শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের চল্লিশ বছরের চিত্র সাধনায় যবনিকা পড়ে গেল। বাঙলাদেশের এই ক্লান্তিহীন শিল্পী তাঁর কর্মক্ষেত্র ঢাকায় তাঁর সমাপ্ত ও অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের নানাধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার মাঝখানটিতে চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন। মৃত্যুর কারণ ফুসফুসে ক্যানসার। চার বছর আগে স্ট্রোকে তাঁর জীবনসংশয় হয়েছিল। তাঁর কব্জি এবং আঙুল ভিতরে ভিতরে জখম হয়েছিল। কিন্তু অনেক কাজ পড়ে আছে এবং সাধারণভাবে বাঙলাদেশের ছবি আঁকার সাধনায় যারা নেমেছে, তাদের লড়াইকে এগিয়ে নেবার সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে নিজস্ব ছবি আঁকার পদ্ধতিকে আরো কঠিন ভাবে সামলে জানতে হবে—এই তাগিদ তাঁকে সহায়তা করেছিল অরোগ্যের সংগ্রামে। তিনি জয়ী হয়েছিলেন বলা যেতে পারে। নতুন শক্তি ঢেলে তিনি ছবির পর ছবি আঁকছিলেন। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো তাঁর সুঠাম ও বলিষ্ঠ দেহটিকে আক্রমণ করল ক্যানসার। লণ্ডনে গিয়ে একটা শেষ চেষ্টা করে ডাক্তারদের কাছ থেকে মৃত্যুর বিজ্ঞপ্তি নিয়ে ফিরে এলেন প্রিয় মাতৃভূমি সোনার বাঙলার ঢাকার। এর পর চার মাস ধৈর্য ধরে শুধু মৃত্যুর জন্যই প্রতীক্ষা। এবার আর ছবি আঁকার ফুরসতটুকু পেলেন না।

মৃত্যু জয়নুল আবেদীনের সাধনায় বাদ সেধেছে। কিন্তু আমৃত্যু যে কঠোৱ শ্রম তিনি করেছেন, তা তাঁকে বাঙলাদেশে এবং সেই সঙ্গে সারা পৃথিবীতে লোকস্মৃতিতে বাঁচিয়ে রাখবে।

“সারা পৃথিবীতে” কথাটা আবেগের বশে বেরিয়ে আসে নি এখানে।

পৃথিবীর দেশ দেশান্তরের সেরা শিল্পী ও সমঝদারেরা তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়েছেন। সেরা শিল্পীর পাওনা যে সম্মান, তা তিনি সর্বত্র পেয়েছেন। কিন্তু যেহেতু তিনি ছিলেন স্বল্পবাক্‌ এবং লেখাতেও অতি সংযমী, সে কারণে মেক্সিকোতে অথবা মস্কোয় বা পারী-তে তাঁর আদর যে কী গভীর আন্তরিক ছিল সেটা চাপা পড়ে গেছে। তিনি ছিলেন মজলিশী লোক এবং গল্পচ্ছলে কিছু কিছু বলেছিলেন এই মাত্র। কিন্তু ঘটনা হল, বাঙলাদেশের এই চিত্রী স্বীকৃতি পেয়েছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রভাণ্ডারে এবং শিল্পীদের কাছে।

একবার তিনি তাঁর একটি মজলিশী গল্পে বলেছিলেন এক অভিজ্ঞতার কথা। বাইরের একটি চিত্রভাণ্ডারে তাঁকে সম্মানিত করতে গিয়ে যেসব উচ্ছ্বসিত কথা বলা হচ্ছিল, তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, তোমাদের এখানে তো দেখছি আমার একটি মাত্র ছবি আছে এবং সেটিতেও আছে কয়েকটা কাক ও দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের প্রতিকৃতি; ভদ্রতা করে বানিয়ে প্রশংসা করছ তোমরা। এর উত্তরে সেই চিত্রভাণ্ডারের লোকেরা বলেছিলেন, তোমার এই কয়েকটা তুলির টানই তোমাকে পরিচিত করে দিয়েছে। তোমার পরিচয়ের জন্য আর কিছুর দরকার নেই। সাধনার পরিচয় হিসেবে যা চাই তা রেখে গিয়েছেন জয়নুল আবেদীন, হয়তো বিশেষ করে বাঙলাদেশের জন্যই এবং সেই সঙ্গে সাধারণভাবে, দেশ দেশান্তরের চিত্রভাণ্ডারেও নিশ্চিতভাবেই।

কলকাতা মহানগরীতে ১৯৪৩ সালে তিনি থাকতেন এবং এই নগরীতে তাঁর ঘরে বসেই বাঙলা পঞ্চাশ সনের দুর্ভিক্ষের ছবিগুলি এঁকেছিলেন এবং বিখ্যাত হয়েছিলেন। দুর্ভিক্ষের এবং দুর্ভিক্ষ যারা ঘনিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে এ ছবি ছিল তাঁর রক্ত কালো-হওয়া তীব্র প্রতিবাদ। এখানে অবশ্য তিনি কোনো করণীয়কে সামনে আনেন নি। বস্তুতপক্ষে বলা যেতে পারে, নিছক বাস্তববাদের আওতার মধ্যেই তিনি তাঁর অনুভবকে রূপ দিয়েছেন। কিন্তু এই স্বাচ্ছন্দ্য তুলির কয়েকটা টানে সত্যি ছবিটুকু ধরার মধ্যেই জয়নুল আবেদীনের বিপ্লবী শিল্প-চিত্তটি কাজ করেছিল। তিনি তাঁর বিপ্লবী ক্ষোভকে প্রকাশ করেছিলেন মহানগরীর পথে সেই গ্রামীন মানুষের যন্ত্রণায়। কৃষণ চন্দর যাদের নাম দিয়েছিলেন অন্নদাতা এবং যাদের নিয়ে সেই একই সময়ে লিখেছিলেন তাঁর উপন্যাসিকা ‘অন্নদাতা’, চিত্তপ্রসাদ যাদের ছবি এঁকে গণশিল্পী হয়েছিলেন এবং মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় যাদের নিয়ে লিখেছিলেন দুর্ভিক্ষ বিষয়ক উপন্যাস, জয়নুল আবেদীন তাদের সামনে রেখেছিলেন একান্তভাবে।

জয়নুল আবেদীন সেদিন তাঁর কয়েকটি যন্ত্রণার্ত ছবিতে যাদের এনেছিলেন, তাদের রাখলেন তাঁর পরবর্তী প্রায় সমস্ত ছবিতে। বলতে গেলে তিনি গ্রামীণ মানুষ ছাড়া অন্য কিছু আঁকলেন না যেন

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion