শিক্ষা প্রসঙ্গে
[নিচের প্রবন্ধটি আমেরিকায় উচশিক্ষার ত্রি-শততম বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে নিইউয়র্কের অ্যালবানি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত আইনস্টাইনের ভাষণ। এই ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন ১৯৩৬ সনের ১৫ অক্টোবর। বর্তমান বাঙলা অনুবাদটি Lina Arronet-এর ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে করা হয়েছে। অনূদিত ইংরেজি লেখাটি সঙ্কলিত আছে Albert Einstein-এর Ideas and Opinions (Rupa & Co., Calcutta, 1991) গ্রন্থে। আইনস্টাইনের জন্ম ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যু ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে। হিটলারের শাসনকালে তিনি মাতৃভূমি জার্মানি ত্যাগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেজন্য এই ভাষণে তিনি নিজেকে যাযাবর বলে অভিহিত করেছেন।
বাঙলাদেশের বর্তমান অধঃপতিত শিক্ষাব্যবস্থার পটভূমিতে আইনস্টাইনের চিন্তা বিবেকবান ভাবুক ও কর্মীদের নিকট মূল্যবান বিবেচিত হতে পারে—এই ধারণাবশে এটি বাঙলায় অনুবাদ করেছি। শৈশব-কৈশোরে আইনস্টাইন জার্মানিতে যে শিক্ষাব্যবস্থা দেখেছেন, শিশু-কিশোরদের জন্য তা ভীতির ছিল সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। আইনস্টাইনের বক্তব্য যে, আমাদের কাছে সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য, তা নয়। তবে এই চিন্তা অসুস্থতার মধ্যে সুস্থতার আকাঙ্ক্ষা জাগাতে পারে, এটা ধারণা করি। কোনো ব্যক্তির কিংবা জাতির পক্ষে অসুস্থতার চেয়েও মারাত্মক হল নিজের অন্তরে অসুস্থতার উপলব্ধি ও সুস্থতা লাভের আকাঙ্ক্ষা না-থাকা। বাঙলাদেশে বাঙালি আজ আত্মোপলব্ধিহীন, উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন, হীনমন্যতাপীড়িত: অনেক কাল আগে থেকেই বাঙালিকে বলা হয় আত্মবিস্মৃত। এখনকার অবস্থা আগের চেয়ে অনেক বেশি খারাপ। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বাঙালি আজ তার আত্মশক্তি হারিয়ে চলছে।
সমাজের আধিপতি শ্রেণী ও শাসকসম্প্রদায় চিরকাল পৃথিবীর সর্বত্র শিক্ষাব্যবস্থাকে নিজেদের কায়েমি স্বার্থের অনুকূলে, নিজেদের আধিপত্যলিন্সা চরিতার্থ করার উপযোগী রূপে রাখতে চায়। জ্ঞান সাধারণ মানুষকে তারা ততটুকুই দিতে চায় যতটা দিলে তাদের উপর সাধারণ মানুষের নির্ভরশীলতা নিশ্চিত থাকে। আধিপত্যলিপ্সু, কর্তৃত্বলিপ্সু, প্রভুত্বলিপ্সুরা জানে যে, জ্ঞানেই শক্তি। জ্ঞান লাভ করে সাধারণ মানুষ শক্তিমান হয়ে উঠলে তাদের আধিপত্য খর্ব হবে—এ সম্পর্কে তারা সতর্ক থাকে। এজন্য জ্ঞানের শক্তি তারা সাধারণ মানুষকে দিতে চায় না। সাধারণ মানুষকে সেই শিক্ষাই তারা দিতে চায় যে শিক্ষা পেয়ে তারা বশ থাকবে। নিজেদের শ্রেণীর বাইরে অন্য মানুষদের স্বাধীন সত্তা তারা স্বীকার করে না; তাদেরকে তারা নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের উপায় মনে করে। অনেক সময়েই শিক্ষার নামে তারা জনসাধারণের মধ্যে নানা রকম প্রতারণামূলক কার্যকলাপ চালায়। বর্তমান নয়া-উপনিবেশবাদী বিশ্বব্যবস্থায়, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পরে, পৃথিবীর গরিব দেশগুলোতে এ ব্যাপারটি অবাধে চালানো হচ্ছে।
সুস্থ সমাজে অধিপতিশ্রেণীর আধিপত্যলিপ্সা কম-বেশি নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং তাদের কায়েমি স্বার্থচিন্তার সঙ্গে জাতীয় অস্তিত্বের এবং জাতীয় স্বার্থের বিবেচনাও কাজ করে। বর্তমানে বাঙলাদেশে শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে অধিপতি শ্রেণীর মধ্যে জাতীয় অস্তিত্বের ও জাতীয় স্বার্থের বিবেচনা দুর্লভ। অবশ্য অন্যান্য নীতির ক্ষেত্রেও এদেশে এখন জাতীয় অস্তিত্বের ও জাতীয় স্বার্থের বিবেচনা-যে সুলভ, তা নয়। বাঙলাদেশে, বর্তমান আধিপতি শ্রেণীর পরিচালনায়, জাতি এক দীর্ঘস্থায়ী আত্মঘাতী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলছে। এ অবস্থায়, সুস্থতা ও সমৃদ্ধির প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ সকল ব্যাপারেই এখন সর্বাগ্রে দরকার সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নসমূহের গুরুতর বিবেচনা। বাঙলা ভাষায় বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, বেগম রোকেয়া, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান, মোতাহের হোসেন চৌধুরী প্রমুখের শিক্ষা বিষয়ে মৌলিক কিংবা বিশিষ্ট চিন্তা আছে। কিন্তু সে চিন্তার সঙ্গে আজ আমাদের জীবনাচরণের কোনো সম্পর্ক নেই। দেশ-বিদেশের আধুনিক যুগের শিক্ষা বিষয়ক মৌলিক চিন্তার সঙ্গে নতুন করে আজ আমাদের পরিচিত হওয়া দরকার। শিক্ষাব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যাতে শিক্ষার্থীকে অন্যের উদ্দেশ্য সাধনের উপায়রূপে ব্যবহৃত হতে না হয়। শিক্ষা শিক্ষার্থীর দিক থেকে কোনো বাহ্য বস্তুর মালিক হওয়ার (to have) ব্যাপার নয়: শিক্ষা শিক্ষার্থীর নিজেরই হয়ে ওঠার (to be) ব্যাপার। আইনস্টাইন নিজের জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো পর্যায়েই সার্টিফিকেট অর্জনে কৃতিত্বের পরিচয় দিতে আগ্রহী হননি, এবং ছাত্র কিংবা শিক্ষক হিসেবে জীবনে কখনো কৃতিত্বের পরিচয় দেননি। তবে শিক্ষা বিষয়ে তাঁর চিন্তা জ্ঞানানুরাগী বিবেকবান লোকদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে—অনুবাদক]
অনুষ্ঠানের দিনে সাধারণত অতীত-ঘটনা নিয়ে, বিশেষ করে, সাংস্কৃতিক জীবনধারায় যাঁদের সুকৃতি আছে তাদের নিয়ে, আলোচনা হয়। এ বিষয়টিই প্রথমে আসে, তার পরে অন্য বিষয়ের কথা। যেহেতু অতীতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের এবং মহান ঘটনাবলির স্মরণের মধ্য দিয়ে আজকের দিনের দুঃসাহসী মহৎ আকাঙ্ক্ষা উদ্দীপিত হয় সুতরাং পূর্বসাধকদের প্রতি উত্তরসাধকদের শ্রদ্ধাপূর্ণ আয়োজনকে অবহেলা করা যায় না। তবে এ কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত করা উচিত এমন বাক্তির উপর যিনি কৈাশোরকাল থেকেই দেশের মাটির সঙ্গে সংলগ্ন এবং দেশের অতীত সম্পর্কে অবহিত। যে ব্যক্তি যাযাবরের মতো দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং নানা ধরনের রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তিনি এ দায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি নন।
এ অবস্থায় আমার পক্ষে কেবল সেইসব বিষয়েই কিছু বলা সম্ভব যেগুলো স্থান-কাল-নিরপেক্ষভাবে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত যেগুলোর উপযোগিতা অতীতেও ছিল ভবিষ্যতেও থাকবে। সকল কালের প্রতিভাবান সৎ লোকেরাই শিক্ষা-সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে চিন্তা করেছেন, এবং বার বার তাঁরা তাঁদের মত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন। এ বিষয়ে আমার কথা বলার যোগ্যতার সমর্থনে আমি কোনো প্রমাণপত্র দেখাতে পারব না। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে আমার যোগ্যতার প্রমাণ নেই। আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি ছাড়া শিক্ষাবিজ্ঞানে অন্য কোনো অর্জনই আমার নেই। শিক্ষা বিষয়ে কথা বলার সাহস আমার কোথা থেকে আসবে? যদি এটা প্রকৃতপক্ষেই বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা হতো, তাহলে এসব বিবেচনা করে চুপ থাকাই হয়তো আমার পক্ষে সমীচীন হতো। থাক সে কথা, সক্রিয় মানুষদের বেলায় ব্যাপারটা ভিন্ন রকম। এ ক্ষেত্রে সত্যের জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, যাতে এই জ্ঞান হারিয়ে না যায় তার জন্য দরকার হয় বিরামহীন চেষ্টা দ্বারা জ্ঞানকে ক্রমাগত নবায়িত করার কার্যক্রম। জ্ঞানের তুলনা চলে মরুভূমিতে দণ্ডায়মান মার্বেল পাথরের সেই মূর্তির সঙ্গে যা ক্রমাগত ভাসমান বালুকণার নিচে তলিয়ে যাওয়ার হুমকির সম্মুখীন থাকে। সূর্যালোকে মার্বেল যাতে চির-দ্যুতিমান থাকে তার জন্য সেবার হাতকে সব সময় সক্রিয় রাখতে হয়। এই সেবার কাজে অন্যদের হাতের সঙ্গে আমার হাত দুটোও সক্রিয় থাকবে।
ঐতিহ্যের সম্পদকে এক জেনারেশন থেকে অন্য জেনারেশনের কাছে হস্তান্তরের কাজে বিদ্যালয় সব সময়েই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে আসছে। এ কথা অতীতের চেয়ে বর্তমানের বেলায় অধিক প্রযোজ্য। কারণ আর্থিক জীবনধারার আধুনিক বিকাশের ফলে ঐতিহ্য ও শিক্ষার বাহন হিসেবে পরিবার এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় মানবসমাজের অস্তিত্ব এবং স্বাস্থ্য আজ অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বিদ্যালয়ের উপরেই অধিক নির্ভরশীল।
কখনো কখনো দেখা যায়, বিদ্যালয় কোনো কোনো বিষয়ে শিশু-কিশোরদের মনে সর্বাধিক পরিমাণ জ্ঞান ঢুকিয়ে দেওয়ার কারখানা মাত্র। এটা ঠিক নয় । জ্ঞান প্রাণহীন, বিদ্যালয় প্রাণবান সক্রিয় মানুষদের সেবায় নিয়োজিত। ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যক্তিত্বে সর্বসাধারণের জন্য মঙ্গলকর গুণাবলি ও দক্ষতা বিকশিত করা বিদ্যালয়ের কর্তব্য। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে দিতে হবে এবং ব্যক্তিকে সমাজযন্ত্রের যান্ত্রিক অংশে পরিণত করতে হবে। মানুষকে মৌমাছি কিংবা পিপীলিকার মতো সত্তায় পরিণত করার চিন্তা ভুল। ব্যক্তিগত স্বকীয়তা ও ব্যক্তিগত লক্ষ্যবিবর্জিত ছাঁচে-ঢালা মানুষদের নিয়ে গঠিত সমাজ ক্ষীণপ্রাণ হয় এবং তার বিকাশের সম্ভাবনা রুদ্ধ হয়ে যায়। এর বিপরীতে বিদ্যালয়ের অপরিহার্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত স্বাধীনভাবে চিন্তা ও কাজ করার সামর্থ্যসম্পন্ন ব্যক্তি গড়ে তোলার শিক্ষা। এই শিক্ষার অন্যতম অপরিহার্য লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদের এমন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে সহায়তা করা যাতে ভবিষ্যৎ জীবনে তারা সমাজের কল্যাণে কাজ করার মধ্যে তাদের জীবনের পরমোৎকর্ষ উপলব্ধি করতে পারে। আমি যতদূর বুঝতে পারি, তাতে মনে করি যে, ইংরেজদের বিদ্যালয়ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে এই আদর্শের নিকটবর্তী।
প্রশ্ন হল, কিভাবে এই আদর্শে পৌছা যাবে? নৈতিক উপদেশ কি এ আদর্শের দিকে অগ্রগতি সম্ভব
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment