আমার বিশ্বাস, অর্থনীতি ও সামাজিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন এমন ব্যক্তির পক্ষে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করতে যাওয়া নানাকারণেই ঠিক নয়।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টা প্রথমে বিবেচনা করা যাক। মেথোডলজির (Methodological) দিক থেকে, মনে হয়, জ্যোতির্বিদ্যা ও অর্থনীতির মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই, উভয় ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিকগণ সন্নিবিষ্ট ঘটনাবলীর মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র আবিষ্কারের জন্য সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য এমন কতগুলো সূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করেন, যাতে বিষয়টা যতদূর সম্ভব সহজবোধ্য হয়ে ওঠে। বাস্তবক্ষেত্রে কিন্তু পদ্ধতিগত পার্থক্য থেকেই যায়। পর্যবেক্ষিত অর্থনৈতিক ঘটনাবলী প্রায়শই এমন কতগুলো কারণ দ্বারা প্রভাবান্বিত, যেগুলোর পৃথক পৃথক মূল্যায়ণ প্রায় অসম্ভব। এমন ক্ষেত্রে অর্থনীতির সাধারণ সূত্রাবলীর আবিষ্কার কঠিন হয়ে পড়ে। অধিকন্তু, মানব-ইতিহাসের তথাকথিত সভ্যতার সূচনাপর্ব থেকে যে-অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে, তা একমাত্র অর্থনীতির দ্বারাই প্রভাবান্বিত এবং সীমিত নয়, ববং তার পিছনে নানাবিধ কারণই বহুল পরিমাণে বর্তমান। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ইতিহাসোক্ত প্রধান প্রধান রাষ্ট্রগুলি, তাদের অস্তিত্বের জন্য বিজয়াভিযানের কাছেই ঋণী। বিজয়ীজাতিগুলো সুবিধাভোগী শ্রেণী হিসেবে বিজিতদেশে আইন ও অর্থনীতিগতভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল। গায়ের জোরেই তারা ভূমির উপর একচেটিয়া অধিকার বিস্তার করে এবং স্ব-শ্রেণীর মধ্য থেকেই পুরোহিত নিযুক্ত করে। পুরোহিত সম্প্রদায়, শিক্ষা-নিয়ন্ত্রণের পথেই, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের একটা স্থায়ী রূপ দেন এবং তার কতগুলো মূল্যবোধ সৃষ্টি করেন; যার দ্বারা তৎকালীন সময় থেকেই সাধারণ মানুষ নিজেদের অজ্ঞাতসারে সামাজিক আচার-আচরণ পরিচালনা করে আসছে।

কিন্তু, বিগত দিনের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যই বলে দেয় যে, Thorstein Veblen কথিত মানববিকাশের ‘লুণ্ঠনজীবীস্তর’-কে আমরা কোথাও অতিক্রম করতে পারিনি। ঐ স্তরের পর্যবেক্ষণীয় অর্থনৈতিক ঘটনাবলী এবং তৎজাত সংক্ষেপে বলতে গেলে, সূত্রগুলো অন্যান্য স্তরে প্রয়োগযোগ্য নয়। সমাজতন্ত্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য হল, মানববিকাশের লুণ্ঠনজীবীত্বকে অতিক্রম করে অগ্রসর হওয়া। বর্তমান স্তরের অর্থনৈতিকজ্ঞান, ভবিষতের সমাজতান্ত্রিক সমাজ সম্পর্কে খুব কম-ই আলোকপাত করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, সমাজতন্ত্র সামাজিক-নৈতিক লক্ষ্যের অভিমুখী। বিজ্ঞান চরম লক্ষ্য সৃষ্টি করতে পারে না, এমন কি, মানুষের মধ্যে এই লক্ষ্যবোধ আরো কম সৃষ্টি করতে পারে—খুব বেশি হলে যা পারে, তা হল মানুষকে পথের সন্ধান দান, যে পথে অগ্রসব হয়ে তারা মোটামুটি কতগুলো লক্ষ্যে উপণীত হতে পারে। উচ্চনৈতিক আদর্শসম্পন্ন ব্যক্তিরাই এই লক্ষ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা করতে পারেন। যদি লক্ষ্যসমূহ মৃতজাত না-হয়ে জীবন্ত ও তেজোসম্পন্ন হয়, তাহলে যে-সমস্ত মানুষ সমাজের ক্রমবিবর্তনের ধারাকে নিজেদের প্রায় অজ্ঞাতসারেই নির্ধারণ করে থাকে, তারা ঐ চরম লক্ষ্য-গ্রহণ করে অগ্রসর হতে পারে।

এইসব কারণে, মানবিক সমস্যার প্রশ্নে, বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অতিরিক্ত মূল্যায়ণে সদাসর্বদা সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। এবং একথাও মনে করবার কোনো হেতু নেই যে, সমাজ-সংগঠনের প্রশ্নাবলী সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরাই একমাত্র মতামত প্রকাশের অধিকারী।

বেশ কিছুদিন ধরে অগণিত মানুষ জোরের সঙ্গেই ঘোষণা করে চলেছেন যে, অধুনা মানবসমাজ এক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলেছে এবং এর অস্তিত্ব গভীরভাবে বিপন্ন। এমতাবস্থার বৈশিষ্ট্য হল এই যে, ব্যক্তি-মানুষ, তা সে ছোট-বড় যে দলেরই অন্তর্ভুক্ত হোক না কেন, সেই দল সম্পর্কে উদাসীন, এমন কি বিরুদ্ধভাবাপন্ন। আমার বক্তব্যের সমর্থনে এখানে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিবরণ দেওয়া যাক। বুদ্ধিমান ও প্রসন্নচিত্তের অধিকারী জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে আর-একটা যুদ্ধের বিপদ নিয়ে অধুনা আমি আলোচনা করেছি। আমার মতে—সে-যুদ্ধ মানবজাতির অস্তিত্বকে সাংঘাতিকভাবে বিপন্ন করে তুলবে এবং আমি এ-মন্তব্যও প্রকাশ করেছি যে, কোনো অধি-জাতীয় সংগঠনই (Supranational organization) একমাত্র এ-বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে। এ-কথার পর আমার অতিথি অতি প্রসন্ন ও শান্তভাবে বললেন—“মানবজাতিব অবলুপ্তির পথে আপনি গভীরভাবে প্রতিবাদী হয়ে দাঁড়াচ্ছেন কেন?”

আমি নিশ্চিত যে, এক শতক আগে পর্যন্ত এ-ধরনের হালকা উক্তি কেউ করতেন না। এ-উক্তি করেছেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি নিজের জীবনে ভারসাম্য আনয়নে আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion