রবীন্দ্রনাথের সমগ্র চিন্তা ও সাহিত্যসৃষ্টির ধারা অনুসরণ ও অনুধাবন করলে দেখা যায় তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘কবিকাহিনী’ থেকে শুরু করে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এক বিশেষ মৌল জীবনসত্তার অনুভব বিকশিত ও পুষ্ট হতে হতে চলেছিল—যাকে আমরা বলতে পারি অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে, লোভী হিংস্র আগ্রাসনের বিরুদ্ধে—অতন্দ্র অভিযান, শাণিত প্রতিবাদ।

উচ্চ অভিজাতকুলে জন্মে, তৎসাময়িক জীবনধারা ও ধারণাকে আত্মস্থ করেও পদে পদে তিনি নিজেকে উত্তীর্ণ করে চলেছেন প্রাগ্রসর জীবনবোধের দিকে। মনে হয়, যেন ব্রাহ্মসমাজদর্শন ও উপনিষদের মূল ধারাকে তিনি অঙ্গীকৃত করেও রূপান্তরিত করেছিলেন বৈজ্ঞানিক সমাজচেতনা ও মূল্যায়নের দিকে। তাই দেখতে পাই যখনই বিশ্বমানবসমাজের কোনো অংশ হিংস্র আগ্রাসনের শিকার, তখনই সদাজাগ্রত রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদে মুখর।

মানব রিপু সকল, যা মনুষ্যসমাজের পূর্ণ বিকাশের মৌলিক বাধাস্বরূপ হয়ে ব্যক্তি মানুষ ও মানবসমাজকে মানবতাবিরোধী আগ্রাসী শক্তির কাছে বন্দী দাস করে রাখে—তা হচ্ছে লোভ, নীচতা, হীনম্মন্য কাপুরুষতা। ফ্যাসিবাদের মতো অ-মানবিক সংস্কৃতিরও ভিত্তি এইখানেই। তাই এই রিপুগুলির ব্যক্তি ও সামাজিক প্রকাশে রবীন্দ্রনাথের সাবধানবাণী ও প্রতিবাদ তীব্রভাবে সোচ্চার। ফ্যাসিবাদের আক্রমণ শুধু রাষ্ট্রক্ষমতায় সীমাবদ্ধ নয়, তা সমগ্র মনুষ্যসমাজের বিরুদ্ধে বিশ্বমানবতার বিরুদ্ধে এক জঘন্য পৈশাচিক অভিযান।

এই ফ্যাসিবাদী সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচার শোষণ ও ধ্বংসাত্মক আক্রমণের বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রহরী রবীন্দ্রনাথ। যখনই স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী দানবীয় শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তখনই রবীন্দ্রনাথের লেখনী শাণিত খড়গে রূপান্তরিত। ব্যুষর যুদ্ধের কাল থেকে শুরু করে ওঁর জীবনের শেষ অধ্যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সংকটকাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের বহু বিচিত্র সৃষ্টিধারায় ফ্যাসি-বিরোধিতা তাই নিরবচ্ছিন্ন। রবীন্দ্রনাথ সত্যই স্বভাব-ফ্যাসিবিরোধী।

মুখবন্ধ: জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র

প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদের মূল আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলেন:

সমস্ত য়ুরোপে আজ এক মহাযুদ্ধের ঝড় উঠেছে—কতদিন ধরে গোপনে গোপনে এই ঝড়ের আয়োজন চলছিল অনেকদিন থেকে আপনার মধ্যে আপনাকে যে মানুষ কঠিন ঘরে বদ্ধ করেছে, আপনার জাতীয় অহমিকাকে প্রচণ্ড করে তুলেছে, তার সেই অবরুদ্ধতা আপনাকেই আপনি একদিন বিদীর্ণ করবেই করবে।...

আজ মানুষ মানুষকে পীড়ন করাবার জন্য নিজের এই অমোঘ ব্রহ্মাস্ত্রকে ব্যবহার করেছে; তাই সে ব্রহ্মাস্ত্র আজ তারই বুকে বেজেছে।...

[‘মা মা হিংসীঃ’ : ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’, দ্বাদশ খণ্ড, সন ১৩২১/১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দ]

প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মূল কারণ সম্পর্কে লেখেন:

...পৃথিবীর ইতিহাসে সম্পূর্ণ একটা নূতন কাণ্ড ঘটিতেছে—তাহা এক দেশের উপর আর এক দেশের রাজত্ব এবং সেই দুই দেশ সমুদ্রের দুই পারে।

এত বড়ো বিপুল প্রভুত্ব জগতে আর কখনো ছিল না। যুরোপের সেই প্রভুত্বের ক্ষেত্র এশিয়া ও আফ্রিকা।

এখন মুশকিল হইয়াছে জর্মনির। তার ঘুম ভাঙ্গিতে বিলম্ব হইয়াছিল। সে ভোজের শেষ বেলায় হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া উপস্থিত।...

আজ ক্ষুধিত জর্মনির বুলি এই যে, প্রভু এবং দাস এই দুই জাতের মানুষ আছে। প্রভু সমস্ত আপনার জন্য লইবে, দাস সমস্তই প্রভুর জন্য জোগাইবে—যার জোর আছে সে রথ হাঁকাইবে, যার জোর নাই সে পথ করিয়া দিবে। য়ুরোপের বাহিরে যখন এই নীতির প্রচার হয় তখন যুরোপ ইহার কটুত্ব বুঝিতে পারে না।

আজ তাহা নিজের গায়ে বাজিতেছে।

[‘লড়াইয়ের মূল’ : ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’, ত্রয়োদশ খণ্ড, সন ১৩২১/১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দ]

এই শতাব্দীর কুড়ির দশক থেকে বিশ্ব-পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। মুসোলিনির স্বরূপ তিনি স্পষ্টই বুঝতে পারেন এবং ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে বলেন: 

ইতালির বর্তমান সমৃদ্ধিকে মানিয়া লইয়াও যদি দেখা যায় উহা অর্জনের জন্য এযে-পন্থা ও প্রক্রিয়া অনুসৃত হইয়াছে তা নীতিবিগর্হিত এবং ধরিত্রীর অবশিষ্টাংশের পক্ষে বিপদস্বরূপ, তবে তাহাকে বিচার করিবার অধিকার আমাদের অবশ্যই আছে। গবর্নমেন্টের বাক্‌স্বাধীনতা অপহরণের কুৎসিৎ অপরাধ এবং বিশ্বশান্তির পক্ষে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাংক্ষায় আমি উহারই প্রকাশ উপলব্ধি করিয়াছি।

[‘দ্য স্টার’, লন্ডন, ৫ আগস্ট ১৯২৬, ইংরাজি থেকে অনূদিত]

বন্ধু চার্লস ক্রীয়ার য়্যাণ্ড্রজকে এক চিঠিতে লেখেন:

ফ্যাসিবাদের

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion