একসময় যে শ্রমিক নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে মিল-কলকারখানার যন্ত্রপাতি ভেঙে শিল্পায়নের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়েছিল, কিংবা যে চার্চ, ধর্মীয় গোষ্ঠী কোপারনিকাস-গ্যালিলিও’র চিন্তা ও তত্ত্বকে বিরোধিতা করে বিজ্ঞানের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিল সেই একই শ্রমিক আজ শিল্পায়নের দাবিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পক্ষে শ্লোগান দিচ্ছে, ধর্মীয় গোষ্ঠীসমূহ বিজ্ঞানের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। এককথায়, বিরোধিতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বিজ্ঞান আজ যে কোনো শ্রেণী-পেশা-বর্ণ-ধর্মের মানুষের নিকট সর্বজনীন মতাদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সেই সাথে তা প্রগতি কিংবা পশ্চাৎপদতার নির্ধারক হিসেবে চর্চা হচ্ছে। ফলে বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি সম্মত্তির এই বিস্তৃত পাটাতনে আমরা যখন বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করব, মানুষ এবং সমাজকে বিজ্ঞানমুখী করার লক্ষ্য নির্ধারণ করি তখন তার আয়োজন ও কর্মসূচিতে বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের উদ্ভব, তার ইতিহাস, পদ্ধতি, প্রয়োগ, ফলাফল ইত্যাদি বিষয়ে বোঝাপড়াটা খুবই প্রাসঙ্গিক এবং জরুরিও বটে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, এ কারণেও যে ‘আমরা বিজ্ঞানের লোক, তারা বিজ্ঞানের পক্ষের লোক না’—এই ভেদরেখা ক্রমশ বিলীন হয়ে উঠছে। রাষ্ট্র, রাজনীতি থেকে শুরু করে ধর্মীয় যে কোনো ব্যাখ্যা ও বিজ্ঞাননির্ভর পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে উঠছে। সেখানে আমরা চাই বা না চাই গত কয়েক শতকে বস্তুগত কিংবা ভাবগত উভয়ক্ষেত্রেই পরিবর্তনশীলতার নির্ধারক/উপায়/মাধ্যম হিসেবে বিজ্ঞানের চর্চা/ব্যবহারকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

বর্তমানে যে বিজ্ঞানের মধ্যে আমাদের বসবাস অর্থাৎ এই আধুনিক বিজ্ঞানের গঠনপর্বের সময়টা ছিল মূলত সতের শতকে। বলা যায়, এই শতক থেকেই বিজ্ঞান সম্পর্কিত ধারণার স্পষ্ট বিভাজন গড়ে ওঠে। এবং তা মূলত ইউরোপীয় রেনেসাঁর (১৪৪০-১৫৪০) সময়ে উদ্ভব হয়। এই সময়ে বিজ্ঞান শুধু পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধিৎসা ও অনুশীলন হিসেবে হাজির হয়নি তা একটি স্বতন্ত্র পদ্ধতিগত কাঠামো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সাথে রেনেসাঁস পূর্ববর্তী সময়ে প্রকৃতি সম্পর্কিত অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণের সাথে যে ধর্মবিশ্বাস যুক্ত ছিল তা মুক্ত হয়ে বিজ্ঞান একটি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। বিজ্ঞানের এই প্রাতিষ্ঠানিকতা, পদ্ধতিতন্ত্র রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ে আরো অগ্রসরতা লাভ করে এবং তা প্রকৃতির জগৎকে ব্যাখ্যার সাথে সাথে রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও চর্চা হতে থাকে। এবং শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে তা আরো পাকাপোক্ত হয়। বিজ্ঞানের উদ্ভবের এই সময়কালকে আর একদিক থেকে বিবেচনা করা জরুরি। তাহলো কেন ঐ সময়ে, ঐ স্থানে বিজ্ঞানের আবির্ভাব ঘটলো? মনে রাখা দরকার, পনেরো ও ষোল শতকে বুর্জোয়াশ্রেণীর উত্থান, বাণিজ্য ও শিল্পের পুনরুজ্জীবন এবং অতঃপর সতের শতকে ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডে ঐ শ্রেণীর রাজনৈতিকভাবে জয়যুক্ত হওয়া বিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশের সাথেই সম্পর্কিত। বলা যায়, সমাজের এই সম্পর্কের বদল ও বিজ্ঞানের উদ্ভব একে অপরের মধ্যে প্রবিষ্ট, তাকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। উল্লেখ করা জরুরি, ইউরোপে রেনেসাঁস এবং শিল্প বিপ্লব পরবর্তী সময় থেকে বিজ্ঞান ক্রমশ একটা স্বতন্ত্র চেহারা নিতে শুরু করলো এবং অনুশীলন পদ্ধতির দিক থেকে দর্শনের সাথে তার ব্যবধানও ক্রমশ বাড়তে থাকলো। সেই সাথে কার্যকারণ সম্পর্কের নিরিখে প্রাকৃতিক সত্যাসত্য বিচারের পদ্ধতি হিসেবে বিজ্ঞান প্রায় সর্বজনীন স্বীকৃতি পেল। অন্যদিকে বিজ্ঞাননির্ভর প্রযুক্তির অকল্পনীয় ব্যবহারিক সাফল্য এই স্বীকৃতিকে আরো পাকাপোক্ত আসনে প্রতিষ্ঠিত করলো।

কিন্তু বিংশ শতকের শুরু থেকেই একের পর এক আবিষ্কার বিজ্ঞানের কার্যকারণবাদী চিন্তা পদ্ধতিকে যেমন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে তেমনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারিক আয়োজন, ক্রিয়াশীলতা প্রকৃতি, মানুষ ও সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ককের মধ্যে তৈরি করেছে নানামুখী সংকট।

সেক্ষেত্রে আমাদের এই অঞ্চলে বিজ্ঞানচেতনা প্রসারে বিজ্ঞানের উদ্ভব এবং তার সাথে জড়িয়ে থাকা আর্থ-সামাজিক ও বিজ্ঞানের দার্শনিক সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা জরুরি। কেননা যে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক সম্পর্কের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিকতা, আহ্বান, কর্মসূচি, জ্ঞানকাণ্ডের নির্ভরশীল মাধ্যম হিসেবে গড়ে উঠেছে, সেই সম্পর্ককে, পদ্ধতিকে প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করে বিজ্ঞানচেতনার আন্দোলনকে অগ্রসর করা কোনো না কোনোভাবে কর্তৃত্বশীল

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion