তিন-এর দশকের গোড়ায় ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ এবং ‘মাদার’ দেখে একজন জার্মান সমালোচক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন—’এতদিন জানতাম পুব দিক থেকে আলো আসে, এখন দেখছি চলচ্চিত্র শিল্পটি ঐদিক থেকেই আসছে—আজ একথা নিঃসংশয়ে বলা যায় রুশ ছবিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ।’ এই উচ্ছ্বাস অকারণ নয়। গ্রিফিথ গতিমান বিষয়কে চলচ্চিত্রের ভাষায় রূপায়িত করার প্রাথমিক ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন, কিন্তু আইজেনস্টাইন, গুদোভকিন আর দোভঝেঙ্কো সেই ভাষায় আনলেন ব্যাপ্তি, এঁদের হাতে, মঁতাজের কৌশলে, চলচ্চিত্র-ভাষা পেল নিজস্ব গতি। এ জন্যই পোটেমকিন দেখে ‘ইউনাইটেড, আর্টিস্ট’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস-এর মনে হয়েছিল, আইজেনস্টাইন ‘গতির বিজ্ঞান’ আয়ত্ত করেছেন। চলচ্চিত্র জগতে মঁতাজ-পদ্ধতির প্রভাব সঙ্গে সঙ্গে অনুভূত হয়েছে, আজও এটি এই ভাষার আবশ্যকীয় অঙ্গ। ‘পোটেমকিন’ ও ‘মাদার’-এর প্রথম প্রদর্শনের তিন-চার বছর পর আমেরিকায় লিউইস মাইলস্টোন এরিখ মারিয়া রেমার্কের অবিস্মরণীয় উপন্যাস ‘অল কোয়ায়েট ইন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ নিয়ে একটি ছবি করলেন। ১৯৩০ সালে ছবিটি রিলিজ হয়; সে সময়ে পোস্টারে লেখা হয়েছিল ‘এই ছবি সোভিয়েত চলচ্চিত্রের নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্মিত।’

এসব এখন অনেকেই জানেন। চলচ্চিত্রের ভাষা নির্মাণে প্রথম যুগের সোভিয়েত শিল্পীদের অবদান নিয়ে আলোচনাও হয়েছে অনেক। কিন্তু প্ৰায় সর্বদাই একটি প্রশ্ন উপেক্ষিত থেকেছে—বিপ্লবের পর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ঐতিহ্যহীন রুশ চলচ্চিত্রে এই অদ্ভুত বিকাশ সম্ভব হল কী করে? সমসাময়িক একজন ইংরেজ লেখকের মনে এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। ‘পোটেমকিন’ এবং ‘মাদার’ দেখে তিনি লিখেছিলেন—‘এক যুগ ধরে অন্য দেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা যে-সব জটিল প্রশ্নের সমাধান করতে পারেন নি বিপ্লবের পর কয়েক বছরের মধ্যে রুশ পরিচালকরা তা করলেন কী ভাবে?’ তিনি ভেবেছিলেন বিষয়বস্তুর ‘মানবতা’-র জন্যই এই কাজ সম্ভব হয়েছে। কিন্তু মানবতা-র ধারণা অত্যন্ত অস্বচ্ছ, আর সেজন্য মানবতাই কারণ বললে উত্তর নির্দিষ্ট হয় না।

প্রকৃত কারণের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ‘পোটেমকিন’-এর রচয়িতা নিজেই ছবিটি প্রথম প্রদর্শনের আট বছর পরে লেখা একটি সংক্ষিপ্ত ‘অটোবায়োগ্রাফিক্যাল নোট’-এ। তিনি লিখেছেন, রুশ বিপ্লব তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল 'a matter of blood and bones and innermost conviction'। আর তারই প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর কাজে, অস্ত্রোভস্কির নাটকের বিমূর্ত এবং এলোমেলো উপস্থাপনা থেকে ‘পোটেমকিন’-এ উত্তরণ এর ফলেই সম্ভব হয়েছে। এক কথায়, প্রথম যুগের সোভিয়েত চলচ্চিত্র-শিল্পীদের ভাষার গতি, বিষয়ের গতিশীলতা, অর্থাৎ বিপ্লবের গতিশীলতার ফল।

১৯২০-এর দশকের প্রথম দিকে অন্যান্য দেশে যে-সব উল্লেখযোগ্য ছবি তৈরি হয়েছে সেগুলির বিষয়বস্তুর সঙ্গে আইজেনস্টাইন বা পুদোভকিনের ছবির বিষয়বস্তুর তুলনা করলে এই বক্তব্যের তাৎপর্য ধরা পড়ে। গ্রিফিথের সব ছবির রচনাকাল ১৯০৯ থেকে ১৯২৪। এর মধ্যে দুটি বিশিষ্ট ছবি ‘দ্য বার্থ অব এ নেশন’ ১৯১৫ সালে এবং ‘ইনটলারেন্স’ ১৯১৬ সালে তোলা। প্রথম ছবিটির বিষয়বস্তু নিগ্রো সমস্যা এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের বিরোধ ; পরিচালকের দৃষ্টিকোণ নিগ্রোবিরোধী, তাঁর সমর্থন দক্ষিণের প্রতি। দ্বিতীয় ছবিটি অসহনশীল মানসিকতা নিয়ে পরিচালক দেখাতে চেয়েছেন অসহনশীলতা কী ভাবে ক্ষতিকর এবং মানবসমাজের পক্ষে ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে। ১৯২০-২১ সালে তোলা ফ্ল্যাহার্টির ‘নানুক অব দ্য নর্থ’ একটি অসাধারণ ছবি : এস্কিমোদের জীবন নিয়ে এটি একটি তথ্যচিত্র, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংগ্রাম, এর বিষয়বস্তু। একই সময়ে তোলা রবার্ট ওয়েনের ডঃ কালিগরি (১৯২০) অসুস্থ মানসিকতার আর অসহায়তার শিল্পরূপ, ফ্রিজ ল্যান্সের ডেসটিনি (১৯২১) বা ডঃ ম্যাভিউজ (১৯২২)-ও তাই।

এই সময়ে সোভিয়েত চলচ্চিত্রে ত্রয়ী-র ছবি নিয়ে এল নতুন জীবন, নতুন সংগ্রামের কথা। আইজেনস্টাইনের স্ট্রাইক (১৯২৪)-এর বিষয় শ্ৰেণীসংগ্ৰাম।

পরের বছর আইজেনস্টাইন পোটেমকিন জাহাজে ১৯০৫ সালের বিদ্রোহের কাহিনীকে পুনর্নির্মাণ করলেন বিপ্লবের ডায়ালেকটিকসকে শিল্পরূপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। পুদোভকিন-এর ‘মাদার’ বিপ্লবের গাথায় ব্যক্তির জীবনও সংগ্রামকে তুলে ধরল ; আর দোভঝেঙ্কো ‘আর্সেনাল’-এর পটভূমি হিসেবে বেছে নিলেন গৃহযুদ্ধ। এই সম্পূর্ণ,নতুন বিষয়বস্তু বা কনটেন্টের শিল্পরূপ এঁদের নতুন করে খুঁজতে হয়েছে, যেমন খুঁজতে হয়েছে মায়াকোভোস্কিকে কবিতায়। ১৯১৯ সালে লেনিনের চলচ্চিত্র সংক্রান্ত ডিক্রির ফলে চলচ্চিত্র-শিল্পে ব্যক্তিগত পুঁজির অবসান পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ করে দিয়েছিল। রোজার মভেল-এর ভাষায়,

Here at last was a country which put the film first and the box-office afterwards, and encouraged its brilliant directors to experiment at the state expense whether they made mistakes or not.

শিল্পকলার রূপ-বিন্যাসের উপর সমাজ-বিপ্লবের প্রভাব নতুন নয়, বিটোভেনের শিল্পের উপর ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব নিয়ে অনেকে আলোচনা করেছেন। বিটোভেনকেও ফরাসি বিপ্লবের অভিজ্ঞতাকে রূপ দিতে গিয়ে ফর্ম তৈরি করতে হয়েছে। আইনজেনস্টাইন, পুদোভকিনকেও ভাই করতে হয়েছে। এবং এই কাজ করতে গিয়ে এঁরা মার্কসীয় গতির বিজ্ঞান ডায়ালেফটিক্সকে সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন। আইজেনস্টাইনের বহু-পরিচিত ‘এ ডায়ালেকটিক্যাল এ্যাপ্রোচ টু ফিল্ম ফর্ম’, ‘নোটস অব এ ফিল্ম ডাইরেকটার’-এর অন্তর্ভুক্ত পোটেমকিন-এর গঠনরীতি বিষয়ে প্রবন্ধ, কিংবা পুদোভকিন -এর ‘ফিল্ম টেকনিক’ ( আইজেনস্টাইন ও পুদোভকিন-এর মধ্যে প্রয়োগরীতি নিয়ে মতপার্থক্য সত্ত্বেও ) চলচ্চিত্র মাধ্যমে ডায়ালেকটিকসের সচেতন ব্যবহার নিয়ে ভাবনা-চিন্তার নিদর্শন। অবশ্য‍ই তাত্ত্বিক আইজেনস্টাইন ছিলেন এ-বিষয়ে অগ্রণী। তাঁর কাছে শিল্পের অর্থই রূপ নির্মাণে ‘ডায়ালেকটিক সিস্টেম’-এর, ( যা চেতনায় বস্তুজগতের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার পুনর্নির্মিত ) অভিক্ষেপ ( প্রোজেকশান )। ফেয়ারব্যাঙ্কস যাকে মঁতাজের ‘গতির-বিজ্ঞান’ বলেছিলেন আসলে তা মার্কসীয় ডায়ালেকটিকসবিজ্ঞান। চলচ্চিত্রের কাঁচামাল শট্‌কে পাশাপাশি সাজালে ‘কনফ্লিক্ট’ দ্বন্দ্বের ফলে তা কীভাবে গতিশীল হয়ে ওঠে ‘স্ট্রাইক’, ‘পোটেমকিন’, ‘অক্টোবর’, ‘ক্যু ও ভিভা মেক্সিকো’, ‘ওল্ড এণ্ড দ্য নিউ’, ‘ইভান দ্য টেরিবল’ প্রভৃতি ছবি তার উদাহরণ। দ্বন্দ্বের সম্পর্ক নানানভাবে সৃষ্ট হয়েছে, যেমন রেখাগত অবস্থানে, বিভিন্ন তলের পারস্পরিক সম্পর্কে, রঙের বিন্যাসে, আলো-ছায়ায়, ক্যামেরার অবস্থানের তারতম্যে, বিপরীত গতির সান্নিধ্যে, কিংবা সমগ্র ছবির গঠন বিন্যাসে! ফর্ম-এ ডায়ালেকটিকসের ব্যবহার বিষয়বস্তু ও ফর্মের মধ্যে নতুন ঐক্য রচনা করেছে ; যা শিল্প সৌন্দর্যের মূলকথা।

পশ্চিমের চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকেরা আইজেনস্টাইন, পুদোভকিন, দোভসেঙ্কো প্রবর্তিত রুশ চলচ্চিত্রের শিল্পধারাকে ফর্মালিস্ট বা রাশিয়ান ফর্মালিজম আখ্যা দেন। বিশেষ করে ‘তত্ত্ববিদ পণ্ডিত’ আইজেনস্টাইনকে নয়া-কাণ্টবাদী লুগো মুনশটারবার্গ বা রুডোলাং আর্নহাইমের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসিয়ে চলচ্চিত্রে ফর্মালিজম সম্পর্কে আলোচনার রেওয়াজ আছে। আইজেনস্টাইন ‘great esthete’ ( ক্রফো) এবং আইজেনস্টাইনের ছবি, বিশেষ করে ইভান দ্য টেরিবল ‘possibly the supreme formalist film of all time.’ ( P. Hourston)। শিল্পতত্ত্বে ফর্মালিজম এ্যাবসট্রাকট সৌন্দর্য সৃষ্টিকে শিল্পের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে করে। এই তত্ত্বে শিল্পের ‘এসথেটিক ফাংশনই’ মূল কথা, এবং সেজন্য ফর্ম বা রূপই মূখ্য, বিষয়বস্তু গৌণ। শিল্পতত্ত্বে এই ভাববাদী তত্ত্বের আদিস্রষ্টা অ্যারিস্টটল। সৌন্দর্য সৃষ্টিতে কনটেন্ট এবং ফর্মের যুগপৎ ভূমিকা এবং দুই-এর মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ে ভ্রান্ত ধারনাই ফর্মালিজমের উৎস।

মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বে কনটেন্ট এবং ফর্ম সমান গুরুত্বপূর্ণ। এদের পারস্পরিক সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক ঐক্যের—অর্থাৎ একটিকে অপরটি থেকে বিশ্লিষ্ট করা যায় না। কনটেন্ট বস্তু জগতের অর্থময় প্রকাশ; শিল্পীর নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির ফলে সাবজেক্ট বা বস্তুজগৎ—সমাজ সম্পর্ক ও বিভিন্ন ঘটনা—শিল্পের কনটেন্ট হয়ে ওঠে। এজন্যই একই মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক ভিন্ন ভিন্ন শিল্পীর কাজে ভিন্ন ভিন্ন কনটেন্টের চেহারা নেয়। ফলে শিল্পের কনটেন্টের অর্থ কী উপস্থিত করা হল তাই নয়,কী ভাবে উপস্থিত করা হল তাও—এই কীভাবে উপস্থিত হল, ফর্মেরও মূল কথা। আইজেনস্টাইন বা পুদোভকিন ফর্ম নিয়ে বিশেষ করে ভেবেছেন এজন্য যে তাঁরা শ্রেণীসংগ্রামকে বা সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর প্রক্রিয়াকে তাঁদের বিষয় করেছেন। ১৯৩৩ সালে নাৎসি পার্টির একটি সভায় গোয়েবলস পোটেমকিন-এর মতো ছবি তৈরি করার জন্য জার্মান চলচ্চিত্র শিল্পীদের আহ্বান করেছিলেন। কিন্তু ফ্যাশিস্তদের পক্ষে দ্বিতীয় পোটেমকিন রচনা সম্ভব হয়নি, কারণ পোটেমকিন-এর আসল বৈশিষ্ট্য মঁতাজ বা ভাষা নয়, আসল বৈশিষ্ট্য আদর্শগত কনটেন্ট

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion