্যাপকতর সামাজিক চৈতন্যময়তায় সংযুক্তি লাভ করে শিল্প—এইরকমই এক অনুভবের মধ্যে মার্কসবাদ ও কমিউনিজমে বিশ্বাসী সমস্ত শিল্পীদের শিল্পচেতনা চিরকাল ভর পেয়ে এসেছে। এই বিশ্বাসের মধ্যেই তাঁদের নতুন বাস্তবচেতনার আশ্রয়, এর মধ্যেই তাঁরা খুঁজে নেন তাঁদের শিল্পসৃষ্টির অন্বিষ্টকে, যদিও এই বাস্তবতার চরিত্র ও মাত্রা সময়ের বিবর্তনে বদলে যায়। তাই পোশাক বদলের সঙ্গে সঙ্গে আভ্যন্তরীণ শিল্পকাঠামো নতুন নাড়ীর স্পন্দনে জেগে ওঠে, তাপ ও নিশ্বাস গ্রহণের পালাবদলের মধ্যে তার সম্পূর্ণ অবয়বটি ধরা দিতে থাকে তখন, আরো বিস্তৃত কোনো সংযুক্তির তাগিদে ৷ রাস্তবতা সম্পর্কে এই জাতীয় বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ লক্ষ করা যাবে মেক্সিকোর ম্যুরাল শিল্পী ডেভিড সেকেরাসের ‘আর্ট এণ্ড রেভলিউশন’ গ্রন্থের একটি অধ্যায়ে যেখানে তিনি সোভিয়েত শিল্প ও পিকাসো সম্পর্কে নিজের কিছু ভাবনা ব্যক্ত করেছেন। সমস্ত গ্রন্থে বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত সেকেরাসের ২২টি ভাষণ সন্নিবেশিত হয়েছে, কখনও সম্পূর্ণভাবে, আবার কখনও সেইসব ভাষণের কিছু অংশবিশেষ। গোটা বইটি আমাদের রীতিমতো প্ররোচিত করে। সেই সঙ্গে একটা প্রাসঙ্গিক আকর্ষণীয় তথ্য আছে এই বইয়ের প্রায় শেষ অংশে। সেকেরাসেরই ঈষৎ সীমায়িত কোনো অনুকরণে তথ্যটি আমরা এই আলোচনার শেষ পর্বের জন্য তুলে রাখলাম৷
বাস্তবতা ও টেকনিকের বিচারে সোভিয়েত শিল্পের যে সমালোচনা সেকেরাস করেছেন তা কমিউনিজমে গভীরভাবে বিশ্বাসী এক শিল্পীরই সচেতন ভাবনার পরিচয় তুলে ধরে। সেইসঙ্গে মেক্সিকোর চিত্রকলার সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন তিনি, অনুভব করতে চেয়েছেন নিজের সীমাবদ্ধতা। তাই সোভিয়েত শিল্পের যে-সমালোচনা করেছেন তিনি, তার মধ্যে আত্মবিশ্লেষণও একটা বড় জায়গা করে নিয়েছে। কম্যুনিস্ট শিল্পীর এই সততা আসলে তাঁর বাস্তবতার ক্রমিক অনুসন্ধানেরই প্রতিফলন। সেকেরাস এক জায়গায় জানাচ্ছেন,
‘আমি নিশ্চিত যে আমার সোভিয়েত বন্ধুশিল্পীরা স্বীকার করবেন যে বাস্তবতা কোনো স্থির ফরমূলা নয়, অপরিবর্তনীয় কোনো নিয়মের মধ্যেও আবদ্ধ নয় সে। শিল্পের ইতিহাস ও তার অগ্রগতি এই সাক্ষ্যই বহন করে যে বিভিন্নসময়ে এই বাস্তবতার ফর্ম ও সেই সংক্রান্ত ভাবনা আরো ব্যাপক ও গভীরতর কোনো অন্বেষণের তাগিদে নিজেকে বারবার পরিবর্তন করেছে। প্রাচীনযুগ, মধ্যযুগ ও রেনেসাসের বেলায় কথাটা পুরোপুরি সত্য। যাঁরা বলে থাকেন যে কোনো শিল্পকর্মই অপর একটি থেকে গুণগতভাবে উঁচুমানের নয়, এবং কোনো যুগের শিল্পই অন্য আর একটি যুগের তুলনায় বড় নয়, তাঁদের সেই ধারণার সঙ্গেও আমরা মিলিত হতে পারি। কিন্তু এ থেকে আমরা এই সত্য অস্বীকার করতে পারি না যে শিল্পভাবনা তার দীর্ঘ পরিক্রমণের পথে নতুনতর সমৃদ্ধ ফর্মগুলির এক ধারাবাহিক অন্বেষণ, বাস্তবতা প্রকাশের পরিণত, উন্নত ও আরো প্রকাশক্ষম কোনো ভাষার নিয়ত-নিশ্চিত এক অনুসন্ধান। যে যুগের শিল্প অপরিবর্তনীয় কোনো ফর্মুলার ধারণায় আড়ষ্ট না থেকে নতুন রূপ-রীতির উদ্ভাষণে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে, তখনই সেখানে আরো গভীর কোনো এক বাস্তবতার ইঙ্গিত দিয়েছি আমরা। ধারাবাহিক অগ্রগমনের নামে শিল্পসৃষ্টির নতুন পদ্ধতিগুলির আবিষ্কার ছাড়া বাস্তবতাকে আর অন্য কোনো ভাবে চিহ্নিত করতে পারি না আমরা।’
সেকেরাস তাই সোভিয়েত শিল্পকর্মের মধ্যে ফর্মনির্ভর এক ধরনের তাত্ত্বিক প্রকাশ দেখতে পাচ্ছেন, সেইসঙ্গে বাস্তবতার ঈষৎ যান্ত্রিক এক অনুবর্তন। কিন্তু নিজের দেশের শিল্পকর্ম সম্বন্ধেও তাঁর অকপট স্বীকারক্তি—‘we have been contaminated by formalism’—যে প্রভাবের উৎস, তাঁর মতে, বুর্জোয়া অর্থনীতির মধ্যে ৷ মার্কসবাদ ও কমিউনিজম বিশ্বাসী শিল্পীদের বাস্তবতার এই ক্রমিক অনুসন্ধান সত্বেও বুর্জোয়া শিল্পতাত্ত্বিকরা অনেকসময় এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে মার্ক্সীয় শিল্পীরা নাকি বাস্তবতার বহিরঙ্গ ও পরোক্ষ এক প্রতিফলনের মধ্যে তাঁদের চৈতন্যময়তাকে আবদ্ধ রাখেন যেমন ভেবেছিলেন এর্নষ্ট কেসিরা, অথবা এডওয়ার্ড বেলার্ড। প্রতিফলন বা ছায়া নয়, পুনরুক্তিও নয়, বরং শিল্পকে মার্কসীয় তাত্ত্বিকেরা বাস্তবতার সৃজনধর্মী পুনরাবর্তন হিসেবেই লক্ষ্য করেছিলেন। আমাদের প্রসঙ্গত মনে হতে পারে বৃদ্ধবয়স সম্পর্কে বালজাকের অপূর্ব বাস্তবানুগ এই কয়েকটি শব্দের চিত্রণ, যা অন্য আর এক শিল্পিত উপলব্ধির সঙ্গে আসক্ত করে আমাদের— ‘The winter of life : red nose, hollow cheeks and numbed fingers.’ এখানে শব্দের সুনিপুণ প্রয়োগে বাস্তবতার এক গূঢ় চিত্র আঁকেন বালজাক।
শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে সৃষ্টিময়তার বিচিত্র প্রকাশের মধ্যেই যে মার্কসবাদীরা তাঁদের দৃঢ় কোনো আশ্রয়ভূমি খুঁজে নেন তারই প্রমাণ শিল্পবোধ, বাস্তবতা ও শিল্পচর্চার মাধ্যম নিয়ে তাঁদের নিরন্তর গবেষণা। সেকেরাসের আলোচনা এই সত্যই প্রমাণ করে। আবার বাস্তবতার সঙ্গে ধর্ম এবং ‘মাইথলজি’র সম্পর্ক নিয়ে এই সেকেরাস সম্পর্কেই আভনার জিস তাঁর ‘ফাউণ্ডেসানস্ অব মার্কসিস্ট ইসথেটিক্স’ গ্রন্থে যে অভিমত প্রকাশ করেছেন তাও এখানে স্মরণযোগ্য। জিস বলছেন যে ভিন্ন কারণে ধর্ম-সংক্রান্ত কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করেও একজন বাস্তবতাবাদী তাঁর শিল্পকে গড়ে নিতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে জিস সেকেরাসের নাম উল্লেখ করেছেন, এবং তাঁরই সহযোগী মেক্সিকোর শিল্পী জোস অরজকোর (José Orozco) ‘Chryst Destroys His Cross’ এই শিল্পকর্মটির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বাস্তবতা নিয়ে এক ধারাবাহিক ভাবনা ও জিজ্ঞাসার পরিচয় বহন করে এইসব সচেতন বিশ্লেষণ। এই বাস্তবতার খাতিরেই সেকেরাস নিজে প্যারিসের ‘ফর্মালিস্ট’ চিত্রকলা সম্পর্কে বারবার তাঁর অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
আসলে আজীবন সংগ্রামী শিল্পী সেকেরাস ম্যুরাল শিল্প নিয়ে তাঁর অবিরাম চর্চাকে এক বৃহত্তর সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরই পরিপূরক হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ না থাকলেও সেকেরাস একজন অক্লান্ত কর্মী। শিল্পকর্মকে তিনি গ্যালারি-প্রদর্শনীর পোশাকি আবহাওয়া থেকে মুক্ত করে রৌদ্র ও বর্ষণে স্নাত খোলা আকাশের নীচে টেনে আনতে চান, সেখানে তাঁর সচেতন অভিপ্রায়ের সঙ্গে ব্যাপক জনমানসের সংযুক্তি সম্ভব হতে পারে। সংগ্রাম ও প্রতিরোধের চিত্র আঁকবার জন্য লস এঞ্জেলস্ থেকে বিতাড়িত হন তিনি। কিন্তু ম্যুরাল শিল্পকর্মকে তিনি কতখানি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন তারই স্মারক হয়ে থাকে ১৯৩২-এ লস এমেলস্ থেকেই মেক্সিকোতে বসবাসকারী এক আমেরিকান বন্ধুকে লেখা তাঁর একটি চিঠি। অন্য এক প্রসঙ্গে সেকেরাস জানাছেন,
যদি কেউ আপনাকে জিজ্ঞাসা করেন এমন বিষয় নিয়ে কেন আপনার ম্যুরাল শিল্প কর্ম আঁকেন যা কখনই স্থায়ী হতে পারে না—শত্রুপক্ষ মুছে ফেলে আপনার সেইসব কাজ? আমার উত্তর এই যে সংগ্রামের যে-উদ্দেশ্যগুলিকে আমার শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে আমার সামনে আমি দেখতে চেয়েছি সেই উদ্দেশ্যের মধ্যেই আমাদের এই ম্যুরালিস্ট আন্দোলন তার পরিণত চেহারা খুঁজে নেবে। ম্যুরালিস্ট আন্দোলনের মধ্যেই প্রলেতারিয়ান ইচ্ছাগুলি বাস্তবে রূপায়িত হয়ে উঠবে ৷
সেকেরাসের দীর্ঘ সংগ্রামী শিল্পচর্চার শুরু সেই ১৯১১-তে যখন ইউরোপের অভিব্যক্তিবাদী চিত্রকলার বিরুদ্ধে এক আন্দোলনে তিনি সামিল হয়েছিলেন। ১৯৭৪-এ মারা গিয়েছেন সেকেরাস, কিন্তু রেখে গেছেন পাবলিক অট্টালিকাগুলির বাইরে উৎকীর্ণ তাঁর অজস্র ম্যুরাল শিল্পকর্মকে, যা রোদ, বৃষ্টি, ঝড় মাথায় করে জনমানসের চেতনায় বাস্তবতার নতুন এক অভিব্যক্তি হিসেবে আজও ধরা আছে ৷
উত্তেজক যে তথ্যটি এখনও আমাদের সঙ্গে আছে তা হল এই মহান শিল্পী ভারতবর্ষে এসেছিলেন। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাঁর সম্পর্কে গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিলেন, সেই সঙ্গে মেক্সিকোর শিল্পকলা সম্পর্কেও। সেকেরাসের অনুপ্রেরণায় ভারতবর্ষে শিল্পকর্মকে সীমিত মানুষের ঘেরাটোপ থেকে বের করে এনে সমগ্র জনসমাজের কাজে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন জওহরলাল। আরও স্মরণযোগ্য যে সেকেরাস নিজেই আমাদের এই তথ্য জানিয়েছেন।
তপনকুমার ঘোষ
পরিচয়, ফাল্গুন-চৈত্র ১৩৯০
ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৮৪
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment