দু'চার জন এমন একান্ত আত্মকেন্দ্রিক লেখক হয়তো বাংলাদেশেও আছেন যাঁরা এ প্রশ্নের জবাব দেবেন—'ও নিয়ে মাথা ঘামাই না, কেননা সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে ও কথা অবান্তর। লিখি ভরা মনে, আপন খেয়ালে।' আর কিছু লেখক আছেন যাঁদের মাথাব্যথা অতি সংকীর্ণ এক রসিক সমজদার গোষ্ঠীর মন পাওয়া-না-পাওয়া নিয়েই। তার বাইরের বিপুল জনতার নিন্দা প্রশংসায় তাঁদের কিছু এসে যায় না।

এ ধরনের চিন্তার মধ্যে কতটা আন্তরিকতা আছে, আপন অক্ষমতা গোপনের সাফাই কি না এগুলি—সেকথা না তুলেও বলা চলে যে, এরা সমগ্র বাঙালী লেখক সমাজের মধ্যে মুষ্টিমেয় । অধিকাংশ লেখকই চান তাঁদের রচনা সবাই পড়ুক, সবাই তার তারিফ করুক। এই ইচ্ছা খুবই সুস্থ ও স্বাভাবিক। ‘যশের কাঙালী হয়ে' 'করতালি' আদায়ের ফিকিরের বিরুদ্ধে আমাদের কবি বিদ্রোহ করেছিলেন ঠিকই কিন্তু সে শব্দ ফাঁকা ‘কথা গাঁথার’ নিষ্ফলতার জ্বালায় জ্বলেই। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে তিনি তাঁর ‘সুরের অপূর্ণতার’, ‘নিন্দার কথা' অত অনায়াসেই মানতে পেরেছিলেন।

অবস্থার বিপাকে বাঙালী সাহিত্যিকের এই ব্যাপকতম পাঠকলাভের অতি সুস্থ কামনা আজ কিভাবে বিড়ম্বিত আমরা সবাই জানি । বাঙলা সাহিত্যের সম্ভাব্য পাঠকসমাজ আজ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার কৃপায় নিরক্ষর, নিঃস্ব এবং দ্বিখণ্ডিত। দেশজোড়া নিরক্ষরতা সমুদ্রের বুকে সুশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিতদের যে ছোট্ট দ্বীপটি কোনোগতিকে ভেসে রয়েছে আমাদের লিখিত সাহিত্যের দৌড় বড় জোর তার সীমানার মধ্যেই। তার চারিদিকে ঘিরে আছে যে বিপুল নিরক্ষর ও নামমাত্র শিক্ষিতের সমুদ্র সেখানে পৌঁছতে সাহিত্যের প্রধান বাহন হল শ্রুতি। রামায়ণ, মহাভারত, পাখি, পাঁচালি পাঠ, কথকতা, কবিগান, যাত্রা, গম্ভীরা, তর্জা মারফতই একমাত্র সে গণ-সম্রাটের দরবারে প্রবেশ মেলে। অথচ নির্মম ঔপনিবেশিক শোষণ ও গভীর কৃষি-সংকটের দাপটে এগুলিও আজ বিবর্ণ, ম্রিয়মান। ভূমি ব্যবস্থার আমল ওলটপালট না ঘটিয়ে কোনো হাতুড়ে প্রক্রিয়ায় এদের পুনরুজ্জীবনও শেষ পর্যন্ত সম্ভব নয় ।

বাঙালী লেখকের কাছে তাই ‘কার জন্য লিখি’—এই প্রশ্নের জবাব প্রায় বিধিনির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে বোধ হয় ৷ অধিকাংশ কৃষক, মজুর (বাংলা দেশে এদের মধ্যে মস্ত একটা অংশ আবার হিন্দী বা অন্য ভাষাভাষী), এমন কি নতুন শিক্ষা-ব্যবস্থায় নিম্নমধ্যবিত্তেরও একটা বড় অংশ আজ লিখিত সাহিত্যের নাগালের বাইরে। অথচ এদের মেহনতেই গড়ে ওঠে দেশের সম্পদ। অর্থাৎ সমাজের সৃষ্টিধরেরাই আজ বঞ্চিত মানসসৃষ্টির প্রসাদ থেকে।

এই অমানষিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে আক্ষেপ জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ—বলেছেন দেশের সম্পদ যারা সৃষ্টি করে সেই ‘সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। ....তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।’

কিন্তু শুধু মহত্তর মানবিকতার আদর্শের দিক দিয়েই নয় এই মারাত্মক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাহিত্যিকের সংগ্রামের সঙ্গে তাঁর বৈষয়িক উন্নতির প্রশ্নও সরাসরি জড়িত। কারণ নিরক্ষর দেশে লিখিত সাহিত্যের বাজার যে কত সংকীর্ণ, তা এ দেশের সঙ্গে পশ্চিমের দেশগুলির তুলনা করলেই ধরা পড়ে। সেই সংকীর্ণ বাজারের জন্য সাহিত্যিক পসরা সাজিয়ে জীবিকা সংস্থানের চেষ্টা যে কত দুর্ঘট তাও বাঙালী সাহিত্যিকের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। যাঁরা সাহিত্যসৃষ্টি প্রসঙ্গে স্থূল জীবিকাসংস্থানের প্রশ্নকে অবান্তর মনে করেন তাঁদের সঙ্গে ঝগড়া করে লাভ নেই—তাঁদের উপেক্ষা করাই ভালো। অন্য সব কথা বাদ দিয়ে শুধু টিকে থাকার তাগিদেই বাঙালী সাহিত্যিক চান ব্যাপকতর পাঠকসমাজ।

দ্বিতীয়ত, সাহিত্যিকের দরদ সবচেয়ে যেখানে নিবিড় সেই সাহিত্যের উৎকর্ষ অপকর্ষের প্রশ্নও এই পাঠকসমস্যার সঙ্গে জড়িত। কারণ সমাজের বৈষয়িক সম্পদের স্রষ্টারা মানসসৃষ্টির নূন্যতম ভাগ থেকেও বঞ্চিত হন যে ব্যবস্থায় তা নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক। অস্বাভাবিকতার উপর ভর করে যে সাহিত্য সৃষ্টি হয় তার দৌড় সীমাবদ্ধ হতে বাধ্য এবং বাস্তব সংকট যতই ঘনীভূত হবে ততই তা আরো সীমাবদ্ধ হতে থাকবে। উনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীর বাঙলা সাহিত্যের উজ্জলতম নিদর্শনগুলির দিকে আঙুল

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion