বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তে মহাবীর সেনাপতি মেনাহাতীর মৃত্যুর পর রাজা সীতারাম রায় অল্পদিনই তাঁর রাজত্ব রক্ষা করতে পেরেছিলেন। দিঘাপতিয়ার দয়ারাম রায় যুদ্ধে পরাজিত সীতারামকে নিয়ে যান মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে। পথে নাটোর রাজবাড়ির কারাগারে সীতারামকে বন্দী থাকতে হয়েছিল। সীতারামের বিপুল ভূসম্পত্তির একটি অংশ, বিরাহিমপুর পরগনাও হয়েছিল নাটোরের রাজার হস্তগত। এরপর নবাবদের পালা ফুরোলো। বাঙলার তথা ভারতবর্ষের রাজদরবারের প্রতিষ্ঠা হয় কলকাতা শহরে। যশোর থেকে এসে সেখানে বাসা বাঁধলেন ঠাকুর পরিবার। ঠাকুর বংশের কৃতী সন্তান দ্বারকানাথ লক্ষ্মীর কৃপালাভ করলেন এই নতুন শহরে। কিন্তু তখনকার দিনে আভিজাত্যের নিদর্শন ছিল ভূসম্পত্তি। তাই বিখ্যাত কার-ঠাকুর কম্পানির মালিক দ্বারকানাথ প্রভূত জমিদারি সম্পত্তি খরিদ করেন বাঙলাদেশের একাধিক অঞ্চলে। কিন্তু বিরাহিমপুর পরগনা, যার সদর শিলাইদা রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে বিজড়িত হয়ে ইতিহাসবিখ্যাত হয়েছে—তা তিনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকারসূত্রে।

বিলেতে দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর কার-ঠাকুর কম্পানি ও দ্বারকানাথের আর-এক কীর্তি ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক, কোনোটি বেশিদিন টেকেনি। ব্যবসা গুটোতে গিয়ে দেখা গেল পর্বতপরিমাণ দেনা, বেশির ভাগই কিন্তু বিনা খতে, কেননা দ্বারকানাথের নামের জোরেই রাশি রাশি টাকা ধার পেতে কিছু অসুবিধা হতো না। কিন্তু জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবেন্দ্রনাথ আইনের চেয়ে নীতি বড়ো বলে মানতেন, তাই কড়ায় গণ্ডায় তিনি মিটিয়ে দিলেন পাওনাদারদের দাবি। লোকে চমৎকৃত হলো কিন্তু জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার হলো প্রায় নিঃস্ব। কিন্তু বিরাহিমপুর, সাজাদপুর ও কালীগ্রাম বা পতিসরের জমিদারি থেকে গেল এঁদেরই দখলে, তা ছাড়া উড়িষ্যাতেও এঁদের কিছু জমিদারি ছিল। দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথের চেষ্টায় এই জমিদারির আয় ক্রমে বেশ মোটা অঙ্কেই দাঁড়াল।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ জীবিতাবস্থাতেই এই বিস্তৃত জমিদারি ভাগবাটোয়ারা করে দেন যাতে পরে কোনো গোলমাল না হয়। কিন্তু এর পরিচালনা করতেন তিনি নিজে, কেননা গিরীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় অল্পবয়সেই। উত্তরাধিকারসূত্রে পরে সাজাদপুর পরগনার মালিক হন গিরীন্দ্রনাথের তিন পৌত্র: গগনেন্দ্ৰ নাথ, সমরেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ। কিন্তু বার্ধক্যে তিনি চান সম্পূর্ণভাবে সংসারের দায়মুক্ত হতে, তাই জমিদারির ভার দেন স্বভাবতই জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথের উপর। দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন ঋষিতুল্য লোক; খাজনা আদায়ের থেকে খাজনা মকুবের দিকেই তাঁর ঝোঁক; সুতরাং জমিদারি প্রায় লাটে ওঠার অবস্থা হলো। তখন ভার পড়ল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উপর। বালক রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে একবার শিলাইদা গিয়ে তাঁর জ্যোতিদাদার সঙ্গে একদিন বেরিয়েছিলেন হাতির পিঠে চড়ে বাঘ শিকারে। এই ঘটনার জ্বলজ্বলে বর্ণনা আছে ‘ছেলেবেলা’তে। এরপরে বোধহয় রবীন্দ্রনাথ আর কোনোদিন হাতির পিঠে চড়েন নি। অন্তত তাঁর রচনায় তার কোনো উল্লেখ আছে বলে মনে পড়ছে না। তবে বৃদ্ধ বয়সে বরোদায় গেলে মহারাজা রেল-স্টেশনে কবির জন্যে জমকালো সাজ-পরা রাজহস্তী পাঠিয়েছিলেন কিন্তু কবি এই সম্মান একটু দুঃসহ বোধ করে মোটরকারে রাজপ্রাসাদ যাওয়াই প্রশস্ত বিবেচনা করেন। ফলে কবির ভৃত্য বনমালীর ভাগ্যে জুটল হস্তীপৃষ্ঠের আসন। শান্তিনিকেতনে ফিরে বনমালী সগৌরবে এই ঘটনার সবিস্তার বর্ণনা করেছিল।

স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর খুব বেশিদিন জমিদারির কাজে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মন বসেনি। মহর্ষি তাই রবীন্দ্রনাথের উপর ভার দিলেন বাঙলাদেশের ও উড়িষ্যার জমিদারি তদারক করার। রবীন্দ্রনাথ উনত্রিশ বছর বয়সে আস্তানা গাড়লেন শিলাইদার কুঠিবাড়িতে, আবার মাঝে মাঝে তাঁকে যেত হতো উড়িষ্যার জমিদারিতেও।

এই সময়কার কুঠিবাড়ির নানা কথা সংগ্রহ ক’রে শ্রীযুক্ত শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর লেখা ‘পল্লীর মানুষ রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রমানসের উৎস সন্ধানে’ প্রভৃতি বইগুলিতে জমিদার রবীন্দ্রনাথের যে-ছবি আমরা পাই তাতে ফুটে উঠেছে আশ্চর্য এক কর্মবীরের অলৌকিক ব্যক্তিত্ব, দেশবাসীকে যিনি উপহার দিয়েছিলেন ‘স্বদেশী সমাজ’-এর পরিকল্পনা। নিজের জমিদারিতে তিনি হাতে কলমে এই পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, প্রভাবশালী অনেক প্রজার, এমনকি, তাঁর নিজের অনেক কর্মচারীরও প্রতিকূলতা সত্ত্বে। এই প্রসঙ্গে শচীনবাবু তাঁর ‘রবীন্দ্রমানসের উৎস সন্ধানে’ বইতে উদ্ধার করেছেন একটি চিঠি যাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক কর্মচারীকে লিখছেন:

“প্রজাদের

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion