বাংলাদেশ আজ মুক্ত। ইতিহাসের এক প্রচণ্ড অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার গৌরবে বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবণিতা আজ ভূষিত। অমিত শৌর্য নিয়ে স্বদেশের সত্তা, স্বার্থ ও সম্মানের জন্য সার্থক সংগ্রাম করেছেন সেখানকার বাঙালিরা। ভারতভূখণ্ডে এমন উদ্দীপনাময় ঘটনার সাক্ষাৎ কখনও মিলেছে মনে হয় না। বিশ্বের বৃত্তান্তে নতুন সংযোজনা করতে চলেছে বাঙালি—

ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারি হউক জয় ৷

তিমির-বিদার উদার অভ্যুদয়, তোমারি হউক জয় ৷

ভারতের সৌভাগ্য ও গর্ব আজ এই যে পরম সৌহার্দ্য নিয়ে, বিপুল বিদেশী প্রতিকূলতায় সন্ত্রস্ত না হয়ে, বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে সাধ্যাতিরিক্ত সহায়তা দিতে সে চেয়েছে এবং পেরেছে। আর আমরা—যে যেখানে আছি—যারা মায়ের কোলে শুয়ে প্রথম কথা বলতে শিখি বাঙলা ভাষায়, তারা তো জানি যে বাংলাদেশে মমতার ডোরে সবাইকে বেঁধেছে আর অপরাজেয় করে তুলেছে এই ভাষা ৷ আর তাই আমাদের মনে এক অনাস্বাদিতপূর্ব প্রসন্নতা—বহু আশাভঙ্গে দীর্ণ আমাদের জীবনেও যেন একটা পরিণতি এসেছে, সার্থকতার সংকেত মিলেছে।

একটু আতিশয্য হচ্ছে কি ? হয় তো হোক—কিছুটা বাক্‌বাহুল্য আমাদের সহজাত। সেদিন দিল্লীতে আলিঙ্গন করলাম বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানকে পরিশ্রান্ত অথচ সতত তেজঃপুঞ্জ সেই নেতা, ‘জনগণমন অধিনায়ক’ যার প্রকৃত বিশেষণ, স্পষ্টোচ্চারিত বাঙলায় সমবেত জনতাকে বললেন, 'আমাকে ক্ষমা করবেন, আবেগে আমি আজ আকুল' । এই আবেগে একটু যেন বিহ্বল হয়ে পড়া বাঙালিদের চরিত্রবৈশিষ্ট্য নয় কি? একে অস্বীকার করা এক প্রকার অনুতাচরণ। তবে বিহ্বলতাই যে শেষ কথা নয়, তা মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালিরাই তো সর্বস্ব দিয়ে প্রমাণ করেছে, বাঙালির বুকের গহনে যে তেজ তা তো প্রোজ্জ্বল হয়ে জগতকে চমৎকৃত করেছে। একটু আতিশয্য হয় হোক—নতুন দিনের আলোয় নিজেকে সংবরণ করে নিতে শুধু যেন আমাদের বিলম্ব না হয় ৷

বাংলাদেশের মুক্তি শুধু একটা ভৌগোলিক-রাষ্ট্রিক পরিবর্তন আনেনি, সমসাময়িক ইতিহাসের গতি ও প্রকৃতিকেও এ-ঘটনা প্রভাবিত না করে পারে না । তবে প্রথমেই বলতে চাইছি যে, ভবিষ্যতের কাছে প্রতীক্ষা আমাদের যাই হোক না কেন, আপাতত আমরা অনেকে অসম্ভব একটা ছটফটানি থেকে নিস্তার যে পেয়েছি এ-বড়ো কম কথা নয় ।

মাসের পর মাস যখন আমরা বাংলাদেশের স্বীকৃতি চেয়েছি অথচ আশানুরূপ সাড়া মেলেনি, মাসের পর মাস ধরে যখন মাঝে মাঝে রীতিমতো সন্দেহ হয়েছে যে হয়তো বা ভারত সরকার সদিচ্ছা সত্ত্বেও এই ব্যাপারে ব্যর্থ হচ্ছে, তখনকার কথা মনে পড়ছে। মে মাসে (১৯৭১ ) মধ্যকলকাতায় এক মস্ত সভায় বক্তৃতা করার পর কয়েকজন ছেলে পরিস্থিতি সম্বন্ধে প্রশ্ন করছিল। হঠাৎ তাদের মধ্যে একজন বলল, 'আচ্ছা, দেখুন, অজয়বাবু ( অজয় মুখোপাধ্যায় ) আর আপনি আর ক'জন মিলে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে আমরণ অনশন করছেন না কেন ?' অনেকে হেসে উঠল, আমাকেও একটা জবাব দিতে হলো, কিন্তু গান্ধীজী-প্রবর্তিত অনশন প্রথায় বিশ্বাসী না হয়েও কথাটা আমার মনে ধাক্কা দিয়েছিল। বাস্তবিকই ভেবেছিলাম, অন্তত মনের ছটফটানিকে শান্ত করার একটা উপায় বুঝি ওভাবে মিলতেও পারে !

ঘটনাচক্রে, প্রায় একই সময়ে, “পোলাণ্ড” নামে যে-সচিত্র মাসিক কেউ কেউ দেখে থাকবেন, তাতে লক্ষ্য করলাম Szmul Zygielbojm-এর ছবি এবং জীবনকথা । ইনি পোলাণ্ডের ইহুদিসংঘের নেতা ছিলেন এবং হিটলারী অমানুষিকতায় যখন ওয়ারশ শহরের ইহুদি বাসিন্দারা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে তখন সাহায্যের আশা নিয়ে লণ্ডনে যান (১৯৪০-৪১) । সেখানে প্রচুর সহানুভূতি অথচ বাস্তব সহায়তায় অনিচ্ছা কিম্বা অপারগতা দেখে নিজের যথাসাধ্য প্রয়াসের ব্যর্থতার ফলে তিনি ভগ্নহৃদয় অবস্থায় আত্মহত্যা করেন এবং একপত্রে মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতার বিবৃতি রেখে যান। এক খ্যাতনামা পোলিশ কবি এই ঘটনা নিয়ে লেখা তাঁর রচনার আখ্যা দেন : “The Bloodshed unites us" এবং এই নামে একটি গ্রন্থের সমালোচনা (যা থেকে এ-ঘটনা সম্বন্ধে আরও কিছু জানা গেল ) আমার চোখে পড়ল

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion