আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ
আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ নিয়ে আজ কিছু আলোচনা করব। আইনস্টাইন ছিলেন বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানবিদ আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বকবি, শিল্পী ও দার্শনিক। এই দুই মহামনীষীর মধ্যে কোথায় কতটুকু মিল ও পার্থক্য তা এই আলোচনা প্রসঙ্গে অনেকটা বোঝা যাবে।
বৈজ্ঞানিক খ্যাতির জন্যই যে রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তা নয়। আইনস্টাইন বৈজ্ঞানিক অপেক্ষা আরও বড়-কিছু ছিলেন, যার জন্যে তাঁকে বিশ্বের মানুষ বলে বিশ্ববাসী স্বীকার করে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল। বিজ্ঞানজগতে তাঁর অবদানের তুলনা নেই—এ কথা যেমন সত্য, তাঁর বিশ্বমানবতা ও মানবপ্রীতি পৃথিবীর ইতিহাসে তাঁকে সমুচ্চ স্থান দিয়েছে—এ কথাও তেমনি সত্য। বিশ্বমানবতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হলেও আইনস্টাইন ছিলেন জাতীয়তাবাদী। এইখানেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আইনস্টাইনের 'আশ্চর্য মিল। স্বজাতি ও স্বদেশকে স্বীকার করেও স্বজাতি ও স্বদেশকে অতিক্রম করার সুমহান আদর্শই বিশ্বভারতীর মূল কথা। আইনস্টাইনের এই আদর্শবাদী মনের প্রতি রবীন্দ্রনাথ স্বভাবতই আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
১৯২৬ সনের ১১-১৫ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ বার্লিনে ছিলেন—এই সময়েই অধ্যাপক আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকার হয় ১৯৩০ সনের জুলাই মাসে, বার্লিনের অদূরে Kaputh নামক পল্লীতে আইনস্টাইনের নিজের বাড়িতে। ঐ বৎসরেই সেপ্টেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আইনস্টাইনের আর একবার সাক্ষাৎ হয়। সেই সময়ে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে ফিরে তিনি কবি মেণ্ডেলের বাড়িতে অভিথি ছিলেন। সেই বছরের ডিসেম্বর মাসে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আবার দেখা হয়। এই সময়ে আইনস্টাইন California Institute of Technology-Visiting Professor- আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে যাবার পথেই নিউইয়র্কে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার হয়।
১৯২৬ সনে প্রথম সাক্ষাতে আইস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে ভাবের আদান-প্রদান হয়, রবীন্দ্রনাথ সে সম্বন্ধে নিজেই লিখে গেছেন:
“প্রথম মহাযুদ্ধের পর জার্মেনিতে গিয়ে আইনস্টাইনের সঙ্গে আমার দেখা। মনে পড়ে, আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে আধুনিক যন্ত্রশিল্পের উপযোগিতা সম্বন্ধে আমাদের আলাপ হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আর আজও আমি বিশ্বাস করি যন্ত্রবিদ্যার এই উন্নতি আসলে আমাদের শারীরিক কল্যাণ-বিধানের অনুকূল...প্রয়োজনের তাগাদায় মানুষের বিদ্যা-বুদ্ধি জীবনে যে সুবিধার সৃষ্টি করে তার সুচিন্তিত সদ্ব্যবহার করাই তো আমাদের কর্তব্য।...আইনস্টাইন ও 'আমার মধ্যে সম্পূর্ণ মতের মিল হল যে নূতন-নূতন যন্ত্রাবিষ্কারের সাহায্যে প্রকৃতির অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে আমাদের জীবন-যাত্রার সম্পদ আহরণ করতে হবে।”
রবীন্দ্রনাথের জীবন-দর্শন যাঁরা অনুশীলন করেছেন তাঁরাই জানেন যে পার্থিব সম্পদকে তিনি কখনই তুচ্ছ মনে করেন নি—তাঁর বিশ্বাস এই পার্থিব বস্তুর মাধ্যমেই অপার্থিব ঐশী সত্তার সন্ধান পাওয়া যায়। সেইজন্যেই তিনি যন্ত্রশিল্পের “সুচিন্তিত সদ্ব্যবহারের” কথা বলেছিলেন। ১৯৩০ সনের জুলাই মাসে আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে কথাবার্তা হয়, তার বাংলা অনুবাদ শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় ১৯৪১ সনে কবির মহাপ্রয়াণের অব্যবহিত পরেই ঢাকার 'বিজ্ঞান-পরিচয়' পত্রিকায় ছাপিয়েছিলেন। শ্রীযুক্ত কানাই সামন্তের বাংলা অনুবাদ অনেক পরে আইনস্টাইনের পরলোকগমনের পর ‘বিশ্বভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৩০ সনে জুলাই মাসে যেদিন আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আলাপ- আলোচনা হয়, তার দুদিন আগেই রবীন্দ্রনাথ অক্সফোর্ডে হিবার্ট বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বক্তৃতায় যা বলেছিলেন, “Religion of Man” নাম দিয়ে তা পুস্তকাকারে প্রকাশ করার জন্য তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন। সেই সময়কার চিন্তাধারাই আইনস্টাইনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।
Kaputh-এর বাড়িতে আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেছিলেন: বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ঐশী বস্তুর অস্তিত্বে কি আপনি বিশ্বাসী ? রবীন্দ্রনাথ উত্তরে যা বলেছিলেন তার মর্ম তাঁর ‘মানুষের ধর্ম' নামক · পুস্তকে প্রকাশিত বক্তৃতাবলী ও এই বিষয়ের অন্যান্য লেখায় বিশদভাবেই আমরা পাই। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ যে-সত্যে বিশ্বাসী, তা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, তিনি যে-বিশ্বে বিশ্বাসী, তা মানুষের সীমাবদ্ধ ধ্যানধারণার বিশ্ব নয়। তিনি লিখেছেন: “ব্যষ্টিগত মানব ঐক্যে বাঁধা দিব্য মানবের সঙ্গে, যিনি আমাদের অন্তরে আবার বাইরেও। অনন্তের ভূমিকায় বিরাজিত মানুষ—এই অনন্ত মূলতঃই মানবিক।” এই কথাই তিনি নানাভাবে নানা জায়গায় বলে গিয়েছেন।
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment